৫১ জন ব্রাহ্মণের টিকি কেটে তিনি হয়েছিলেন 'টিকি কাটা জমিদার', জানেন কে এই ব্যক্তিত্ব?

Kaliprasanna Singha: কোন টিকি কত দক্ষিণার বিনিময় গ্রহণ করা হয়েছে, তা নাকি নিজের আলমারিতে একটা চিরকুটের মধ্যে লিখে রাখতেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।

চারটি বর্ণের শ্রেষ্ঠ বর্ণ হওয়ার জন্য ১৯ শতকের বাংলায় বেশ কিছু নিয়ম পালন করতে হতো ব্রাহ্মণদের। আজকে যেমন শুধুমাত্র পৈতে দেখলেই ব্রাহ্মণকে চিহ্নিত করা যায়, সেকালে কিন্তু বিষয়টা তেমন ছিল না। পৈতে ছাড়াও তখনকার দিনের ব্রাহ্মণদের মাথায় রাখতে হতো একটা লম্বা টিকি। ব্রাহ্মণদের জ্ঞানের গভীরতা প্রমাণ করার জন্যই মূলত এই টিকি রাখার বিষয়টি শুরু হয়েছিল। তার সঙ্গে সঙ্গেই বেশ কিছু অবশ্যপালনীয় নিয়ম ছিল ব্রাহ্মণ সমাজের জন্য। ত্রিসন্ধ্যা জপ করা থেকে শুরু করে আহ্নিক করা, প্রতিদিন পুজো করা, ঠাকুরের সেবা করা সবকিছুই ছিল ব্রাহ্মণদের কর্তব্য।

কিন্তু, সব ব্রাহ্মণ কি নিষ্ঠা পালন করে সব নিয়ম পালন করতেন? ব্রাহ্মণ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যেটা ছিল আসল বিষয় অর্থাৎ অধ্যায়ন এবং সমস্ত বিষয়ে অগাধ জ্ঞান লাভ করা, সেটা কি সবাই পালন করতেন? নাকি তার মধ্যেও অনেক ব্রাহ্মণ এমন ছিলেন যারা শুধুমাত্র নিজের পৈতে এবং টিকি দেখিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন করতেন? এই প্রশ্ন সেই যুগে অনেকের মাথায় ঘোরা ফেরা করত বটে, কিন্তু কেউ কি আর ব্রাহ্মণদের চটাতে চায়? তাই তেমনভাবে কেউ এই বিষয়টা নিয়ে গা করত না। 

তবে তৎকালীন একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার ছিলেন একেবারে অন্য গোছের। তাঁর মনে যে শুধুমাত্র প্রশ্ন জেগেছিল তাই নয়, তিনি রীতিমতো কোমর বেঁধে ব্রাহ্মণদের জ্ঞানের পরিধি বিচার করতে নেমে পড়েছিলেন। বিদ্যাবুদ্ধিতে তুখোড় ছিলেন এই জমিদার। তাই তিনি ব্রাহ্মণদের এই ভণ্ডামি প্রমাণ করতে একটা অদ্ভুত উপায় বের করলেন। তাঁর শর্ত ছিল, ওই ব্রাহ্মণকে তাঁকে তর্কে হারাতে হবে। নতুবা তিনি ওই ব্রাহ্মণের টিকি কেটে নেবেন। আর সেই সূত্রেই তিনি উপাধি পেলেন 'টিকি কাটা জমিদার' হিসেবে। কে ছিলেন এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার? চলুন, জেনে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন- সারা কালনা অন্ধকারে ডুবিয়ে নিরঞ্জন হয় প্রতিমার! অবাক করবে মহিষমর্দিনীর ঐতিহ্য

তখন উনিশ শতকের সময়। ব্রাহ্মণদের সেই যুগে ক্ষমতা ছিল অপার। চারটি বর্ণের মধ্যে সব থেকে শ্রেষ্ঠ বর্ণ হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের আচার বিচার পালন করতেন সে যুগের ব্রাহ্মণরা। পুজো করা থেকে শুরু করে শিক্ষাদান সবকিছুতেই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতেন ব্রাহ্মণরা। টিকি রেখে, পৈতে পরে নিজেদের ব্রাহ্মণত্ব প্রমাণ করতেন সে যুগের আচার্য-উপাধ্যায়রা। কিন্তু, জোড়াসাঁকোর সিংহ বাড়ির দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার কালীপ্রসন্ন সিংহের দর্শন ছিল একদম অন্যরকম। শোনা যায়, তিনি মনে করতেন শুধুমাত্র টিকি রাখলেই যে ব্রাহ্মণের পাণ্ডিত্য প্রমাণ হয়ে যায় এমনটা নয়। তার আড়ালে অনেক ভণ্ডামিও লুকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এই ভণ্ডামি প্রমাণ করবেন কী করে? এরকমই ভাবতে ভাবতে কালীপ্রসন্ন সিংহ বের করলেন একটি জুতসই উপায়। তাঁকে তর্কে না হারাতে পারলে কাটা যাবে ওই ব্রাহ্মণের টিকি! তবে তাঁর এ সিদ্ধান্তের পিছনে একটা কারণও ছিল। বিস্তারে জানা যাক।

কালীপ্রসন্ন সিংহকে আমরা চিনি হুতোম পেঁচা হিসেবে। জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবারের সন্তান ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। তিনি পৃথিবীতে ছিলেন মাত্র ৩০ বছরের জন্য। কিন্তু তার মধ্যেই একাধিক ভাষায় তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। মহাভারত অনুবাদ, সংস্কার মূলক কাজে সহায়তা, নাটক লেখা, অভিনয় করা এবং রঙ্গমঞ্চ স্থাপন, সবকিছুতেই কালীপ্রসন্ন সিংহের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তবে জমিদার হিসেবে কালীপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন অত্যন্ত খামখেয়ালি এবং বদমেজাজি। 

শোনা যায়, একদিন কালীপ্রসন্ন সিংহের বাড়িতে একটা ব্রত পুজো হওয়ার কথা ছিল। নিয়ম মেনে ওই দিন ব্রাহ্মণদের গরু দান করা হলো। এরকমভাবে পদবির জোর দেখিয়ে ব্রাহ্মণত্ব জাহির করে অনেক ব্রাহ্মণ সে যুগে নিম্ন বর্ণের মানুষের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা আদায় করতেন। ব্রত পুজো, পার্বণ যাই হোক না কেন গরু দান করা সে যুগের একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু, একদিন নাকি একজন ব্রাহ্মণ রাস্তাতেই কোনও এক কসাইকে তাঁর গরুটি বিক্রি করে দিলেন। তৎক্ষণাৎ খবর পৌঁছলো কালীপ্রসন্ন সিংহের কানে। খবরটি শোনামাত্রই একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। তৎক্ষণাৎ জমিদারবাড়িতে ডাক পড়ল ওই ব্রাহ্মণের। 

সেই সভায় সকলের উপস্থিতিতে ওই ভণ্ড ব্রাহ্মণের টিকি কেটে নিয়ে তাঁকে শাস্তি দিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। এটা তো ছিল একটা হঠাৎ করে ঘটা ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনাই কালীপ্রসন্ন সিংহের চোখ খুলে দিয়েছিল। তারপর থেকেই নাকি শোনা যায়, তিনি বিভিন্ন ব্রাহ্মণদের ভণ্ডামি ধরতে ব্রাহ্মণদের তর্কে আহ্বান জানাতেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রাহ্মণ সমাজের মধ্যে বহু ভণ্ড লুকিয়ে রয়েছে। ব্রাহ্মণ মানেই যে জ্ঞানীগুণী, এই ধারণাটা একেবারেই ভুল। তারাও ভণ্ড কিংবা কপট হতে পারে। তাই তাদেরকে শাস্তি দেবার জন্যই, টিকি কেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।

আরও পড়ুন- সংস্কৃত থেকে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন এই মুসলিম মহিলা! কেমন ছিলেন মুঘল যুগের প্রভাবশালী নারীরা?

এত জ্ঞানী গুণী একজন মানুষের সঙ্গে তর্ক করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। মহাভারত থেকে শুরু করে হিন্দু শাস্ত্র, এমনকি বিদেশের বিভিন্ন শাস্ত্র এবং মহাকাব্য একেবারে গুলে খেয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন। তাই তাঁর সঙ্গে তর্কে যেতেন খুব কম ব্রাহ্মণই। তবুও কয়েকজন ব্রাহ্মণ নিজেদের বুকের পাটা দেখিয়ে কালীপ্রসন্ন সিংহের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে যারা যারা পরাজিত হতেন, তাদের মাথার টিকি কেটে শাস্তি দিয়ে বিদায় করতেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। তবে একেবারেই যে কোন লাভ হতো না তা নয়, ব্রাহ্মণদের দেওয়া হতো মোটা দক্ষিণা। ব্রাহ্মণদের টিকি নেওয়া তো আর সস্তার কোনও ব্যাপার না। তাই যথাযথ দাম দিয়ে ওই ব্রাহ্মণের টিকি নিয়ে নিতেন কালীপ্রসন্ন। 

এই নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। কোন টিকি কত দক্ষিণার বিনিময় গ্রহণ করা হয়েছে, তা নাকি নিজের আলমারিতে একটা চিরকুটের মধ্যে লিখে রাখতেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। এরকম ভাবেই তাঁর কাছে জমা হয়েছিল সর্বমোট ৫১ ব্রাহ্মণের টিকি। আর তিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন 'টিকি কাটা জমিদার' হিসেবে। তবে 'টিকি কাটা জমিদার' হিসেবে পরিচিতি থাকলেও কালীপ্রসন্ন সিংহ আরও বেশি জনপ্রিয় মহাকাব্য মহাভারতের অনুবাদক এবং হুতোম প্যাঁচার নকশার লেখক হিসেবে। কালীপ্রসন্ন সিংহ এই হুতোম প্যাঁচার নকশা লেখার মাধ্যমে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের নয়, এ শহরের বাবুদের নানা কেচ্ছা-কাহিনিও ফাঁস করে দিতে চেয়েছিলেন। 

প্রথম থেকেই স্কুলছুট হলেও, বিদ্যা এবং বাগ্মিতায় তাঁর সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না সে যুগের ব্রাহ্মণদের। ব্রাহ্মণদের ভুয়ো পাণ্ডিত্যের প্রমাণ করে ব্রাহ্মণ ধর্মের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন সে যুগের এই তরুণ জমিদার। এর পাশাপাশি চলত মহাভারতের অনুবাদ। সবকিছু নিয়েই কালীপ্রসন্ন সিংহ হয়ে উঠেছিলেন সে যুগের একজন নামজাদা জমিদার। মাত্র ৩০ বছর এই পৃথিবীতে থাকলেও তাঁর কাজের মাধ্যমে, সর্বোপরি নিজের সংগ্রহ করা একান্নটা টিকির মাধ্যমে বাঙালির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন জোড়াসাঁকোর সিংহ বাড়ির এই 'টিকি কাটা জমিদার'।

More Articles