সারা কালনা অন্ধকারে ডুবিয়ে নিরঞ্জন হয় প্রতিমার! অবাক করবে মহিষমর্দিনীর ঐতিহ্য
Mahishamardini Puja: আগে পুজোর সময় এই ঘাটে হোরমিলার কোম্পানির স্টিমারে করে আসত বেলোয়ারি ঝাড় লণ্ঠন। তাই দিয়েই আটচালা সাজানো হতো।
শ্রাবণ মাসের এক ভোরবেলায়, হালকা ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে চলেছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির খেলা। রানাঘাট থেকে কালনায় এসে বসবাসরত এক আড়তদার, নাম ঈশ্বরচাঁদ পালচৌধুরী, প্রতিদিনের মতো সেদিনও গঙ্গাস্নানে চলেছেন। বৃষ্টি বাদল কোনও কিছুতেই তাঁর এই ভোরবেলার স্নান আটকাত না। ঈশ্বরচাঁদ পালচৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত সৎ, ধর্মভীরু ও সদালাপী মানুষ। সেই সময় বর্ধমানের মহারাজদের অর্থানুকূল্যে কালনা শহরের পূর্বাংশে গড়ে উঠেছিল এক নয়াপত্তনি। এই নয়াপত্তনির নাম হয়েছিল ‘নয়াগঞ্জ’। নয়াগঞ্জ তখন অত্যন্ত কর্মব্যস্ত অঞ্চল। ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের ভিড়ে সরগরম হয়ে থাকত। রানাঘাট থেকে এসে এখানেই ব্যবসা আরম্ভ করেন ঈশ্বরচাঁদ পালচৌধুরী। এই হপ্তাঘাটের একজন আড়তদার ছিলেন তিনি। কিন্তু আদতে ছিলেন রানাঘাটের পালচৌধুরী বংশের একজন সদস্য।
সেদিন স্নান সেরে উঠেই ভোরবেলার আলো আঁধারিতে তিনি দেখলেন এক জ্যোতির্ময়ী অপরূপা নারীমূর্তি তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে। বাকরুদ্ধ পালচৌধুরী মহাশয় কিয়ৎক্ষণ করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর সম্বিত ফিরে পেয়ে ‘দেবী মাতা’র পরিচয় জানতে চাইলেন। ওই নারী বললেন, “রানাঘাটের পালচৌধুরী বাড়িতে আমার পুজোর অনাচার হচ্ছে। আমি আর সেখানে থাকব না। তুই আমার পুজোর আয়োজন কর, আমি এখানে চলে আসব। কাল সকালে আমার কাঠামোর পাটা এখানে ভেসে আসবে। সেই পাটা তুলে এনে তার উপর মূর্তি গড়ে পুজো করবি (মতান্তরে এই আদেশ, চৌধুরী মহাশয় স্বপ্নে পেয়েছিলেন)।
যাইহোক, সত্যিই পরদিন দেবীর পাটা ঘাটে (বর্তমানে যেটি মহিষমর্দিনী ঘাট বলে পরিচিত) আটকে রয়েছে দেখা গেল। মহা সমারোহে দেবীর পাটার অভিষেক করা হল এবং নিত্য পুজোর ব্যবস্থা চালু হল। ব্যবসায়ীরা এই সময় বিক্রিত মালের ওপর মণ পিছু আধপয়সা করে ‘কর বৃত্তি’ চালু করলেন। উদ্দেশ্য ছিল পুজোর ব্যয় সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা। বৃত্তির টাকা আদায় করবার জন্য একজন গোমস্তা নিযুক্ত করা হল। প্রথম গোমস্তা ছিলেন ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন- মুসলিম সম্প্রদায়ের ফুল বেল পাতায় পূজিত হন দুর্গা, অমলিন রামকৃষ্ণের স্মৃতিধন্য এই পুজো!
‘মা’ মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিতা হতে লাগলেন। একদিন একজন মৃৎশিল্প কারিগর হঠাৎ এসে নিজ পরিচয় দিয়ে জানালেন, তাঁর নাম শ্রী ভবতারণ পাল। তিনি স্বপ্নাদশ পেয়েছেন মাতৃমূর্তি নির্মাণ করার। এরপর অত্যন্ত নিষ্ঠাসহকারে তিনি মহিষাসুরমর্দিনীর মৃন্ময়ী রূপটি নির্মাণ করলেন। আজও অত্যন্ত শুচিতা সহকারে ও নিষ্ঠার সঙ্গে মূর্তি তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রথমে হোগলা পাতার ছাউনির অস্থায়ী মণ্ডপে পুজো শুরু হয়। জনশ্রুতি আছে, প্রথম বছর পুজোর আয়োজন করতে করতে চৈত্রমাস চলে আসে, তখন ঠিক হয় শুক্লা সপ্তমী অথবা পূর্ণিমাতে পুজো হবে। পুজোর প্রথম পুরোহিত ছিলেন ষোড়শী মুখোপাধ্যায়।
দেবীমূর্তি দশভূজা, সিংহবাহনা। সিংহের স্কন্ধে দন্ডায়মানা, পদতলে ত্রিশূল বিদ্ধ মহিষাসুর। দেবীর দুইপাশে জয়া ও বিজয়া দুই সখী চামর ব্যাজন রত। পুজো এইভাবে দীর্ঘ দিন চৈত্র মাসেই চলেছিল কিন্তু চৈত্রের মাস ব্যবসায়ীদের সাল তামামির মাস। সারাবছরের হিসাব নিকাশ করা, হালখাতা পুজো করা, নতুনভাবে বছর শুরু করার জন্য ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত থাকতেন। ফলে নানান অসুবিধা দেখা দিল। তাই ব্যবসায়ীরা পরামর্শ করে শ্রাবণমাসের শুক্লা সপ্তমী বা পূর্ণিমায় পুজো করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
প্রতিবছর বর্ষার জন্য হোগলা পাতার ছাউনি নষ্ট হয়ে যেত এবং প্রতিবছরই নতুন করে ছাইতে হতো। পাকা মণ্ডপ নির্মাণ করবার জন্য স্থানীয় কিছু সম্পন্ন মানুষজন উদ্যোগ নিলেন। সেন মহাশয়, কুণ্ডু মহাশয়, পাল মহাশয়, মালিক মহাশয়, সাহা মহাশয় প্রমুখের প্রচেষ্টায় দুই কক্ষযুক্ত কড়িবড়গার পাকা মণ্ডপ তৈরি হল। দু’টি স্তম্ভের মাঝখানে প্রতিমার মূল বেদী। বেদীর দুই পাশে গ্যালারি, তাতে সাজানো হয় পিতল কাঁসার বাসন, ঘড়া, বালতি, ঘটি, গাড়ু, থালা, বাটি, গ্লাস ইত্যাদি। এগুলিকে দানের বাসন বলা হয়। পূর্বে অবশ্য অন্য নিয়ম প্রচলিত ছিল, তখন এই বাসনগুলি পণ্ডিত জনের বিদায়ী হিসাবে সাজানো থাকতো। পুজোর সময় নানান জায়গা থেকে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা আসতেন, তাঁরা চণ্ডীপাঠ, বেদ পাঠ করতেন। তাঁদের বিদায়ী হিসাবে নগদসহ এই দানের বাসন দেওয়ার রীতি ছিল। এই বাসন গুলি সারাবছর বিভিন্ন কাঁসারিদের বাড়িতে থাকে, পুজোর আগে বাসনগুলি পালিশ করে তাঁরা হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে যান এবং পুজো শেষে হিসাব বুঝিয়ে নিয়েও যান।
মন্দিরের সম্মুখভাগে, সিঁড়ি দিয়ে নেমেই রয়েছে প্রকাণ্ড একটি আটচালা। অনেক গুলি লোহার বীম স্তম্ভের মতো টিনের আটচালাটিকে ধরে রেখেছে। মাঝখানে রেলিং দিয়ে ঘিরে যাত্রাপালার আসর বসে। হপ্তা ঘাটের কাছেই স্টিমার ঘাট। আগে পুজোর সময় এই ঘাটে হোরমিলার কোম্পানির স্টিমারে করে আসত বেলোয়ারি ঝাড় লণ্ঠন। তাই দিয়েই আটচালা সাজানো হতো। কালের নিয়মে সেইসব পরিবর্তন হয়ে এসেছে বিদ্যুৎ বাতি। পুজোর পাঁচদিন আগে থেকেই শুরু হয় কীর্তন, যাত্রাপালা এবং নানান অনুষ্ঠান। আগে নট্ট কোম্পানি, গনেশ ঘোষ অপেরা, রয়্যাল বীণাপাণি অপেরা, কুমিল্লার ভুটুয়া সম্প্রদায় প্রভৃতি যাত্রাদল আসত। এখনও সেই ঐতিহ্য বজায় আছে। পুজোর সময় আগে ঘাটালের বিখ্যাত পুতুল নাচের দল আসত এবং এখন খাগড়ার জ্ঞানদা চক্রবর্তী ও তাঁর পুতুল নাচের দল প্রতিদিন মানুষের সম্মুখে বিনোদনের ঝুলি নিয়ে হাজির থাকে। এই পুতুল নাচের আসর কালনার মহিষাসুরমর্দিনী পুজোর একটি ঐতিহ্য। বহু আগে একটি নুনের গুদামে এই পুতুল নাচের আসর বসত। গঙ্গার ভাঙনে গুদাম নষ্ট হয়ে যায়। এরপর থেকে পশ্চিমদিকে একটি বাঁধানো স্থান ঘিরে এই আসর বসে।
আরও পড়ুন- দশভূজা কুমোরটুলির মেয়েরাও! থিম থেকে সাবেকি, কলকাতা থেকে বিদেশ কাঁপাচ্ছেন মহিলা শিল্পীরাই
আটচালার সম্মুখে একটি স্থায়ী নহবত খানা আছে। এটি তৈরি করান অত্যন্ত ধনী, সৎ এবং নিঃসন্তান ব্যবসায়ী রাসবিহারী চাল মহাশয়। ১৯২২ সালে এটি তৈরি হয়। তৎকালীন দক্ষ রাজমিস্ত্রি প্রিয়লাল নিজে হাতে এটি গড়ে তোলেন। নহবত খানাটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। চারপাশে লোহার বীমের স্তম্ভ এবং মাঝে কাঠের কারুকাজ মণ্ডিত, দেখতে অনেকটা পালকির মতো। একদম উপরে লাল টিনের নিশান। পুজোর সময় তিনবার নহবত বাজে। জৈষ্ঠ্য মাসের দশহরার দিন ছাগ বলি হয় এবং তারপরেই মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হয়। প্রথম যখন পুজোর প্রচলন হয় তখন ব্যবসায়ীরা দারোয়ান নিযুক্ত করেছিলেন, আজও প্রতীকী দারোয়ান দেখা যায়। তার কোমরে কাপড়ের বেষ্টনী, মাথায় পাগড়ি পিস্তল, চাকতি ও হাতে তলোয়ার থাকে। এই পুজো দুর্গাপুজোর মতোই চারদিন ব্যাপী হয়, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী। নিয়ম অনুসারে সপ্তমীর দিন একটি ছাগ বলি হয় এবং অষ্টমী পুজোর দিনও একটি ছাগ বলি হয়। নবমী পুজোর দিন মানসিক পুজোর ভিড় শুরু হয়, শাড়ি, ফলমূল, সন্দেশ ও অলংকার স্তূপাকার হয়। বর্ধমানের মহারাজার নামে এই পুজোর প্রথম সংকল্প হয় এবং দ্বিতীয় সংকল্প হয় রানাঘাটের পাল চৌধুরী মহাশয়দের নামে। নবমী পূজোর শেষে শুরু হয় বলিদান। অষ্টমী পুজোর সন্ধ্যা থেকেই মানসিক পুজোর লাইন পড়ে। সারারাত ভক্তরা পুজোর ডালি নিয়ে এবং ছাগ নিয়ে উপস্থিত থাকেন। পরদিন বেলা ১ টা থেকে শুরু হয় বলি।
নিয়মানুযায়ী দু’টি ছাগ বলির নিমিত্তে কালনার অধিষ্ঠাত্রী দেবী অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি এবং একটি ক্ষ্যাপাকালীর মন্দিরে দিয়ে আসা হয়। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিন দিনই চলে অন্নক্ষেত্র। এরপর আসে দশমী, বিসর্জনের বাজনা বাজে। প্রথম পুজোর প্রবর্তনকালে দেবী প্রতিমা ডাকের সাজে সাজিয়েছিলেন কমলা মালাকার। বর্তমানে নবদ্বীপের নিমাই দত্ত প্রতিমা সাজান। প্রতিমা নামানোর আগে বেদী কাটার প্রথা চালু আছে। পূর্বে মহিষমর্দিনীর নিরঞ্জনে ৬৪ বাহকের কাঁধে করে শোভাযাত্রায় বের হত প্রতিমা। বর্তমানে লোহার চাকা লাগানো গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথামতো শোভাযাত্রায় প্রথমেই থাকে পুতুল নাচ। নগর পরিক্রমার সময় দীনবন্ধু সাহার বাড়িতে প্রতিমাকে থামিয়ে মিষ্টি জল খাওয়ানো হয়। এরপর গঙ্গার ঘাটে প্রতিমা নিরঞ্জন হয় গভীর রাত্রে। নিরঞ্জনের সময় সারা কালনা অন্ধকারে থাকে। সাত দিন কাঠামো গঙ্গার জলে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সাতদিন পরে সেই কাঠামো জল থেকে তুলে এনে অভিষেক করে তারপর মন্দিরে প্রতিস্থাপন করা হয়। পুজো উপলক্ষ্যে বিশালা মেলা বসে ১৫ দিন ধরে। বিসর্জনের পরেও চলে যাত্রাপালা এবং ভাঙ্গা মেলাও দীর্ঘদিন থেকে যায়।