অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে বাণিজ্য যুদ্ধের ডাক ট্রাম্পের? কতটা বিপদের মুখে ভারত?

Donald Trump Import Duty on India: আমেরিকার শুল্ক হার চিন (১৩.৮%), জার্মানি (১২.২%) বা ভিয়েতনামের (১০.৭%) তুলনায় ভারতের ক্ষেত্রে কম।

অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডোর 'তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্ব' অনুসারে, যদি প্রতিটি দেশ তার সবচেয়ে দক্ষ উৎপাদন খাতে মনোনিবেশ করে এবং বাণিজ্যে অংশ নেয়, তবে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও কল্যাণ বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে, মুক্ত বাণিজ্য দেশগুলোর মধ্যে সম্পদ ও কল্যাণের সর্বোত্তম বণ্টন নিশ্চিত করে। কিন্তু বাস্তবে, অনেক দেশ সংরক্ষণবাদী নীতি গ্রহণ করে, যার মধ্যে শুল্ক একটি প্রধান অংশ। শুল্ক হলো আমদানিকৃত পণ্যের উপর আরোপিত কর, যা স্থানীয় শিল্পকে রক্ষা করতে এবং রাজস্ব সংগ্রহে ব্যবহৃত হয়। যখন একটি দেশ শুল্ক বাড়ায়, অন্য দেশগুলো পাল্টা শুল্ক আরোপ করে এবং এভাবেই বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়। অর্থনীতিবিদ ক্রুগম্যানের মতে, বাণিজ্য যুদ্ধের কুফল সুদূরপ্রসারী। এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে, বাণিজ্য সংকুচিত হয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাণিজ্য যুদ্ধ কী এবং এটি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য কেন বিপজ্জনক? আমেরিকার শুল্কনীতি ভারতের অর্থনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে? ভারত এই সংকটে কীভাবে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে?

আমেরিকার নতুন শুল্কনীতি ভারতের অর্থনীতির উপর কী প্রভাব ফেলছে?

২০২৪ সালে আমেরিকা ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের উপর গড় ২.৭% শুল্ক আরোপ করেছে, যা চিন (১৩.৮%), ভিয়েতনাম (১০.৭%) বা মেক্সিকোর (১৫.২%) তুলনায় কম। তবে ভারতের মোট রপ্তানির ২৬% আমেরিকায় যায়, যার মূল্য প্রায় ৯১.২ বিলিয়ন ডলার। এই শুল্ক বৃদ্ধি ফার্মাসিউটিক্যাল, রত্ন-গহনা এবং পেট্রোলিয়াম পণ্যের রপ্তানিকে প্রভাবিত করতে পারে। এইচডিএফসি ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এটি ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ০.৩% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। অর্থনীতির 'বাণিজ্য ভারসাম্য' ধারণা অনুসারে, রপ্তানি হ্রাস আমদানির তুলনায় বাণিজ্য ঘাটতি বাড়াতে পারে, যা মুদ্রার অবমূল্যায়নের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

আরও পড়ুন- ঝাঁ চকচকে হবে ধ্বংসস্তূপ! গাজাকে নিয়ে যা পরিকল্পনা ডোনাল্ড ট্রাম্পের

অন্য দেশের তুলনায় ভারতের অবস্থান কতটা শক্তিশালী?

তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমেরিকার শুল্ক হার চিন (১৩.৮%), জার্মানি (১২.২%) বা ভিয়েতনামের (১০.৭%) তুলনায় ভারতের ক্ষেত্রে কম। এমনকী থাইল্যান্ড (৩.৫%) বা মালয়েশিয়ার (৪%) তুলনাতেও ভারতের শুল্ক বোঝা তুলনামূলকভাবে হালকা। এই সুবিধা থাকা সত্ত্বেও, বিশ্ব বাণিজ্য সংকোচনের পরোক্ষ প্রভাব, যেমন সারা বিশ্বের চাহিদা হ্রাস এবং বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা, ভারতের জন্য এড়ানো কঠিন হবে। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে, বিশ্ববাণিজ্যের এই মন্দা ভারতের রপ্তানি-নির্ভর শিল্পগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

সরবরাহ শৃঙ্খলের পরিবর্তন কি ভারতের ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ নিয়ে আসতে পারে?

চিন-মার্কিন বাণিজ্য সংঘাতের ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো 'চিন প্লাস ওয়ান' কৌশল গ্রহণ করছে। ভারত এখানে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে তার সস্তা শ্রমশক্তি, তরুণ জনসংখ্যা, এবং আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের কারণে। ভিয়েতনাম (৪৬% শুল্ক) এবং মেক্সিকোর (১৫.২%) উপর উচ্চ শুল্ক ভারতকে এক আকর্ষণীয় বিকল্প করে তুলেছে। অর্থনীতির 'উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা' তত্ত্ব অনুসারে, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে ভারতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে, যা কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথ খুলে দিতে পারে।

চিনের ডাম্পিং কি ভারতের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে?

ইউবিএস-এর প্রতিবেদন অনুসারে, চিন যদি সস্তা পণ্য বৈশ্বিক বাজারে ডাম্পিং করে, তবে ভারতের বেসরকারি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ডাম্পিং মানে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি, যা স্থানীয় শিল্প, বিশেষ করে ভারতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (MSME) খাতকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। অর্থনীতির প্রতিযোগিতামূলক বাজার তত্ত্ব অনুসারে, এটি বাজারে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে এবং দেশিয় উৎপাদকদের ক্ষতি করে।

ভারত এই সংকটের মোকাবিলা কীভাবে করতে পারে?

প্রথমত, কেইনসীয় অর্থনীতি অনুযায়ী, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি (যেমন অবকাঠামো ও স্বাস্থ্য খাতে) এবং কর হ্রাসের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণ জোরদার করা। তৃতীয়ত, PLI স্কিমের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স ও সেমিকন্ডাক্টরের মতো খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি। এই পদক্ষেপগুলো ভারতকে আমেরিকার শুল্কনীতির প্রভাব থেকে সুরক্ষা দিতে পারে।

আমেরিকা কেন চিনের উপর ১০৪% শুল্কের হুমকি দিচ্ছে?

অর্থনীতির 'গেম থিওরি' অনুসারে, একটি দেশ শুল্ক বাড়ালে অন্য দেশ পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায়। ট্রাম্প প্রশাসন চিনের পণ্যে ৩৪% শুল্ক আরোপ করলে চিনও সমান শুল্ক দিয়েছে। এর জবাবে ট্রাম্প ৫০% অতিরিক্ত শুল্কের হুমকি দিয়েছেন, যা মোট শুল্ককে ১০৪%-এ নিয়ে যায়। এর ফলে সারা বিশ্বের শেয়ার বাজারে অস্থিরতা দেখা গেছে। ডাও জোন্স (বা সাধারণভাবে ডাও, হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ৩০টি বিশিষ্ট কোম্পানির একটি স্টক মার্কেট সূচক) ১,৭০০ পয়েন্ট পড়ে গেছে।

আরও পড়ুন- ট্রাম্পের পরিবারই ‘অনুপ্রবেশকারী’! কেন অভিবাসীদের নিয়ে কড়া আমেরিকা?

ভারতের উপর ২৬% শুল্কের প্রভাব কী?

এই শুল্ক ভারতীয় রপ্তানি খাতে চাপ সৃষ্টি করেছে। গত সোমবার সেনসেক্স ২,২২৬.৭৯ পয়েন্ট এবং নিফটি ৭৪২.৮৫ পয়েন্ট নেমে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ১২,১২২.৪৫ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে এবং টাকার মান ৮৫.৭৬-এ নেমেছে। অর্থনীতির তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্ব অনুসারে, এটি বাণিজ্য প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে উভয় দেশের জন্য ক্ষতিকর।

এই সংকট কি সুযোগের দ্বার খুলতে পারে?

হ্যাঁ, ভিয়েতনাম ও চিনের তুলনায় কম শুল্ক ভারতকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং কৃষি রপ্তানির নতুন বাজার ভারতের জন্য সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। আমেরিকার শুল্কনীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা এনেছে কিন্তু সঠিক কৌশলের মাধ্যমে ভারত এই সংকটকে শক্তিতে রূপান্তর করতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে ভারতের করণীয় কী?

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণ, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, এবং চিনের ডাম্পিং মোকাবিলায় অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ গুরুত্বপূর্ণ। 'নতুন বাণিজ্য তত্ত্ব' অনুসারে, বাজার বৈচিত্র্য ঝুঁকি কমায়। এছাড়া, পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খল স্থানান্তর ভারতকে উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

 

লেখক ড. শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সেন্ট পলস কলেজ, কলকাতার অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

More Articles