শিবের চরণে মাথা পেতে দিয়েছিলেন, তবু রাবণকে কেন খালি হাতে ফেরালেন তিনি

Ramayana : মহাকাব্যের চরিত্র হয়ে জন্ম যখন তখন রাবণের খলনায়কের স্বীকৃতিটুকুই বা কম কীসে!

মধুসূদন দত্ত তার ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে যতই রাবণকে ট্রাজিক নায়ক অথবা দেশপ্রেমিক আখ্যা দিয়ে পাঠক মহলে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন ভারতের ইতিহাসে রাবণ চরিত্রটি আজও খলনায়ক রূপেই জনপ্রিয়। মিথ যাই বলুক না কেন, প্রচলিত ধারণায় এসে সবটুকু ফিকে হয়ে যায়। তবে মহাকাব্যের চরিত্র হয়ে জন্ম যখন তখন খলনায়কের স্বীকৃতিটুকুই বা কম কীসে! তাছাড়া মহাকাব্যিক পরিসরে সমস্ত মুখ্য চরিত্রই মহিমান্বিত। তাই খলনায়ক না বলে প্রতিনায়ক বলা উচিত। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়িও মহাভারতের আলোচনা করতে গিয়ে কর্ণ, দুর্যোধন এঁদের প্রতিনায়ক বলেছেন। স্থানবিশেষে প্রতিনায়কের গৌরবের সামনে নায়ককেও ম্লান মনে হয়।

মহাভারতের কাহিনীর পরিণতিতে একপক্ষের হার অনিবার্য ছিল ঠিকই তবে তাকে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে হেয় করা যায় না। নচেৎ বীর হিসেবে, যোদ্ধা হিসেবে, এমনকী নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তো পিছিয়ে ছিলেন না রাবণ। তবে খামতি কোথায় ছিল? কেন এই ট্র্যাজেডির শিকার হতে হল তাকেই? কেন এই পরিস্থিতিতে পাশে পেলেন না আরাধ্য দেবতাদেরও? জীবনভর কুড়ানো অভিশাপের জেরেই কি এমনটা ঘটেছিল তার নাকি এর অন্তরালে ছিল অন্য কোনও কারণও? উত্তর খোঁজার দায় অবশ্যই আছে। মহাকাব্যের সঙ্গে বাস্তবের অকৃত্রিম যে যোগাযোগ, তা থেকে তো পালানো যায় না। তার পরিণতি কারণ দেখে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অনেক হিসেব কষতে সুবিধা হয়। 

রাবণ মহাদেবের উপাসনায় নিয়োজিত ছিলেন। কঠোর নীতি মেনে করেছেন পুজো। তাই  মহাকাব্যিক পরিসরে এমন পরিণতি যখন ভক্তের তখন প্রশ্ন ওঠে ভক্তি নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে আরাধ্য দেবতাকে নিয়েও। 

তাই এ আলোচনায় প্রথমেই আসে দেবাদিদেব মহাদেবের প্রসঙ্গ। রাবণ ছিলেন দেবাদিদেবের পরম ভক্ত। শোনা যায়, রাবণ উপাসনায় তুষ্ট করেছিলেন রাবণকে। শিবের কাছে তিনি নিজের মস্তক নিবেদন করেছিলেন এবং নিজের শিরা দিয়ে সংগীত বাজিয়ে তুষ্ট করেছিলেন মহাদেবকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, নিজের এত বড় ভক্তকে কেন যুদ্ধে রক্ষা করলেন না শিব?

আরও পড়ুন - সংস্কৃত থেকে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন এই মুসলিম মহিলা! কেমন ছিলেন মুঘল যুগের প্রভাবশালী নারীরা?

প্রসঙ্গত জেনে রাখা দরকার, রাবণ শিবের বড় ভক্ত ছিলেন ঠিকই কিন্তু এ ভক্তি মোটেই নিঃস্বার্থ ছিল না, ছিল স্বার্থসিদ্ধির তথা বর লাভের আশাতেই। অনেকেই বলেন রাবণ নাকি সবচেয়ে বড় ভক্ত ছিল, কিন্তু সে ধারণাও সত্য নয়। তাই মস্তক নিবেদন করার জন্য সাহসের প্রয়োজন হয় ঠিকই কিন্তু এর সঙ্গে নিঃস্বার্থ ভক্তির কোনও যোগ নেই, বরং রয়েছে বৈষয়িক লাভের যোগই। রাবণের চরিত্রের কিছু ইতিবাচক দিক ছিল যেমন তার শাস্ত্র, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, সঙ্গীত, শিবের প্রতি তার মহান ভক্তি এবং তার সাহসিকতা, যা দেবতাদেরও অবাক করে দিয়েছিল। তাই এত কিছুর পর ও যে প্রশ্নটা বড় হয়ে দাঁড়ায় তা হলে শিব কেন রাবণকে সাহায্য করেনি। উনি তো চাইলেই পারতেন ভক্তকে বৈতরণী পার করিয়ে দিতে।

কিন্তু এ উত্তরে আসার আগে, আরও একটি গল্পের কথা জানা দরকার। জলন্ধরের গল্প। মহাদেবের তৃতীয় নয়ন থেকে ক্রোধের আগুন যখন সাগরে পড়েছিল তখন জলন্ধরের জন্ম হয়েছিল, এই আগুন একটি শিশুর রূপ নেয় যার মধ্যে শিবের অংশ ছিল। শিবের অংশ রূপে জন্ম হওয়ার জন্য জলন্ধর ছিল অজেয়। যথেচ্ছ দাপট চালিয়েছেন জলন্ধর। দেবতারা কিছুতেই টলাতে পারেনি তাকে কিন্তু সে যখন পার্বতীকে অবমাননা করেন তখন শিব নিজেই তাকে বধ করেন। অর্থাৎ নিজের শক্তিকে নিজেই বধ করেন শিব। তাই যে দেবতা নিজের শক্তিকেই অন্যায় করতে দেখলে রেয়াত করেন না, তিনি ভক্তের অন্যায় সইবেন কেন!

আরও পড়ুন - দেওয়ালজুড়ে খোদাই করা রামায়ণ, ফিরে যাওয়া যায় অতীতে, ঘুরে আসুন ইতিহাসে মোড়া হাম্পি-তে

শিবপুরাণে আছে, শিবের করুণা সবচেয়ে বেশি পড়ে তিনজনের ওপর। যথা - স্বভাব ও কর্ম দ্বারা সাত্ত্বিক নারী, পশু এবং জন্ম নয় কর্ম দ্বারা সূচিত ব্রাহ্মণ। তাই নারীর অসম্মান দেখলে নিজের শক্তিকে বিনাশ করতেও দ্বিতীয়বার ভাবেননি শিব। দেবী পার্বতীর মতো এক নিষ্ঠাবান স্বাত্তিক নারীকে অবমাননা করেছিল জলন্ধর, এ ঘটনায় ক্রোধে ফেটে পড়েন শিব। শেষ করে দেন নিজের ঔরসে সৃষ্ট এই শক্তিকে। আচ্ছা এ গল্প কি জানতেন না রাবণ? শিবের এতো বড় ভক্ত হয়ে তো তার জানা উচিত ছিল। আর যদি জানতেনই তাহলে কেন নিজের চরিত্রে এমন কালিমা লাগতে দিলেন?

এমনিতেও শিবের ভক্তের তো অভাব ছিল না। তাই ভক্তির কঠিন স্বরূপ দর্শনও তিনি অনেক করেছেন। সেখানে রাবণ তো ভক্তি ভুলে যুদ্ধ ও লালসায় ব্যস্ত হয়ে পড়া একজন নিমিত্ত মাত্র। তার ওপর আবার সে কিনা মহিলার মর্যাদার হানি করেছে। সীতা পরস্ত্রী জেনেই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে হরণ করেছে। তাকে কেন সমর্থন করবেন শিব? 

তাছাড়া রাবণ মোটেই শিবের সবচেয়ে বড় ভক্ত ছিলেন না, বড় ভক্ত ছিলেন রামই। কিন্তু শিব তো উভয় পক্ষকে একসঙ্গে সাহায্য করতে পারেন না। তাই দেবাদিদেব যে ধর্মের পক্ষ, ন্যায়ের পক্ষকেই বেছে নেবেন এও তো অনিবার্য ছিলই। ধর্মকে জিততে দেওয়াই তো উচিত। এমনকী যখন রাম ও রাবণের যুদ্ধ হয় তখন রাবণ ভগবান শিবকে একবারও ডাকেনি, সে তার অহংকারে হোক অথবা অজ্ঞতায়। রাবণের উপাসনা যে ছিল কেবলই বর পাওয়ার লোভে তা বোধ করি শিবও ঠাহর করতে পেরেছিলেন।

More Articles