টুং, সোনাদা, ঘুম পেরিয়ে অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন, কেমন আছে ‘শৈশবের দার্জিলিংটা’?

Darjeeling : গ্রীষ্মের দাবদাহ হোক, পুজোর ছুটি কিংবা শীতের ছুটি, হাতে গোনা কয়েকদিনের বিরতি কাটানোর সঙ্গে, পাহাড়ের মনোরম পরিবেশ পেতে যেতেই পারেন দার্জিলিং

পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা মনে পড়লে বাঙালির প্রথমেই যার নাম মনে পড়ে সে হলো বাঙালির প্রিয় দিপুদা-র দা অর্থাৎ পাহাড়ের রানী দার্জিলিং। গ্রীষ্মের দাবদাহ হোক, পুজোর ছুটি কিংবা শীতের ছুটি, হাতে গোনা কয়েকদিনের বিরতি কাটানোর সঙ্গে, পাহাড়ের মনোরম পরিবেশ এবং ভাগ্যে থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন বাঙালির কাছে দার্জিলিং ঘুরতে যাওয়া অনেকটা রথ দেখা কলা বেচার মতই লাভজনক সওদা। তাই হাতে ছুটি পেলেই কখনও পরিবার, কখনও বন্ধুদের সঙ্গে কখনও আবার একা বেড়িয়ে পড়ে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে। বহু বাঙালির এখনও সচক্ষে দার্জিলিংয়ের মনোরম পরিবেশ অথবা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হয়ে ওঠেনি আবার বহু বাঙালির একবার দার্জিলিংয়ে ঘুরেও ঠিক মন ভরে না। দার্জিলিং প্রত্যেক ঋতুতে আলাদা আলাদা রূপ ধারণ করে মানুষের চোখে ধরা দেয়। যদিও মাঝে মাঝে অপরিচ্ছন্নতার অজুহাতে তার নামে কিছু মানুষ নাক সিটকায় তবুও ঘুরতে যাওয়ার নামে উৎসাহের কোনও খামতি নেই। সবাই যেন নিজের মতো করে দার্জিলিংকে দেখতে যায় এবং পাহাড়ের রানী তাদের মধ্যে বহু মানুষেরই মনোবাঞ্ছা পূরণ করে। ট্রেন, বাস অথবা বিমানে করে শিলিগুড়ি এবং নিউ জলপাইগুড়ি অবধি পৌঁছে সেখান থেকে বাস অথবা গাড়িতে করে সহজেই দার্জিলিং পৌঁছানো সম্ভব। দার্জিলিং ঘুরতে গেলে যেই জায়গাগুলো অবশ্যই ঘুরে দেখা যায় এই লেখায় রইল তারই একটা ছোট্ট তালিকা।

দার্জিলিং ম্যাল : যে কোনও পাহাড়ি এলাকার মতই দার্জিলিংয়ের রয়েছে নিজস্ব ম্যাল। ম্যাল যেন পাহাড়ের মধ্যে একটা সমতল। চা থেকে বিভিন্ন টুকিটাকি জিনিস কেনাকাটা করা অথবা কিছু না করে খাদের দিকে রেলিংয়ের ধারে থাকা বেঞ্চে বসে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য আদর্শ এই জায়গা। স্বাধীনতা দিবস অথবা প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে এখানে কুচকাওয়াজ এবং সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসের প্রদর্শনী হয়। ম্যালের মধ্যে রয়েছে একটি ছোট খোলা থিয়েটার। নতুন বছর উদযাপন থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান সেখানে অনুষ্ঠিত হয়। ম্যালে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ। তাই পায়ে হেঁটেই ঘুরতে হয়। চাইলে ঘোড়ার পিঠে চেপেও ঘোরাঘুরি করা যায়। সেক্ষেত্রে ঘোড়ার পিঠে চাপার আগে ভালো করে দরদাম করে নেওয়া বাধ্যতামূলক।

darjeeling

দার্জিলিং ম্যাল

আরও পড়ুন - একই ঘরে একসঙ্গে বসবাস করেন শিব-বুদ্ধ, দার্জিলিংয়ের এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে যে ইতিহাস

মহাকাল মন্দির : দার্জিলিং ম্যালের একপাশে মহাকাল মন্দির এবং মহাকাল মার্কেট যাওয়ার রাস্তা রয়েছে। মন্দিরে যাওয়ার রাস্তায় যথেষ্ট চড়াই রয়েছে এবং একটি নির্দিষ্ট স্থানের পরে জুতো খুলে মন্দির প্রাঙ্গণের দিকে উঠতে হয়। তবে এইটুকু কষ্ট যদি করা যায় তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের মিশ্রণের এক নিদর্শন যার নাম মহাকাল মন্দির। শান্ত মন্দির প্রাঙ্গণে কিছুক্ষণ কাটানোর পরে মন্দিরের একদিকের সিড়ি দিয়ে নেমে পৌঁছে যাওয়া যায় এক গুহার মুখের কাছে। খুবই সংকীর্ণ এই গুহার মধ্যে রয়েছে শিবলিঙ্গ এবং অন্যান্য দেব দেব দেবীর মূর্তি। যদিও একসঙ্গে দুইজনের বেশী গুহার ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি পাওয়া যায় না। গুহাটি খুব গভীর না হলেও খুবই সংকীর্ণ। তাই গুহার ভিতরে বেশী মানুষ প্রবেশ করলে বেরোতে সমস্যা হতে পারে।

darjeeling

মহাকাল মন্দির

দার্জিলিং চিড়িয়াখানা এবং হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট অথবা এইচ. এম. আই : পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুওলজিকাল পার্ক অথবা দার্জিলিং চিড়িয়াখানা অবশ্যই একবার ঘুরে দেখা দরকার। মানুষের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় অন্যান্য বহু চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখার পরে দার্জিলিংয়ে পৌঁছে পাহাড় দেখার বদলে চিড়িয়াখানা দেখার কি আদৌ কোনও যৌক্তিকতা আছে? উত্তর হবে হ্যাঁ এবং কারণ হবে দুটো। প্রথমত, বিভিন্ন প্রাণীদের সঙ্গে এই চিড়িয়াখানায় দেখতে পাওয়া যায় লাল পাণ্ডা। যারা ছোটবেলায় জঙ্গল বুক কার্টুন দেখেছে তারা জানে যে সেই কার্টুনে একটি লাল পাণ্ডা মোগলীর বন্ধু হয়েছিল। বর্তমানে লাল পাণ্ডা প্রজাতি হিসেবে বিপন্ন এবং লাল তালিকায় রয়েছে। সেই বিপন্ন প্রজাতির কিছু সুন্দর প্রতিনিধি রয়েছে এই চিড়িয়াখানায় যাদের সাধারণত ভারতের অন্য কোনও চিড়িয়াখানায় দেখতে পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় কারণ হিসাবে বলতেই হবে চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনা। পশু পাখিদের যথেষ্ট খেয়াল রাখা এমনকি তাদের সামনে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি করা দর্শকদের বাধা দেওয়ার জন্য প্রহরীরা খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। মানুষ যতক্ষণ ইচ্ছে নিজের মতো সময় ব্যয় করে একটি প্রাণী দেখতে পারেন কিন্তু অযথা চিৎকার করলে তাতে যে আসলে পশু পাখিদের কষ্ট হতে পারে সেই কথা তারা মনে করিয়ে দেন। এই ব্যবস্থাপনা দেখে অন্যান্য চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ এবং দর্শক উভয়ের কিছু শিক্ষা হয়।চিড়িয়াখানার এক প্রান্তে রয়েছে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট অথবা এইচ. এম. আই। পর্বতারোহণের শিক্ষা প্রদান করা ছাড়াও রয়েছে রক ক্লাইম্বিংয়ের মতো আরও বিভিন্ন জিনিস উপভোগ করার সুযোগ।

darjeeling

দার্জিলিং চিড়িয়াখানা

ঘুম স্টেশন : দার্জিলিংয়ে ঘুরতে যাওয়ার আনন্দ এবং উত্তেজনায় বহু মানুষের ঘুম না এলেও মানুষ ঘুমের কাছে যায়। ভারতের উচ্চতম রেল স্টেশন এবং টয় ট্রেন ছাড়াও ঘুমের আরও একটা আকর্ষণ হল স্টেশনের দোতলায় থাকা ছোট সংগ্রহশালা। দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেনের শুরু থেকে বর্তমান অবধি বিভিন্ন মূল্যবান নিদর্শন এই সংগ্রহশালায় দেখতে পাওয়া যায়। তাই মানুষ বলতেই পারে যে ঘুমের আকর্ষণ ক্ষমতা সত্যিই বেশি।

darjeeling

ঘুম স্টেশন

টাইগার হিল : দার্জিলিং এলাম আর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেলাম না? এই আফসোস অনেকের মনেই থাকে। তাই আফসোস করার থেকে ভোর রাতে বিছানা ছেড়ে উঠে গাড়ি করে মানুষ ভিড় করেন টাইগার হিলে। দার্জিলিংয়ের অন্যতম বিখ্যাত স্থান এবং মানুষের মুখে মুখে যার নাম, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সেই সোনালী মুকুট পরা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে পাওয়ার আদর্শ জায়গা হল টাইগার হিল। ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন থাকলে মানুষ কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ রূপ দেখে মোহিত হতে পারেন নিশ্চিত।

darjeeling

টাইগার হিল

আরও পড়ুন - হাবে-ভাবে একই, কিন্তু বাজারে দার্জিলিংয়ের লেবু বলে যা কিনছেন, আসলে তা কমলালেবুই নয়!

বাতাসিয়া লুপ, পিস প্যাগোডা এবং অন্যান্য : দার্জিলিংয়ে দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। পাহাড়ের রানীর ঝুলিতে রয়েছে বাতাসিয়া লুপের মতো দৃষ্টিনন্দন জায়গা। টয় ট্রেন চেপে যাওয়ার পথে ট্রেন থামলে নেমে দেখা হোক অথবা গাড়ি করে পৌঁছে যাওয়াই হোক, সারাবছর বহু মানুষ এখানে ভিড় করেন। ট্রেনের মধ্যে থেকে লুপের চারপাশে গোল করে ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে স্থানীয় পোষাকে সেজে ছবি তোলা অথবা দূরবীনে চোখ লাগানো, বাতাসিয়া লুপের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন মানুষের কাছে বিভিন্ন রকমের। এছাড়া রয়েছে পিস প্যাগোডা। বিশালাকার এই স্বেতশুভ্র স্থাপত্য মানুষের কানে কিছুটা শান্তির বাণী দিয়ে যায়। রক গার্ডেন, হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট অথবা শ্রুবেরী নাইটিংগেল পার্ক প্রকৃতির সবুজ ছোঁ*-য়া চোখে লাগিয়ে যেন মনকে শান্ত এবং আনন্দিত করে তোলে।

darjeeling

বাতাসিয়া লুপ

দার্জিলিংয়ে খাবার খাওয়ার কথা বললেই মানুষের মুখে উঠে আসে কেভেন্টারস অথবা গ্লেনারিসর নাম। ফেলুদার গল্প থেকে বরফির মতো হিন্দি সিনেমায় দেখতে পাওয়া কেভেন্টারসের সামনে মানুষ লম্বা লাইনে নিজের সুযোগের অপেক্ষা করে আছে। অন্যদিকে দার্জিলিং গেলে গ্লেনারিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেওয়াটাও যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে এই দুটি দোকানের বেশিরভাগ খাবারের দাম ঊর্ধ্বগামী এবং একইভাবে মান নিম্নগামী হয়ে পড়েছে। যদিও বেশ কিছু পদ এখনও সেই পুরোনো স্বাদ বজায় রেখেছে। তাই হুজুগে বাঙালি একটু খোঁজ করে গেলে এই বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের পরিবেশ এবং খাবার দুটোই উপভোগ করতে পারেন। বর্তমানে কুঙ্গা, হট স্টিমুলেটিং ক্যাফের মতো বিভিন্ন ছোটো খাবারের দোকানের নাম মানুষের মুখে উঠে আসছে। দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত চা কেনার এবং পান করার সুযোগ কোনও ভাবেই হাত করা উচিৎ না। প্রায় সর্বত্রই চা পাওয়া গেলেও চিনি ছাড়া দার্জিলিংয়ের লিকার চায়ের স্বাদ মানুষকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে।

darjeeling

গ্লেনারিস

যদিও ভালো খারাপ সবকিছু নিয়েই জীবন তাই বিশ্ব উষ্ণায়ণের ফলে বহু বছর শীতকালে বরফের দেখা পাওয়া যায় না। অনেকেই ঘিঞ্জি বলে দার্জিলিংয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন। তবুও হাজার হাজার মানুষকে কয়েক দিনের মানসিক শান্তি এবং আনন্দ দিতে অপেক্ষা করে থাকে আমাদের প্রিয় দার্জিলিং।

More Articles