হাবে-ভাবে একই, কিন্তু বাজারে দার্জিলিংয়ের লেবু বলে যা কিনছেন, আসলে তা কমলালেবুই নয়!
Orange Vs Kinnow: আমি আপনি আজকাল কমলালেবু বলে যা কিনছি তার বেশির ভাগটাই কিনো। কমলালেবুর মতো দেখতে এই কিনোতেই বাজার ভরে গেছে।
পৌষের ডাক এসে পৌঁছেছে বাঙালির ঘরে ঘরে। তার উপর আবার বড়দিনের ছুটি এসে পড়ল। আবহাওয়া দপ্তরের পারদ কতটা ওঠা-নামা করল তার বিশেষ তোয়াক্কা করে না বাঙালি। রাতের দিকে শীত শীত ভাব আর ভোরের দিকে একটু-আধটু কুয়াশা দেখলেই লেপ-কাঁথা, সোয়েটার, হনুমান টুপি রোদে দেওয়া শুরু হয়ে যায়। পাতে এসে পড়ে নলেন গুড়, বড়দিনের এক টুকরো কেক কিংবা কমলা রঙের গোল গোল রসালো ফল; এসব ছাড়া কি আর শীতকাল মানায়? কমলা রঙের কথা শুনে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। তবে, শীতের বাজার কমলা রঙ আর কমলা ফল দুটো নিয়েই বেশ গরম হয়ে উঠেছে। রংয়ের বিতর্ক ছেড়ে বরং কমলালেবুর দিকে একটু মন দেওয়া যাক। দোতলার ছাদ হোক কিংবা তিন তলার ফ্ল্যাটের একচিলতে ব্যালকনি, ছুটির দিনে শেষবেলার রোদে বসে কমলা খাওয়ার মজাই আলাদা। আবার, কমলালেবু ছাড়া বছর শেষের পিকনিকও জমে না। শীতকাল ও কমলালেবু নিয়ে বাঙালির এই আবেগ এড়িয়ে যেতে পারেনি কবি মনও। জীবনানন্দ সেই কবে লিখে গেছেন,
"আবার যেন ফিরে আসি/ কোনো এক শীতের রাতে/ একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে/ কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে"।
ওদিকে আবার বং-নেটিজেনদের শীতের অ্যান্থেম হয়ে উঠেছে ভাস্কর চক্কোত্তির বিখ্যাত পংক্তি, "শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?"। কাব্যে কমলা ভোগ নাহয় হলো, এবার বাজারের ব্যাগে উঁকি মেরে দেখা যাক চলতি শীতে কমলালেবুর হাল কেমন। আজকাল যে কমলালেবু কিনছি, খাচ্ছি তার স্বাদ ঠিক সেই দার্জিলিং বা নাগপুরের মতো হচ্ছে না। তবে কি এই পোস্ট-ট্রুথের যুগে কমলা লেবুতেও ভেজাল?
দার্জিলিংয়ের কমলায় ভাগ বসালে কে?
শীত এলেই বাংলার বাজার ভরে ওঠে মূলত দার্জিলিং ও নাগপুরের কমলালেবুতে। প্রকৃতপক্ষে, ইংরেজিতে যাকে অরেঞ্জ (Orange) বলা হয় তা মান্দারিন ও পমেলো এই দুই সাইট্রাস প্রজাতির ফলের সংকর। চলতি বাংলায় আমরা মান্দারিন, তার জাত ভাই ট্যাঞ্জারিন কিংবা অরেঞ্জ, সবকটাকেই কমলালেবু বলতে অভ্যস্ত। স্বাদে-গন্ধে পৃথিবী বিখ্যাত দার্জিলিংয়ের কমলা আসলে মান্দারিন প্রজাতির লেবু। এগুলি আকারে ছোট, স্বাদে অনেক বেশি মিষ্টি, খোসাও বেশ আলগা হয়। তবে, ভারতে সবচেয়ে বেশি কমলালেবুর ফলন হয় মহারাষ্ট্রের নাগপুরে। দার্জিলিংয়ের পরেই নাগপুরের কমলার চাহিদা রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারেও। এই দুটো অঞ্চল ছাড়াও দক্ষিণ ভারতের পশ্চিমঘাট ও নীলগিরির পার্বত্য অঞ্চল, উত্তরের হিমালয় এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন পার্বত্য অঞ্চল জুড়ে কমলালেবুর ফলন হয়। অঞ্চল বিশেষে কমলার প্রজাতি, স্বাদ, গন্ধ সব কিছুরই তারতম্য আছে। কিন্তু, আমি আপনি আজকাল কমলালেবু বলে যা কিনছি তার বেশির ভাগটাই কিনো। কমলালেবুর মতো দেখতে এই কিনোতেই বাজার ভরে গেছে।
আরও পড়ুন- বড়দিনের মিষ্টিমুখ, ৯০ পেরিয়ে আজও নবীন সালদানহা, রইল তিন নারীর অসাধ্যসাধনের গল্প
এমনকী, দার্জিলিং পাহাড়ের গা-ঘেঁষা শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ির বাজারেও দেদার বিকোচ্ছে কিনো। এক ঝলকে কমলালেবু মনে হলেও খোসা ছাড়িয়ে খেতে গেলেই কিনোর সঙ্গে কমলালেবুর যে ফারাক তা কিছুটা বোঝা যায়। এই কিনো মূলত চাষ করা হয় পঞ্জাব এবং চণ্ডীগড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। ফল ব্যবসায়ীরা একে পঞ্জাবের কমলালেবু নামেই ডাকে। কিনোর আরেকটি পোশাকি নাম হল মাল্টা। প্রজাতিগত ভাবে মান্দারিন ও অরেঞ্জ জাতীয় কমলালেবুর থেকে একেবারেই আলাদা এই লেবু। মান্দারিন লেবুর খোসা আলগা হওয়ায় সহজেই ছাড়িয়ে খাওয়া যায়। কিন্তু, কিনোর খোসা ভিতরের কোয়ার গায়ে শক্তভাবে লেগে থাকে, আকারেও দার্জিলিং কমলার চেয়ে একটু বড় হয়। যেখানে দার্জিলিং লেবুর রং কিছুটা হলদেটে হয়, সেখানে কিনোর রং বেশ গাঢ়। মিষ্টত্বের বিচারেও বেশ পিছিয়েই রয়েছে এটি।
বাঙালি কি আর দার্জিলিংয়ের কমলার স্বাদ পাবে না?
গত বছর দশেক ধরে দার্জিলিং জেলার মংপু, সিটং ব্লকে কমলালেবুর ফলন বহুলাংশে কমেছে। ফলে, বাংলার বাজারে ঘাটতি বেড়েছে দার্জিলিং কমলার। কিন্তু, শীত পড়লেই বঙ্গের উত্তর থেকে দক্ষিণের বাজারগুলিতে কমলালেবুর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। সেই চাহিদা মেটাতেই বাজারে ঢুকে পড়ছে কমলার মতো দেখতে কিন্তু কমলা নয়; কিনো। দার্জিলিং লেবুর চেয়ে দামেও বেশ সস্তা। সে জায়গায় কম ফলনের দরুন দার্জিলিং লেবুর দাম হু হু করে বাড়ছে। যদিও নাগপুরের কমলালেবু বাংলার বাজারে এখন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু, কিনোর সহজলভ্যতা টেক্কা দিচ্ছে নাগপুরের কমলাকেও। পকেটে চাপ না বাড়িয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালিও তাই কিনোই কিনছে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো ছাড়া উপায় কী! আশ্চর্যজনকভাবে, ইদানিং বক্সা পাহাড় সহ ডুয়ার্সের বিভিন্ন অঞ্চলে কমলা লেবুর চাষ বেড়েছে। ফলনও ভালো। বাজারেও কখনও সখনও দেখা মিলছে সেই লেবুর। তবে, ডুয়ার্স সহ উত্তরবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চলে লেবু চাষের পরিকাঠামো ও উৎপাদনে নজর দেওয়া আশু প্রয়োজন। নাহলে হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাঙালিকে ভুলতে হবে তার চেনা কমলালেবুর স্বাদ-গন্ধ।
আরও পড়ুন- যিশুর জন্মদিন কবে, বলা নেই খোদ বাইবেলেও! কেন তবে ২৫ ডিসেম্বর পালিত হয় বড়দিন?
কমলা সুন্দরীর রূপ তো আছে, গুণও আছে কী?
কমলালেবু প্রাকৃতিক ভাবে অ্যাসিড সমৃদ্ধ ফল। কমলার সুন্দর গন্ধ যেমন আমাদের মন ভালো করে দেয়, পাশাপাশি কমলালেবুতে থাকা ভিটামিন সি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। শীতে নিয়মিত কমলালেবু খেলে সর্দি-কাশি থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যায়। ভিটামিন সি ত্বক ভালো রাখার ক্ষেত্রেও সমানভাবে কার্যকরী। কমলালেবুতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টও থাকে, যা শরীরকে তরতাজা রাখতে সাহায্য করে। এই লেবুতে সাইট্রিক অ্যাসিড ও সিট্রেটস থাকে যা কিডনিতে স্টোন হতে দেয় না। এছাড়াও, কমলালেবু আমাদের হার্ট ভালো রাখতে এবং সারাদিনের খাবার থেকে শরীরে আয়রন শোষণে সাহায্য করে। কিন্তু, গ্যাস্ট্রোইসোফেগাল রিফ্লাক্স রোগে (GIRD) আক্রান্তরা বেশি মাত্রায় কমলালেবু খেলে পেটে প্রদাহজনিত সমস্যা হতে পারে। তাই, এই সব রোগীদের চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যাঁদের রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি তাঁদেরও কমলালেবু খাওয়ার বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষ দিনে ১টা থেকে ২টো কমলালেবু খেতে পারে।
গুণের দিক থেকে বিচার করলে কমলালেবুর মতো কিনোর উপকারিতাও যথেষ্ট। দুটোর গুণাবলী প্রায় এক। তাই, দার্জিলিংয়ের কমলা নিয়ে আদিখ্যেতা করার আক্ষেপ যতই থাক না কেন, শরীর স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে এই মরশুমে কিনোই কিনি।