একই ঘরে একসঙ্গে বসবাস করেন শিব-বুদ্ধ, দার্জিলিংয়ের এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে যে ইতিহাস
Mahakal Temple Darjeeling : আলাদা প্রাঙ্গণে নয়, একই মন্দির, একই ঘরের ভেতর একসঙ্গে সহাবস্থান শিব ও বুদ্ধের! একইসঙ্গে দুই দেবতারই আরাধনা সম্পন্ন হয়।
একটু দূর থেকে হাতছানি দিচ্ছে পাহাড়। যতদূর চোখ যায় কেবল আকাশ, পাহাড় আর ঠাণ্ডা কুয়াশায় মাখা কিছু মানুষ। দোকানপাটে মনপসন্দ জামা, পাহাড়ি খাবার; মোমো-থুকপার সঙ্গেই রয়েছে রঙবেরঙের টুপি, ঝাল ডাল্লে লঙ্কার আচার। সেইসঙ্গেই রয়েছে গরম চা, কফি এবং একরাশ শীত। দার্জিলিং শহর তার সমস্ত ডালি নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে পর্যটকদের জন্য। দাঁড়িয়ে থাকেন সেখানকার বাসিন্দারা। দার্জিলিং কেবল কেভেন্টার্স, গ্লেনারিজ কিংবা টাইগার হিলের সমারোহ নয়। পাহাড়ের রানি তার নিজস্ব ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। সেখানে কেবল সূর্যোদয়ের ক্যামেরাবন্দি মুহূর্ত নয়, রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যের গন্ধও…
সেই ইতিহাসের একটা অংশই লেগে আছে অবজারভেটরি হিলে। দার্জিলিং চৌরাস্তা থেকে সামান্য কয়েক মিনিট হাঁটাপথ। তারপরই স্বাগত জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল বড় একটি গেট। দুটি তোরণের নিচে সিংহ, ওপরে স্বস্তিক চিহ্ন পেরোনোর পর সার দেওয়া লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, সাদা পতাকা। পতাকার গায়ে কিছু লেখা, সেই ভাষা বাঙালিদের চেনা হলেও পড়তে পারবেন না সবাই। দার্জিলিং, কালিম্পং ও সিকিম জুড়ে এমন বৌদ্ধ মন্ত্র সম্বলিত পতাকাই যে উড়ে বেড়াচ্ছে। কেবল বৌদ্ধ মঠ নয়, রাস্তাঘাটেও দেখা মেলে সেই পতাকার। এত বৌদ্ধ মন্ত্র সম্বলিত পতাকা যখন, নিশ্চয়ই কোনও মঠই হবে!
আরও পড়ুন : বিষাক্ত হ্রদ, ভুতুড়ে বাংলো, উন্মুক্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা! দার্জিলিং নয়, এবার শীতে পাড়ি দিন এই পাহাড়ে
কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই খানিক ধাঁধাঁ লেগে যেতে বাধ্য। যারা আগেও এসেছেন, তাঁরা বিলক্ষণ চেনেন এই মন্দিরটিকে। হ্যাঁ, মন্দিরই বটে; মঠ নয়। কিংবা বলা যায়, মন্দির ও মঠ দুটোই! দার্জিলিংয়ের মহাকাল মন্দির এমনই অভূতপূর্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রথার এক সৌধ। দার্জিলিংয়ের বুকে থাকা জীবন্ত ইতিহাসের একটা প্রস্তর খণ্ড। মন্দির প্রাঙ্গনের ভেতর কালীর মন্দির; তারপর মূল মন্দিরের ভেতর শিবের মূর্তি। মহাকাল মন্দিরকে আদতে ‘শিব মন্দির’ বললে ভুল হয় না। কিন্তু কেবল শিব নন, ত্রিশূল নয়, তার পাশেই উপস্থিত বৌদ্ধ স্তূপ। রয়েছেন স্বয়ং বুদ্ধ! আলাদা প্রাঙ্গণে নয়, একই মন্দির, একই ঘরের ভেতর একসঙ্গে সহাবস্থান শিব ও বুদ্ধের! একইসঙ্গে দুই দেবতারই আরাধনা সম্পন্ন হয়। শিবের পুরোহিতের সঙ্গেই আসনে বসেন বৌদ্ধ সাধু।
মহাকাল মন্দির আসলে এমনই। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য – এমন একটি কথা পাঠ্যবইয়ে পড়েছি সবাই। বাস্তব পৃথিবীতে তার খুব কম উদাহরণই দেখা যায়। মহাকাল মন্দির সেই উদাহরণেরই অন্যতম। দার্জিলিং মানে কেবল বৌদ্ধ ভিক্ষু নন, সেখানে রয়েছে অসংখ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। সবাই একসঙ্গে বসবাস করেন। সেই ছবিটারই একটা খণ্ডিত অংশ ধরা পড়ে মহাকাল মন্দির চত্বরে। অবশ্য হওয়ারই তো কথা! ইতিহাস ও কিংবদন্তি বলে, মহাকাল মন্দিরের এই অঞ্চল থেকেই শুরু হয়েছিল দার্জিলিংয়ের বিস্তার। আজও এই চত্বরকে এই শহরের সবচেয়ে পুরনো ও পবিত্র অংশ বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
দার্জিলিং ও মহাকাল মন্দির – উভয়েরই গল্প শুরু হয় আজ থেকে প্রায় ২৫৭ বছর আগে। সালটা ১৭৬৫। সদ্য শেষ হয়েছে পলাশির যুদ্ধ। সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের রেশ কয়েকশো কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই ছড়িয়ে পড়েনি। সেই ১৭৬৫ সালে বাংলার উত্তরের এই অংশে এসে উপস্থিত হন এক তিব্বতি লামা, নাম দোরজে রিনজিং। আজকে যেটি অবজারভেটরি হিল নামে পরিচিত, সেটি তখন ছিল স্থানীয় লেপচাদের অত্যন্ত পবিত্র স্থান। সেই স্থানেই লামা দোরজে রিনজিং তৈরি করেন একটি বৌদ্ধ মঠ। একটু একটু করে লেপচা ও স্থানীয় ভুটানিরা এই মঠে আরাধনা শুরু করেন।
আরও পড়ুন : গ্লেনারিজ: যে চুম্বক লাখো মানুষকে ফিরিয়ে আনে দার্জিলিংয়ে
একে সুউচ্চ পাহাড়, শান্ত, ঠাণ্ডা আবহাওয়া। সেইসঙ্গে বর্ষার সময় এটি মেঘেদের রাজ্যে পরিণত হয়ে যায়। মেঘ, বিদ্যুৎ, বৃষ্টির সমাহার সেই সময় দেখা যায়। দার্জিলিংয়ের সঙ্গে মেঘেদের এমন সম্পর্ক আজও অটুট। যাই হোক, এই সমস্ত কারণেই বোধহয় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এই মঠটির নামকরণ করেছিলেন ‘বজ্রপাতের রাজ্য’ হিসেবে। ইংরেজিতে ‘The land of Thunderbolts’… আর স্থানীয় বাসিন্দা ও ভিক্ষুরা ডাকতেন ‘দোরজে লিঙ্গ’ হিসেবে। কিংবদন্তি হল, এখান থেকেই নাকি শহরের নাম হয় দার্জিলিং। সেই প্রবাদ সত্যি কিনা, জানা নেই।
আজকের মহাকাল মন্দির ঠিক যেখানে, একটা সময় তার পাশেই নাকি ছিল ওই ‘দোরজে লিঙ্গ’ বৌদ্ধ মঠ। দোরজে লিঙ্গের পাশেই ১৭৮২ সালে লামা দোরজে রিনজিংই তৈরি করেন মহাকাল মন্দির। ভাবুন, একই ব্যক্তি, যিনি ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে বৌদ্ধ, তিনি একই জায়গায় শিব আর বুদ্ধের মন্দির তৈরি করেন। যা গোটা অঞ্চলের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। তবে বৌদ্ধ মঠটি এখন আর নিজের জায়গায় নেই। ১৭৮৮ ও ১৮১৫ সালে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় গোর্খা আক্রমণের ফলে মঠটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ওই মঠটিকে স্থানান্তরিত করে কাছেই একটি ভুটিয়া বস্তিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আজও সেখানেই বিরাজমান দার্জিলিংয়ের প্রাচীন ইতিহাস।
আরও পড়ুন : সিকিম, সিটং অনেক হল! এই শীতে হাতের নাগালেই রয়েছে ‘ভারতের স্কটল্যান্ড’
মহাকাল মন্দির প্রধানত শিবের মন্দির। মন্দিরের স্থাপত্যকলার মধ্যেও সেই ছাপ দেখা যায়। তবে একটু মন দিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, সেই ছাপের ভেতরে মিশে আছে বুদ্ধের ছোঁয়াও। যেমন বৌদ্ধ মন্ত্র সম্বলিত রঙবেরঙের পতাকা। মন্দিরের ভেতরের ঘণ্টার গায়ে খোদাই করা ‘ওম মণি পদ্মে হুম’। কোথাও সার দিয়ে রাখা জপযন্ত্র… তবে আসল ছবি দেখা যায় মন্দিরের ভেতরে। একই ঘরে কালো পাথরের শিব আর বুদ্ধ মূর্তি বিরাজমান। ত্রিশূলের সঙ্গে সহাবস্থান স্তূপেরও। শিবমূর্তির সামনে বসেন হিন্দু পুরোহিত; তাঁর ঠিক মুখোমুখি হয়ে বসেন বৌদ্ধ সাধুও। সঙ্গে প্রদীপের আলো আর ঘণ্টাধ্বনি… যখন মন্ত্র উচ্চারণ হয় তখন যেন কথা বলে দার্জিলিং। কথা বলে তার বিগতকালীন সময়। কথা বলে প্রতিটা গলি, পাহাড়ের ধাপ। কথা বলে কাঞ্চনজঙ্ঘা। মহাকাল মন্দির সেই শান্ত পাহাড়কে আগলে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে।