ইলিশের নামে আসলে কি বিষ খাচ্ছেন? কীভাবে বুঝবেন...
বিষাক্ত রাসায়নিক ফর্মালিন মৃতদেহ সংরক্ষণ করতে এবং মর্গে মৃতদেহের ক্ষয় রোধ করতে ব্যবহৃত হয়।'
কথায় আছে মাছে ভাতে বাঙালি। ইলিশ না চিংড়ি কার স্বাদ সর্বোৎকৃষ্ট তা নিয়েও বিস্তর তর্ক। বাংলার ঘরে ঘরে সবসময়ই মাছের কদর রয়েছে। কিন্তু শুধু বাংলা নয় ভারতের উপকূল অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষরাও মনে করেন মাছ ছাড়া আহার অসম্পূর্ণ। বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই উপকূলবর্তী এলাকার মৎসজীবীদের তৎপরতা তুঙ্গে ওঠে। ঘরে ঘরে ইলিশ উপাচার চলে কয়েক মাস ধরে। কিন্তু সেই প্রিয় মৎস্যই যদি হয় বিষে ভরা! সাধু সাবধান, আকছার হচ্ছে এমনটা।
খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে ভেজাল মেশানো হয় একথা কারো অজানা নয়। দিনের পর দিন মাছ বরফে রেখে সেগুলি চড়া দামে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন ক্রেতাদের কাছে - একথাও মোটামুটি সকলেরই জানা। কিন্তু মাছ প্রেমীদের জন্য বড় বিপদ লুকিয়ে ফর্মালিনযুক্ত মাছে। সম্প্রতি কেরলের স্বাস্থ্য দপ্তর কোল্লাম জেলার আরায়াঙ্কভু সীমান্ত চেকপোস্টে প্রায় ১০,০০০ কেজি ফর্মালিনযুক্ত মাছ বাজেয়াপ্ত করেছে। বিষাক্ত রাসায়নিক ফর্মালিন মৃতদেহ সংরক্ষণ করতে এবং মর্গে মৃতদেহের ক্ষয় রোধ করতে ব্যবহৃত হয়।' অপারেশন সাগর রাণী' শুরুর পর ফর্মালিন দেওয়া ৭ হাজার কেজি চিংড়ি মাছ এবং ২৬০০ কেজি অন্যান্য প্রজাতির মাছ সহ মোট ২১,৬০০ কেজি বাজেয়াপ্ত করেছে প্রশাসন। শুধু তাই নয়, নাগাল্যান্ড ফর্মালিনযুক্ত মাছের বিক্রি নিষিদ্ধ করার পর কোহিমা জেলা প্রশাসন প্রায় ১০ লক্ষ টাকা মূল্যের ফর্মালিন বোঝাই চারটি গাড়ি আটক করেছে। মৎসপ্রেমীদের মধ্যে এই খবর আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে।
ফর্মালিন কী?
ফর্মালিন একটি অত্যন্ত বিষাক্ত রাসায়নিক যা পচনরোধী পদার্থ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই বর্ণহীন দাহ্য রাসায়নিক কাঠের পণ্য, কাপড় তৈরীতেও কাজে লাগে। তাছাড়া ছত্রাকনাশক এবং জীবাণুনাশক হিসেবেও ফর্মালিন ব্যবহৃত হয়। মর্গে মৃতদেহের বিভিন্ন অঙ্গের পচন রোধে ফর্মালিন দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।
ফর্মালিনের ক্ষতিকারক প্রভাব
ফর্মালডিহাইডের স্বল্পমেয়াদী ব্যবহারেই চোখে জলভাব বেড়ে যায়, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব এবং ত্বকে জ্বালা অনুভব হয়। এছাড়া বিষাক্ত এই রাসায়নিক দীর্ঘ সময়ের জন্য শরীরে প্রবেশ করলে ব্লাড ক্যান্সার ও অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এই রাসায়নিক। আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা এবং আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন উভয়েই ফর্মালিনকে মানবদেহের পক্ষে ক্ষতিকারক রাসায়নিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ফর্মালিন মানবদেহের শ্লেষ্মা ঝিল্লী বা মিউকাস মেমব্রেনের সংস্পর্শে এলে গলা এবং শ্বাস নালীতে জ্বালা অনুভব হয়। ফলস্বরূপ গলা ব্যাথা, নিউমোনিয়া এবং ব্রঙ্কাইটিসের মতো রোগ হয়। পেটে ব্যাথাও দেখা দিতে পারে। এছাড়াও এর ক্ষতিকারক প্রভাবের ফলে এলার্জি হতে পারে। ফর্মালিন কিডনি এবং লিভারেরও ক্ষতি করে। এমনকী কোনো ব্যক্তি কোমাতেও চলে যেতে পারেন ফর্মালিনের কারণে।
মাছে ফর্মালিন কীভাবে শনাক্ত করবেন?
বাজারের কেনা মাছে ফর্মালিন রয়েছে কিনা তা খুব সহজেই বুঝে নেওয়া সম্ভব। চিকিৎসকদের মতে, যে মাছে ফর্মালিন ব্যবহার করা হয় সেই মাছগুলি বেশ শক্ত হয়। এক্ষেত্রে মাছের আঁশও তাজা মাছের তুলনায় অনেক শক্ত হয়। মাছের গন্ধ থাকে না তবে এক ধরনের তীব্র গন্ধ ছাড়ে যা আদতে ফর্মালিনের গন্ধ। আরও বিষয় ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখবেন মাছ কেনার সময় ফর্মালিনযুক্ত মাছে কোনো মাছি বসে না। এইগুলি দেখে আপাত দৃষ্টিতে বোঝা সম্ভব মাছে ফর্মালিনের উপস্থিতি। তবে আতঙ্কের কথা হল কোনো খাবারে এই রাসায়নিক রয়েছে কিনা তা কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই। রাসায়নিক পরীক্ষার মাধ্যমেই একমাত্র ফর্মালিনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব।
ফর্মালিনযুক্ত মাছ কীভাবে ধুতে হবে?
যদি মাছ কেনার সময় বুঝতে না পারেন ফর্মালিনের উপস্থিতি তাহলে কিছু করার নেই। তবে সঠিক পদ্ধতিতে ধুয়ে নিলে ভয় থাকে না। তাই বাজার থেকে মাছ কিনে বাড়িতে কলের জলে ১০ থেকে ১২ মিনিট ভালোভাবে ঘষে মাছের টুকরোগুলো ধুয়ে নিন। শুধু জলে ভিজিয়ে রাখাই কিন্তু যথেষ্ট নয় এক্ষেত্রে। তবে যদি ৪ থেকে ৫ ঘন্টাও মাছ ফর্মালিন রেখে দেওয়া হয় তা মাছের দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে যা ধোয়ার পরেও দূর করা সম্ভব নয়।
আবার কোচির সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট ফর ফিশারিজ টেকনোলজি ফর্মালিনের উপস্থিতি পরীক্ষা করতে কিছু ডিটেকশন কিট তৈরি করেছে। এই কিটগুলি দিয়ে সহজেই বোঝা সম্ভব এর উপস্থিতি। তবে সবসময় বাজারের ভিড়ে দাড়িয়ে এই পরীক্ষা করা অসুবিধার তাই চেষ্টা করুন মাছ ভালোভাবে সময় নিয়ে ধুয়ে নিতে।
ফর্মালিনের উপস্থিতির কারণে শরীরে কী কী উপসর্গ দেখা যায়?
চিকিৎসকদের মতে মানুষের শরীরে ফর্মালিনের কারণে বমি ভাব এবং ডায়ারিয়া শুরু হতে পারে। অনেক সময় পেট খারাপও হয়। চর্মরোগ হতে পারে ত্বকের সংস্পর্শে এলে। চোখে জল পড়ার পাশাপাশি চুলকানি হয় ফর্মালিনের কারণে। কোনো ব্যক্তি ক্যান্সার আক্রান্ত হতে পারেন ফর্মালিনের কারণে।
যদিও ফর্মালিন বর্তমানে মৎস্যচাষীদের জন্য মাছ সংরক্ষণের জন্যপ্রিয় রাসায়নিক হয়ে উঠেছে তবে এর যথেচ্ছ ব্যবহার অকালেই বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই আমাদের সচেতন হওয়া আবশ্যক।