জেন জি থাকছে না সোশ্যাল মিডিয়ায়!
Zero Posting: বিশ্বের ৫০টি দেশে, ২.৫ লক্ষ সমাজ মাধ্যম ব্যবহারকারীর উপর করা 'ফিনান্সিয়াল টাইমস'-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, সমাজ মাধ্যমের ব্যবহার ১০ শতাংশ কমেছে।
অনামিত্রা বন্ধুদের সঙ্গে বিকেলবেলায় বেরিয়েছে মোমো খেতে। খাওয়ার সময় ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে লক্ষ্য করল, আজকাল আর সেরকম বন্ধুদের পোস্ট, ছবি, সেলফি, লাইফ আপডেট দেখতে পাওয়া যায় না সোশ্যাল মিডিয়ায়। তা সে ফেসবুকই হোক বা ইনস্টাগ্রাম। সঙ্গে বসে থাকা বন্ধুদেরও জিজ্ঞেস করল সে এই ব্যাপারে। এবং তারাও একই কথা বলল। আলোচনা বৈঠক বসল কেন এরকমটা হচ্ছে তা নিয়ে।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুদের ছবি, পোস্টের পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞাপন আর রিলসের বন্যা। সমাজমাধ্যমে থাকা চেনাজানা বন্ধুরা কেউ পোস্ট করছে না, এই পরিবর্তনের নাম ‘পোস্টিং জিরো’। 'দ্য নিউ ইয়র্কারে'র লেখক কাইল চায়কা এই শব্দটি ব্যবহার করে এই বিষয়ে একটি কলাম লেখেন। তাঁর সাপ্তাহিক কলাম 'ইনফাইনাইট স্ক্রল'-এ তিনি লিখেছেন, ইন্টারনেট প্রজন্মই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এখন ক্লান্ত।
বিশ্বের ৫০টি দেশে, ২.৫ লক্ষ সমাজ মাধ্যম ব্যবহারকারীর উপর করা 'ফিনান্সিয়াল টাইমস'-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, সমাজ মাধ্যমের ব্যবহার ১০ শতাংশ কমেছে। এবং ব্যবহার কমিয়েছে কমবয়সি বা বিশেষত জেন জি-রা। যে জেনারেশন ইন্টারনেটকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তোলে, সেই জেনারেশনই আজ ইন্টারনেটে ক্লান্ত।
আরও পড়ুন- FOMO থেকে FOFO! জেন-জিদের চার ‘ভয়’ ঠিক কী?
কী এই ‘জিরো পোস্টিং’?
সোশ্যাল মিডিয়ায় দৈনন্দিন জীবনের খবর শেয়ার না করা। জেন জি-রা বলছে, লাইকের দৌড়ে আর ছুটতে ইচ্ছে করে না। ফলে অ্যাকাউন্ট প্রাইভেট করে গ্রুপ চ্যাটে কথা বলা হচ্ছে। তাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।
কেন হচ্ছে 'জিরো পোস্টিং'?
•সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই এখন কেবল AI জেনারেটেড ভিডিও, বিজ্ঞাপন, ইনফ্লুয়েন্সারদের ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যে উঁকি দেয় ২-১টা চেনাজানা বন্ধুর পোস্ট। তাই, স্বাভাবিকভাবেই অযাচিত পোস্ট, ছবি, ভিডিও এড়ানোর উপায় হিসেবে সকলে বেছে নিয়েছে সমাজ মাধ্যমকেই এড়িয়ে যাওয়া। বিভিন্ন সমাজ মাধ্যমে যে ঘটনা ঘটছে , তাকে বলা হয়, "Enshittification"। এনশিটিফিকেশন, বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়, যেখানে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা পরিষেবাগুলির মান ধীরে ধীরে কমে যায়। কারণ প্ল্যাটফর্মগুলির উদ্দেশ্য তখন কেবল মুনাফা বৃদ্ধি। এটি প্রায়শই ব্যবহারকারীদের চোখে প্ল্যাটফর্মটিকে খারাপ করে তোলে, কারণ- বিজ্ঞাপনের সংখ্যা বৃদ্ধি, ভালো পণ্যের বদলে সস্তা বিকল্প দেওয়া বা ব্যবহারকারীর ডেটা থেকে বেশি লাভ করার চেষ্টা করা। সহজভাবে বলতে গেলে, এটি হলো একটি পণ্যের বা পরিষেবার মানের অবনতি ঘটিয়ে ব্যবসায়িক লাভ বাড়ানোর একটি পদ্ধতি।

সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই AI জেনারেটেড ভিডিও
•'পোস্টিং জিরো'-র আরেকটি কারণ হলো, অনেকেই সমাজ মাধ্যম ব্যবহার করা ছাড়েনি কিন্তু সমাজ মাধ্যমে পোস্ট করা ছেড়ে দিয়েছে। অতএব তারা স্ক্রল করে, রিল দেখে, অন্যের পোস্ট দেখে কিন্তু নিজেরা কিছু পোস্ট করে না। কারণ, একটা না বুঝে ভুল পোস্ট, (বাকিদের চোখে) আর কমেন্ট বক্সে নিন্দার ঝড়। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, হামলা, বন্যা, আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্বেগজনক ঘটনা অনবরত ঘটেই চলেছে, সেই সময় নিজের একটি সেলফি পোস্ট অসংবেদনশীল হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষত জেন জি-দের কাছে। তাছাড়া, পোস্ট করেই বা কী হবে, বন্ধুদের কাছে তো পৌঁছবেই না।
•'জিরো পোস্টিং'-এর আরেকটি কারণ হলো, 'ডেড ইন্টারনেট থিওরি'। এর মতে, ইন্টারনেটের বেশিরভাগ কন্টেন্টই রক্তমাংসের মানুষের জায়গায় তৈরি করছে বট এবং AI।
কাইল চায়কা, তাঁর সাপ্তাহিক কলাম 'ইনফাইনাইট স্ক্রল'-এ বলছেন, একজন সাধারণ সমাজ মাধ্যম ব্যবহারকারীর প্রতিদিনের, সবসময়ের আপডেট পাওয়া, বর্তমানে দুর্লভ। এই কলামেই চায়কা লিখেছেন, একসময় তাঁর ফিড জুড়ে থাকত বন্ধুদের ব্রেকফাস্টের, ঘুরতে যাওয়ার, মজা করার বা পোষ্যের ছবি। আমরা সম্ভবত 'পোস্টিং জিরো'র দিকে এগোচ্ছি, এটি এমন এক পর্যায় যেখানে, সাধারণ মানুষ— যারা ইনফ্লুয়েন্সার বা ব্যবসায়ী নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট শেয়ার করা বন্ধ করে দেবে কারণ, তারা এই কোলাহল, ব্যক্তিগত তথ্য সর্বসমক্ষে প্রকাশে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। চায়কা তাঁর কলামে লিখেছেন, 'পোস্টিং জিরো'-র অর্থ, সোশ্যাল মিডিয়ার সেই যুগের শেষ যেখানে, সবাই বিশেষ সময় উপভোগ করে, তাকে রেকর্ড করে রাখতে, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের সামনে তুলে ধরবে।
আমরা কি আবার সমাজ মাধ্যমগুলিকে পুরনো রূপে ফিরে পাব?
২০০৯ সালে কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, 'সমাজ মাধ্যমে কেউ কেন পোস্ট করছে না?' একদিন গবেষণার বিষয় হবে এটি। এই প্ল্যাটফর্মগুলি মানুষের যোগাযোগস্থাপনে সুবিধের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে, ব্যবহারকারীরা এই সমাজ মাধ্যমগুলিতে সমাজের মানুষের উপস্থিতি অনুভব করতে পারছে না। তাই, আবার যদি বিজ্ঞাপন, AI, বটের ভিড় কমে রক্তমাংসের মানুষের পোস্টের আনাগোনা শুরু হয়, আবার যদি আগের মতো ইন্টারনেট বন্ধুদের 'মজার জায়গা' হয়ে উঠতে পারে, তাহলে হয়তো আবার ব্যবহারকারীরাও মজা করে সমাজ মাধ্যমে অংশ নেবে।

Whatsapp
