বিস্ফোরক মানেই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট? প্রশ্ন উঠছে দিল্লির ঘটনায়
ammonium nitrate: বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, দুই ঘটনার নেপথ্যে থাকা বিস্ফোরকই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে তৈরি বিস্ফোরক জ্বালানী তেল, যেটি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ফুয়েল অয়েল নামে বহুল পরিচিত।
সম্প্রতি দুটি বড় বিস্ফোরণের সাক্ষী থেকেছে দেশবাসী— প্রথমটি, ১০ই নভেম্বর দিল্লির লালকেল্লা চত্বরে, আর দ্বিতীয়টি তার কয়েকদিনের মাথায় শ্রীনগরের নওগাম থানায়। তবে দ্বিতীয়বার কোনো গাড়ি বোমা বা জঙ্গি হামলা ছিলনা; তদন্তকারী সংস্থা কর্তৃক উদ্ধারকৃত বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক জমা ছিল নওগাম থানায়, যেগুলি পরীক্ষা করতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি।
বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, দুই ঘটনার নেপথ্যে থাকা বিস্ফোরকই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে তৈরি বিস্ফোরক জ্বালানী তেল, যেটি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ফুয়েল অয়েল নামে বহুল পরিচিত। মূলত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ও পেট্রোলিয়াম সহযোগে তৈরি করা হয় এই মারণঘাতী অস্ত্র । পিইটিএন, সেমটেক্স এবং আরডিএক্স-এর মতো অন্যান্য শক্তিশালী বিস্ফোরকের সম্ভাবনার আশঙ্কা করা হলেও পরে জানা যায়, এদের পরিমাণ ছিল সামান্য।
কেন বারবার বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট?
এটি একটি সাদা কেলাসকার গুঁড়ো পদার্থ, যা সাধারণত ফসলের ফলন বাড়ানোর জন্য নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ সার হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। আপাত নিরীহ এই রাসায়নিক পদার্থটির যুতসই প্রয়োগ যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা সদ্য প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। বিস্ফোরণের সময় একটি শক্তিশালী শক ওয়েভ তৈরি হয় ,যার ফলে চারপাশের এলাকা কেঁপে ওঠে ও বিস্ফোরণ বিস্তার লাভ করে । এই কারণেই, খনি এবং নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত বিস্ফোরকগুলিতে এর বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়।
গঠনগত ভাবে, রাসায়নিক পদার্থটি, অ্যামোনিয়াম (NH4+) ও নাইট্রেট (NO3-) আয়ন দ্বারা গঠিত, যার জন্য সেটি দুর্দান্ত অক্সিডাইজার হিসেবে কাজ করে। সহজ করে বললে, বিক্রিয়ার সময় এটি ভালো অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে, দাউ দাউ করে জ্বলার জন্য আর কি লাগে! এমনিতে রসায়নগারে, নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটকে রাখলে, তা অন্যান্য বিস্ফোরকের তুলনায় স্থিতিশীল এবং নিরাপদ; কিন্তু তীব্র তাপ বা আলোড়নের সংস্পর্শে এলে এটি থেকে নির্গত গ্যাস বিস্ফোরণকে ত্বরান্বিত করে, সেসময় তরল জৈব যৌগ বা ডিটোনেটরের মতো সহজলব্ধ কোনো অগ্নিসংযোগকারী পদার্থ উপস্থিত থাকলে, বিস্ফোরণ আর ঠেকায় কে! এর অন্তর্নিহিত রসায়নটা খুলে বললে বুঝতে সুবিধে হবে।
আরও পড়ুন- বিস্ফোরণের পর কীভাবে কাজ করেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা?
উচ্চ তাপামত্রায় (প্রায় ৩০০° সেলসিয়াসের কাছাকাছি) অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে তৈরি হয় নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) এবং জলীয় বাষ্প (H2O)
NH4NO3 → N2O + 2 H2O
আরও উচ্চ তাপমাত্রায়, সেগুলি ভেঙে গিয়ে উৎপন্ন হয় নাইট্রোজেন (N2), অক্সিজেন (O2) ও জল (H2O)
2NH4NO3 → 2N2+ O2 + 4 H2O
এর পাশাপাশি, বিস্ফোরক বিক্রিয়ায়, অ্যামোনিয়া (NH3), নাইট্রিক অক্সাইড (NO) এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO2)-এর মতো অতিরিক্ত গ্যাসও নির্গত হতে পারে। বিস্ফোরণের সময় যে লালচে-বাদামী রঙের মেঘের দেখে আমরা আতঙ্কিত হই, তার জন্য দায়ী এই NO2; অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা এবং চাপে তাপীয় জারণ বিক্রিয়ার কারণে এই গ্যাসগুলি সৃষ্টি হয়। আপাত নিরীহ, স্থিতিশীল এই রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রলয় ক্ষমতার জন্য ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) তৈরিতে NH4NO3-এর যথেষ্ট কদর রয়েছে।
বিস্ফোরক তো আরও আছে , তবে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের প্রতি এত ঝোঁক কেন সন্ত্রাসবাদীদের?
এককথায় বললে, সহজে পাওয়া যায় বলে। ভারতের মতো কৃষিপ্রধান দেশে এর চাহিদা ব্যাপক, সেজন্য জোগানের ঘাটতিও বিশেষ নেই। মানুষজন সহজেই মজুত করে রাখতে পারে। আরডিএক্সের মতো অন্যান্য সামরিক মানের বিস্ফোরক পদার্থগুলি, যেমন সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ক্ষেত্রে সেরকম কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে সন্ত্রাসবাদীরা। এছাড়া, এটি প্রথমসারির বিস্ফোরকগুলির তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল হওয়ায় সাধারণ যানবাহনের মাধ্যমে পরিবহণ করা সম্ভব; ফলে অল্প অল্প পরিমাণ সংগ্রহ করেই আততায়ীরা বানাতে পারে বিশাল মারণ পাহাড়।
সাম্প্রতিক সময়ে, বারবার অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ব্যবহার দেশের নিরাপত্তার জন্য রীতিমতো শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত সরকার, ২০১২ সালে, বিস্ফোরক আইন এবং অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিধি প্রণয়ন করে, যা এর উৎপাদন ও বিপণন বিষয়ক গুচ্ছের বিধি আরোপ করে, যেমন বাধ্যতামূলক লাইসেন্স, জনবহুল জায়গায় মজুত করা যাবে না, অনেক উঁচু প্রাচীর দিয়ে লোকালয় থেকে দূরে জমা করতে হবে, সেখানে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা থাকতে হবে, আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম নির্দিষ্ট বন্দরে সীমাবদ্ধ থাকবে, খোলা অবস্থায় বিক্রি করা যাবে না, কেবলমাত্র প্যাকেট আকারেই বিক্রি হবে, ইত্যাদি। শুধু আইন প্রণয়ন করলে হবে না, তার যথাযথ বাস্তবায়নও জরুরি। মূলত, NH4NO3-এর দ্বৈত ব্যবহারের কারণে, এর সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। চলমান এই হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশাসনিক জায়গা থেকে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং সর্বোপরি জনসচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Whatsapp
