অনুষ্কা কী পরবেন! কে ঠিক করবেন?
Anushka Shankar freedom of dress: কেউ বলল, ‘আপনার পিতা শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত রবিশঙ্কর-কে এতটুকু শ্রদ্ধা করলে আপনি এসব জঘন্য জামাকাপড় পরা ছবি তুলে সকলকে দেখাতেন না।’
১৯৪৮ সালে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কল্পনা করতে গিয়ে জর্জ ওরওয়েল আশ্চর্য এক ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছিলেন।
—ডিস্টোপিয়ান পৃথিবী কি, ম্যাডাম?
আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ক্লাসরুমে। রাষ্ট্র-রাজনীতি, রাজতন্ত্র-গণতন্ত্র, রাজনৈতিক দর্শন, নাগরিক অধিকার— রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই প্রাথমিক বিষয়গুলি সম্পর্কে এই ছাত্র-ছাত্রীদের মনে খানিক ধারণা তৈরি করাই আমার উদ্দেশ্য। বললাম, ডিস্টোপিয়ান পৃথিবী মানে এক চরম দুঃস্বপ্নের পৃথিবী। ১৯৮৪ বইটিতে ওরওয়েল এমনই এক পৃথিবীর কল্পনা করেছিলেন। সেখানকার শাসক একনায়ক, রাজ্যের প্রত্যেক নাগরিকের উপর প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে তিনি নজরদারি চালান। যেমন তেমন নজরদারি নয়— একেবারে মানুষের মনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে নজরদারি।
—মনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে মানে কি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে, ম্যাডাম?
শেষ সারির চঞ্চল দৃষ্টির মেয়েটির প্রশ্নে খুশী হলাম। গল্প বলে পড়ানোর মজাই এই— সহজে পড়ুয়াদের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। বললাম, খুবই সাংঘাতিক এক পদ্ধতির মাধ্যমে। একে বলে ‘থট ক্রাইম’। ‘বিগ ব্রাদার’ নামের এই একনায়ক শাসকের একটি গোপন এবং বিশ্বস্ত পুলিশ দল আছে। তারা সাম্রাজ্যের সর্বত্র নিজেদের চর ছড়িয়ে রেখেছে। রাস্তাঘাটে তো বটেই, এমনকি জনগণের ঘরের ভেতরেও গুপ্ত ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, টেলিস্ক্রিন কিংবা দূরবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়ে রেখেছে। ফলে, বিগ ব্রাদারের বিরূদ্ধে বিপ্লব বা ষড়যন্ত্র তো দূর— যেই না কেউ তাঁর অপছন্দের বা অনুনমোদিত কিছু করবে, বলবে, এমনকি ভাববেও, অমনি তা শাসকের অতন্দ্র নজরদারির র্যাডারে ধরা পড়বে। আর পড়লেই, সেই ব্যক্তির আর জীবিত থাকার সম্ভাবনা নেই।
—মানে, সে দেশের সবকিছু বিগ ব্রাদার ঠিক করে দেয়? সব কিছু?
হ্যাঁ, নাগরিক জীবন থেকে ব্যক্তিগত জীবন পর্যন্ত জনগণের সবকিছু নির্ধারণ করে বিগ ব্রাদার। একে বলে টোটালিটেরিয়ান স্টেট; সর্বগ্রাসী রাজ্য। টোটালিটেরিয়ান স্টেটের ধারণাটা সহজে বোঝানোর জন্য একটা বাস্তব উদাহরণ দরকার। খানিক ভেবে বললাম, এই যেমন ধরো, আর কদিন বাদে পুজো। তোমরা সবাই নিজেরা পছন্দ মতো নতুন জামা কিনবে, ইচ্ছে মতো সেগুলো পরবে, সাজবে, আনন্দ করবে— এর কোনটাই কিন্তু বিগ ব্রাদারের রাজত্বে থাকলে সম্ভব নয়। সেখানে সকলকে একদম একইরকম কাটিং-এর নীল অথবা কালো রঙের ইউনিফর্ম পরতে হত। কারণ বিগ ব্রাদার সেখানকার নাগরিকদের জামাকাপড় নির্ধারণ করেছে তাদের পেশার ভিত্তিতে। দেশের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ পদগুলিতে যারা কাজ করে, সেই আভ্যন্তরীন পার্টির লোকজন পুরো কালো রঙের এক বিশেষ ধাঁচের পোশাক পরে; আর তার থেকে নিম্নপদস্থ কর্মচারীরা পরে নীল রঙের। বাকি সাধারণ মানুষরা আবার হাজার ইচ্ছে করলেও এই পোশাকগুলি পরতে পারত না। সাধারণভাবে, তাদের এমনই সাধারণ পোশাক পরতে হত, যাতে তা দেখেই তাদের সাধারণ নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে নজরদারির আওতায় আনা যায়।
আরও পড়ুন
“শ্মশানে কাজ! কেউ বিয়ে করবে না”, যেভাবে সমাজকে জবাব দিয়েছেন ‘ডোম’ টুম্পা দাস
এতদূর বলে থামলাম। আজকের মতো সময় শেষ। এবার এই ক্লাস থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা কী বুঝল, তার একটা লিখিত সারাংশ নিতে হবে তাদের থেকে। এর ভিত্তিতেই আমাদের আট সপ্তাহ ব্যাপী এই কোর্সের মূল্যায়ন হবে। করবে কলকাতার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যাদের হয়ে রঘুনাথপুরের এই কলেজে আমি পড়াতে এসেছি। এখান থেকে কলকাতা ফিরতে সময় লাগে প্রায় ছয় ঘণ্টা। আমার এই দীর্ঘ ট্রেন জার্নির সময়টুকু কাটানোর সবচেয়ে মনোজ্ঞ পন্থা হল ছাত্র-ছাত্রীর খাতা দেখা। কাজটাও এগিয়ে থাকে, সময়টাও ভালো কাটে। আদ্রা জংশন থেকে কলকাতা ফেরার ট্রেনে উঠে একটা লাল চা খেয়ে ইভালুয়েশন শিটগুলো নিয়ে গুছিয়ে বসলাম। আর প্রথম উত্তরটাই পড়েই চমকে উঠলাম। উত্তরটি লিখেছে— রঘুনাথপুর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান (অনার্স) প্রথম বর্ষের ছাত্রী অনিন্দিতা দাঁ। আমার বিশ্বাস, এই উত্তরপত্রটি পড়লে আমার মতো আপনারাও চমকে উঠবেন। তাই সেটি হুবহু এখানে তুলে দিচ্ছি।
অনিন্দিতা লিখেছে—
“ভেবে দেখলাম, ১৯৮৪ নামক গ্রন্থে জর্জ ওরওয়েল যে এক আশ্চর্য ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীর সন্ধান দিয়েছেন, আজ আমরা তার থেকেও ঢের বেশি আশ্চর্য পৃথিবীতে বাস করছি। হ্যাঁ, ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত হয় বলে খাতায়-কলমে আজ আমাদের কোনো একনায়ক নেই; বিগ ব্রাদারের মতো ক্যামেরা লাগিয়ে বা গুপ্তচর পাঠিয়ে কেউ সরাসরি আমাদের ওপর নজরদারি করে না। কিন্তু পরোক্ষ নজরদারি তো চলেই। নইলে আমাদের ব্যক্তিগত অনলাইন তথ্য, আমাদের সম্মতি ছাড়াই বাজারে ছড়িয়ে যায় কী করে? সেকালের বিগ ব্রাদারকে তাই আজকের নিরিখে আমার একজন ‘বোকা’ ও ‘নন-স্ট্র্যাটেজিক’ মানুষ বলেই মনে হয়। যিনি যেখানে যেটুকু নজরদারি করেছেন, সবাইকে জানিয়ে শুনিয়ে, বলে-কয়ে করেছেন। আজকের মতো এত সন্তর্পণে, এত সূক্ষভাবে নিজের কাজটি হাসিল করতে পারেননি।
আমার এও মনে হয় যে, ‘বিগ ব্রাদার’ কেবল একজন বোকা একনায়কই নন— একজন ব্যর্থ একনায়কও বটে। জনগণের উপর নজরদারির জন্য তিনি কত কাঠখড়ি না পুড়িয়েছেন। ‘ইনার পার্টি’, ‘আউটার পার্টি’ গড়েছেন, পার্টি মেম্বারদের জন্য ড্রেসকোড-সহ হাজার রেজিমেন্ট বানিয়েছেন। ইমানুয়েল গোল্ডস্টেইন নামক এক কাল্পনিক শত্রু নির্মাণ করে প্রতিদিন তার বিরুদ্ধেই জনগণকে দু-মিনিট ধরে গালাগালি দিয়ে— আপন মনের হতাশা আর ব্যর্থতার বিষোদ্গারে বাধ্য করেছেন। তবু এত কিছু করেও আদপে কিন্তু তিনি তার সাম্রাজ্যের মানুষের মনকে আজকের পৃথিবীর মানুষদের মতো বিষিয়ে তুলতে পারেননি।
কারণ আজ আমরা কোনো বিগ ব্রাদারের নির্দেশ ছাড়াই প্রত্যেকে প্রত্যেকের উপর স্বেচ্ছায় নজরদারি চালাই। আমরা কেউ কাউকে একনায়ক বলে দাগাই না, কারণ আমরা জানি যে আমরা প্রত্যেকেই একনায়ক। আমরা প্রত্যেকে একজন সফল একনায়কের মতোই নিজের ব্যক্তিগত ঔচিত্যবোধ এবং নৈতিক কম্পাসে নিত্য মেপে নিই— অন্যকে জোর করে তার উপর চাপিয়ে দিই নিজের গড়া ঠিক-ভুলের নির্মাণ। আর তারপর সমাজমাধ্যমের ভার্চুয়াল জগতে রোজ নিত্যনতুন টার্গেট খাড়া করে বসিয়ে দিই অদৃশ্য খাপ পঞ্চায়েত।
এই তো সেদিন— সেতার সম্রাজ্ঞী অনুষ্কা শঙ্কর সমুদ্রতটে নিজের বিকিনি পরিহিত ছবি ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করা মাত্রই নেটাগরিকরা অনলাইন এজলাস খুলে বসল। কেউ বলল, ‘আপনার পিতা শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত রবিশঙ্কর-কে এতটুকু শ্রদ্ধা করলে আপনি এসব জঘন্য জামাকাপড় পরা ছবি তুলে সকলকে দেখাতেন না।’ কেউ বলল, ‘এমন করে আপনার বক্ষবিভাজিকা সকলকে চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালেই কি নয়?’ অথবা বলল, ‘এগুলো পরলে ভারতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা একেবারে ধুলোয় মিশে যাবে।’ কিংবা বলল, ‘নিজেকে কি আপনি ফ্যাশন মডেল মনে করেন, যে গণপরিসরে এমন অর্ধনগ্ন ছবি শেয়ার করেন?’
আচ্ছা, ফ্যাশন মডেল বা ফিল্মস্টার হলেও কি তিনি আমাদের নজরদারি আর বিচারসভা থেকে মুক্তি পেতেন? পেতেন না। কারণ তখন তাঁকে বলা হত, ‘আপনি তো ভারতীয় মডেল। লজ্জা করে না এইসব পশ্চিমি পোশাক পরে ভারতীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে? যান, বেরিয়ে যান দেশ থেকে।’ ঠিক যেমনটা বলা হয়েছিল দীপিকা পাডুকোনকে; বছরখানেক আগের একটি বলিউড সিনেমায় বিকিনি পড়ার জন্য। অথবা উঠে আসত অন্য ধরনের ‘বডি শেমিং’: বলা হত, ‘ইস— কি নির্লজ্জ, বেহায়া। এত মোটা মোটা হাত নিয়ে এইসব জামাকাপড় পরতে একটুও লজ্জা লাগে না এদের’— যেমনটা বলা হয়েছিল স্বস্তিকা মুখার্জিকে; কয়েক মাস আগেই।
আরও পড়ুন
নারীবাদী শুনলেই বাঙালিদের মতোই আঁতকে ওঠে ফরাসিরা?
অনুষ্কা শঙ্কর থেকে দীপিকা পাডুকোন, স্বস্তিকা মুখার্জি থেকে আপনি, আমি— আমরা উইচ-হান্টিং করে আমরা নিজেরাই নিজেদের শত্রু, ইমানুয়েল গোল্ডস্টেইনকে খুঁজে বার করি প্রত্যেকদিন। স্বেচ্ছায় অবতীর্ণ হই অ্যাবিউজারের ভূমিকায়। ভুলে যাই, ভিক্টিম হওয়ার সময় আমারও পরে আছে। আসলে আজ কোনো অদৃশ্য শক্তি, অজানা কোনো পন্থায় নিত্য আমাদের মগজ ধোলাই করে— আমাদের বিগ ব্রাদার বানিয়ে তোলে। আমাদের গোটা মানসিক নির্মাণটাকে করায়ত্ত করে, তাকে ধর্মীয়, রাজনৈতিক আর জাতীয়তাবাদী মশলার নির্যাসে ধীরে ধীরে দমপোক্ত করে বদলে দেয় আপন উদ্দেশ্যে প্রণোদিত রাস্তায়।
আমরা বুঝেই উঠতে পারি না যে ঠিক কখন, কীভাবে অন্যের উপর সন্তর্পণে নজরদারি করছি; আমরা অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছি তার ব্যক্তিগত পরিসরে, শুনানি ডাকছি, বিচার করছি, শাস্তি শোনাচ্ছি নাগাড়ে। আর তারপর গুপী গাইন— বাঘা বাইনের সদা হাস্যমুখ জল্লাদের মতোই হাসতে হাসতে, নাচতে নাচতে সোশ্যাল মিডিয়ায় সর্বসমক্ষে তাঁর শিরশ্ছেদ করছি।
আমাদের হারিয়ে যাওয়া বিবেকবোধের সর্ববিছিন্ন সন্তর্পণ সারভেল্যান্স— বিগ ব্রাদারের থেকেও অনেক বেশি কৌশলী, অনেক বেশি সাশ্রয়ী আর অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। এক কথায় বলতে গেলে— ঢের, ঢের বেশি ডিস্টোপিয়ান। যা আমাদের কাউকে কোনদিন স্বাধীনতা দেবে না।”

Whatsapp
