জলপানেই কমবে মানসিক চাপ! নতুন গবেষণায় উঠে এল চমকে দেওয়া তথ্য

Mental Health: অনেক সময় আমরা খিদে অনুভব করি। কিন্তু সেইসময় আসলে আমাদের শরীরে জলের প্রয়োজন হয়। আর সেই খিদের অনুভূতি মেটাতে আমরা খাবার খাই। ফলে, শরীরে অপ্রয়োজনীয় ক্যালরি প্রবেশ করে এবং যা ওজন বাড়ার কারণ।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান না করলে কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বাড়তে পারে। যার ফলে দেখা দিতে পারে, হৃদরোগ, মানসিক অবসাদ, কিডনির সমস্যা, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী রোগের। কিন্তু, কীভাবে জলপান আমাদের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? আর এর থেকে মুক্তির উপায়ই বা কী?

২০২৫ সালের 'জার্নাল অব অ্যাপ্লায়েড ফিজিওলজি'-এর "Habitual fluid intake and hydration status influence cortisol reactivity to acute psychosocial stress" নামক একটি গবেষণা করা হয়। এই গবেষণায় কয়েকজন সুস্থ তরুণের উপর পরীক্ষা করা হয়। তাদের পানীয় গ্রহণের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে তাদের দুটি দলে ভাগ করা হয়। সাতদিন তারা তাদের স্বাভাবিক পানীয় গ্রহণের অভ্যাস বজায় রাখে এবং তারপর তাদের 'ট্রিয়ার সোশ্যাল স্ট্রেস টেস্ট' (TSST) নেওয়া হয়। এই পরীক্ষাটি গবেষণায় স্ট্রেসের প্রভাব নির্ণয়ের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য একটি পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়।

পরীক্ষার-নিরীক্ষা সেরে পর্যবেক্ষকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে, যাঁরা অভ্যাসবশত কম জল পান করেন, তাঁদের শরীরে কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বাড়ে। এবং তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে মানসিক এবং শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আরও পড়ুন- Climate Change: বিকল স্বাস্থ্য, ভয়ঙ্কর রোগের মুখে দেশ! যে আশঙ্কার কথা শোনাল ল্যান্সেটের রিপোর্ট

জলপানের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে এই গবেষণা করা হয় স্ট্রেস হরমোনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে। কিন্তু, জলপান নিয়ে কথা হলেই সঙ্গে সঙ্গে আসে ডিহাইড্রেশনের কথা। শরীরে অল্প জলের অভাব (১-২ শতাংশ কম) দেখা দিলেই তার সঙ্গে কমে আসে ব্যক্তির মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং বেড়ে যায় উদ্বেগ, ক্লান্তি। 'Water, Hydration and Health (2010)' এ বলা হয়েছে বোধশক্তি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য জল অপরিহার্য। 

'Hydration for health hypothesis: a narrative review (2020)' বলছে, পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান না করলে কিডনির সমস্যা, ওজন নিয়ন্ত্রণের সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিতে পারে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী রোগের। এই গবেষণাসমূহ বলছে হাইড্রেশন শুধুমাত্র ডিহাইড্রেশন এড়ানোর জন্য জরুরি নয়। পর্যাপ্ত জলপান মানসিক চাপমুক্তি, বিপাকীয় স্বাস্থ্য, মস্তিষ্ক এবং দীর্ঘায়ুর ক্ষেত্রে উপকারী।

কিন্তু সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝে জল পান করার কথা মনে থাকে না সকলের। আর তাই ভোগেন জলশূন্যতায়। এর থেকে মুক্তি পেতে, নিজস্ব একটি জলের বোতল সবসময় সঙ্গে রাখতে পারেন। মহিলাদের ক্ষেত্রে দৈনিক ২ লিটার এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ২.৫ লিটার জলপান জরুরি। সেই হিসেব রাখবে আপনার ওই জলের বোতল।

জলপান কী ভাবে মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে?

জল পান করার সময়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ঘুমিয়ে পড়লে আমাদের শরীর জল পায় না। অতএব, ঘুম থেকে উঠে শরীর জলশূন্য, নিস্তেজ থাকে। তাই, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর জল পান করলে শরীর তার কর্মশক্তি ফিরে পায়। এবং পর্যাপ্ত জলপান শরীরে কর্টিসলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তারপর দিনভর অল্প অল্প করে জল পান করতে থাকুন। একবারে খুব বেশি জল পান করার চেয়ে উপকারী কিছুক্ষণ পর পর, অল্প অল্প করে জল পান করা। খাওয়ার আধঘণ্টা আগে জলপান হজমে সাহায্য করে এবং খাবারের পুষ্টিগুণও ভালোভাবে শোষণ করতে পারে শরীর। এটি মানসিক চাপ কমাতেও সহায়ক। কিন্তু খাওয়ার সময় বা খাওয়ার মাঝে মাঝে জলপান শরীরে অ্যাসিডিটির সৃষ্টি করে। এর ফলে মানসিক চাপও বাড়ে। 

আরও পড়ুন-চিপস, বার্গার, পিৎজা! সন্তানকে রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন না তো? 

ঘুমোনোর আগে সামান্য পরিমাণে জল পান করা উপকারী। এতে শরীরে জলের মাত্রা বজায় থাকে এবং কর্টিসল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। কিন্তু, ঘুমোনোর আগে খুব বেশি পরিমাণে জল পান করলেও, তা মানসিক চাপ বাড়িয়ে তুলতে পারে। ঘুমোনোর আগে খুব বেশি জল পান করলে, প্রস্রাবের জন্য বার বার ঘুম ভাঙবে। ফলে, তা কর্টিসলকে অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়িয়ে মানসিক চাপের সৃষ্টি করবে। এবং ব্যায়ামের আগে ও পরে জলপান শরীরে জলের ঘাটতি পূরণ করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক সময় আমাদের শরীরে জলের ঘাটতি হলেও আমাদের তেষ্টা পায়না। কিন্তু, তাহলে আমরা বুঝব কী ভাবে, আমাদের শরীরে জলের প্রয়োজন। আমাদের শরীর বিভিন্নভাবে সেই ঘাটতির জানান দেয়। আমাদের প্রস্রাবের স্বাভাবিক রং হালকা হলুদ। রং গাঢ় হলুদ হলেই বুঝতে হবে, শরীর জলশূন্যতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকসময় ডিহাইড্রেশনের কারণে শরীরে ক্লান্তিভাবও দেখা দেয়।

কিন্তু শুধুমাত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে জলপান আমাদের মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেবে না। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হল, নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম, সঠিক ঘুম, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, যোগাভ্যাস, প্রিয় কোনও কাজ করা, দিনভর পর্যাপ্ত বিরতি নেওয়া ইত্যাদি।

এই প্রসঙ্গে ডায়েটিশিয়ান শম্পা ব্যানার্জি ইনস্ক্রিপ্টকে বলেন, "অনেক সময় আমরা খিদে অনুভব করি। কিন্তু সে'সময় আসলে আমাদের শরীরে জলের প্রয়োজন হয়। আর সেই খিদের অনুভূতি মেটাতে আমরা খাবার খাই। ফলে, শরীরে অপ্রয়োজনীয় ক্যালরি প্রবেশ করে এবং যা ওজন বাড়ার কারণ। আমাদের শরীরে যখন ডিহাইড্রেশন হয়, আমরা বুঝতে পারি না জলশূন্যতার কথা। তখন, অনেকসময় আমরা মিষ্টি খাই, কারণ সে'সময় মিষ্টিই সন্তুষ্টি দেয় তাড়াতাড়ি। কিন্তু তা 'সুগার লেভেল' বাড়িয়ে দেয় শরীরে। 'ক্যালরি ইনটেক' বেড়ে যায়। ফলে, জমে মেদ। জলের পরিবর্তে অনেকে সফ্ট ড্রিঙ্ক পান করেন। কিন্তু তাতে চিনি থাকে। অতএব তাতেও শরীরে চিনির মাত্রা বাড়ে। এবং ফল একই। সঙ্গে বাড়ে শরীরে জলের ঘাটতি। জলের বিকল্প হিসেবে আমরা ডাবের জল, বাটার মিল্ক (চিনি ছাড়া), লেবু জল পান করা যেতে পারে।"   

আরও পড়ুন- মিনারেল ওয়াটার নয়, বাজার ধরছে ‘কালো জল’! স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী এই পানীয়?

তিনি আরও বলেন, "মানবদেহের বেশিরভাগই জল। অতএব, জল কম পান করলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন হরমোন, উৎসেচক (enzyme)-এর উপর প্রভাব পড়ে। পর্যাপ্ত জল পান না করলে ত্বকের সমস্যা, চুলের সমস্যার পাশাপাশি পেটেরও বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় ত্বকের শুষ্কতা বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখে বুঝতে হবে জলশূন্যতার কথা।"

দিনে কমপক্ষে ১.৫ লিটার জল পান না করলে, তা দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা ইত্যাদির ঝুঁকি বাড়ায়। সঠিক সময়ে এবং পরিমাণে জলপান কর্টিসল নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু শুধুমাত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে জলপান কর্টিসল নিয়ন্ত্রণে রাখে না। তার জন্য সঠিক মাত্রায় খাবার, ঘুম ও মানসিক শান্তিরও প্রয়োজন হয়।

More Articles