মহাত্মা গান্ধীর ডায়েট: কতটা বিজ্ঞানসম্মত?

Mahatma Gandhi's Diet: খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে ব্যক্তির মূল্যবোধের ছায়া থাকে। এটাই গান্ধীজির বিশ্বাস। প্রাণীজ খাদ্যের চেয়ে উদ্ভিদজাত খাদ্যাভ্যাসে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনে যেসব ব্যক্তিত্বের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য তার মধ্যে অন্যতম নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। গান্ধীজির নামের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে অহিংসা। খাদ্যাভ্যাসেও অহিংসাকে গুরুত্ব দিতে ভোলেননি তিনি। বাপুজির ডায়েট জুড়ে কেবলই নিরামিষ খাবার। খাবারে কম নুন-চিনি, কাঁচা বা অল্প রান্না করা খাবার, স্বল্পাহার, মাঝে মধ্যেই উপবাস এসবই তাঁর খাদ্যাভ্যাসের বিশেষত্ব। কিন্তু আজকের দিনে এই ডায়েটের গুরুত্ব ঠিক কতটা? এই খাদ্যাভ্যাস কি শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি সরবরাহ করে? 

মহাত্মা গান্ধী গুজরাতে জন্মগ্রহণ করেন। এই রাজ্যে বেশিরভাগ হিন্দু পরিবারই নিরামিষভোজী। গান্ধী পরিবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাই তাঁর নিরামিষ ভোজনের ধারণা আসে পরিবার থেকেই। তিনি তাঁর ডায়েট নিয়ে বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। উপবাস, নিরামিষ ভোজন, খাবারে কম নুন-চিনি-মশলা, কাঁচা শাক-সব্জি, ফল খাওয়া, দুগ্ধজাত খাদ্য বর্জন ইত্যাদি। এবং তার ফলাফল তিনি লিখেছেন তাঁর 'ডায়েট অ্যান্ড ডায়েট রিফর্ম ', হরিজন পত্রিকার বিভিন্ন লেখায়। 

গান্ধীর খাদ্যাভ্যাস তাঁর অহিংসা এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রতিফলন। এই খাদ্যাভ্যাসের অনেকটা জুড়ে ছিল আত্মনির্ভরতা, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা। এই সুখাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার পেছনে তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল দেশবাসীর মধ্যে এমন এক নিয়মানুবর্তীত খাদ্যাভ্যাস তৈরি করা যা তাদের স্বাস্থ্য, শৃঙ্খলাবোধের সঙ্গে সঙ্গে দেবে স্বাধীনতাবোধও। গান্ধীজি তাঁর ‘Diet and Diet reform’ বইটিতে লিখেছেন, ‘খাবার হলো ওষুধের মতো। ভোগের জন্য নয় বরং শরীর টিকিয়ে রাখার জন্যই খাবারের প্রয়োজন।' তাই তাঁর খাবারে অতিরিক্ত তেল, মশলা, নুন, চিনি সবই ছিল বাদের খাতায়। এমনকি তিনি কাঁচা বা অল্প রান্না করা খাবারের প্রতিই বেশি আসক্ত ছিলেন। 

আরও পড়ুন- গ্রেট খালি-র গ্রেট ডায়েট! সারাদিনে কী কী খান এই বিশ্বখ্যাত কুস্তিগির, জানলে আশ্চর্য হবেন

গান্ধীজি দিনে মাত্র তিনবার খাবার খেতেন। মাঝে কোনও জলখাবার নয়। 'কী টু হেল্থ' বইতে তিনি খাদ্যশস্য, শাক-সব্জি, ফল, অল্প পরিমাণে দুধ ও ঘি খাওয়ার ওপরই জোর দিয়েছেন। স্থানীয় অর্থাৎ নিজেদের মাটিতে উৎপাদিত শস্য গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করতেন তিনি। বই হোক কিংবা ভাষণ তিনি বারবার বলতেন, শুধুমাত্র শরীরের প্রয়োজন মেটাতেই খাবারের প্রয়োজন। উপবাসের উপর ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। তাঁর মতে, উপবাস রাজনৈতিক অস্ত্রের পাশাপাশি শরীর ও মন শুদ্ধিরও উপায়। বর্তমানের 'ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং' এরই আধুনিক রূপায়ণ মাত্র।  

mahatama gandhi diet

বর্তমানে গান্ধীজির ডায়েট ঠিক কতটা উপযোগী?

প্যাকেটজাত খাবারের নেশায় আজকের প্রজন্ম ভুগছে অতিকায়ত্ব, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে। তাই চিকিৎসকরা নুন-চিনি এবং প্যাকেটজাত খাবার এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শই দিচ্ছেন।

বর্তমানে মিলেটের পুনরুজ্জীবন থেকে শুরু করে 'ফার্ম টু ফর্ক', সীমিত পরিমাণে সাধারণ আহার থেকে শুরু করে শাক-সব্জি, ফল বা অল্প রান্না করা খাবার, এ'সময়ের ডায়েটিশিয়ানদের পরামর্শ ও বাপুজির উপদেশ দুই-ই অভিন্ন। 

বর্তমান গবেষণায় প্রমাণিত, সঠিকভাবে উপবাস দীর্ঘায়ু লাভে সাহায্য করে। সঙ্গে শরীরের বিপাক ও অন্ত্রের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতেও সহায়তা করে।

খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে ব্যক্তির মূল্যবোধের ছায়া থাকে। এটাই গান্ধীজির বিশ্বাস। প্রাণীজ খাদ্যের চেয়ে উদ্ভিদজাত খাদ্যাভ্যাসে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি। আজকের দিনেও বিশ্বজুড়ে আলোচ্য এই নিরামিষ বা উদ্ভিদজাত ডায়েট।

আরও পড়ুন- ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণ থেকে চামড়ার জটিল রোগ নিরাময়, সস্তার জামের গুণ জানলে জুড়বেনই ডায়েটে

অতএব, সাধারণ, সরল, নিরামিষ, স্থানীয় খাদ্য সংযমের সঙ্গে গ্রহণ এবং মাঝে মধ্যে উপবাস, এই হল গান্ধী-উপদেশ। গান্ধীজির উনিশ শতকের ডায়েট বর্তমানে একবিংশ শতকের ডায়েটিশিয়ানদের পরামর্শ। 

কিন্তু, তাঁর ডায়েট মেনে চলার কথা উঠলেই আমাদের মনে এই প্রশ্ন আসে যে, নিরামিষ ডায়েট কি আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রোটিনের যোগান দেয়? 

Mahatma Gandhi Diet

এই প্রশ্নের উত্তরে ডায়েটিশিয়ান শম্পা ব্যানার্জি ইনস্ক্রিপ্টকে জানিয়েছেন, "নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস নিঃসন্দেহে ভীষণ ভালো। কিন্তু এই ডায়েটে সম্পূর্ণ পুষ্টি পাওয়া একটু জটিল।" সঙ্গে তিনি এটাও জানান, "বাজারে প্রোটিনের উৎস হিসেবে বিভিন্ন প্যাকেটজাত দ্রব্য পাওয়া যায়। সেগুলি শরীরে ইনফ্ল্যামেশনের সৃষ্টি করে। ফলে, বেড়ে যায় ডায়াবেটিস, হৃদরোগের সম্ভাবনা। মহাত্মা গান্ধীর ডায়েট মেনে চললে বর্তমানের ক্রমবর্ধমান এই সমস্যাগুলি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু তাঁর ডায়েটের সমস্যা একটাই। কাঁচা শাক-সব্জি ও ফলে ভরপুর পরিমাণে ভিটামিন পাওয়া গেলেও সম্পূর্ণ প্রোটিন পাওয়া যায়না। অ্যামিনো অ্যাসিডের ঘাটতি থেকে যায় শরীরে। এই অভাব মেটাতে দই এবং বিভিন্ন ধরণের ডাল ডায়েটে রাখা প্রয়োজন।"

ডায়েটিশিয়ান শম্পা ব্যানার্জির পরামর্শ, সপ্তাহে অন্তত ২ দিন আমাদের মা-ঠাকুমাদের মতো 'নিরামিষ দিন' রাখা উচিত। তাহলে সেই দিনগুলি শরীর একটু বিশ্রাম নিয়ে 'ডিটক্স' করতে পারবে। একটু বুদ্ধি করে নিরামিষ দিনগুলিতে ভাতের সঙ্গে দই বা ২ রকমের ডাল এবং ডালের সঙ্গে পেঁপে অথবা খিচুড়ি রাখা যেতে পারে পাতে। এইভাবে শরীরকে সম্পূর্ণ পুষ্টির যোগান দিয়েও ওবেসিটি, PCOD-এর মতো বিভিন্ন সমস্যা থেকে দূরে রাখা সম্ভব। 

More Articles