শহরে মাদকের রমরমা? কেন আচমকা বন্ধ করা হল কলকাতার হুকা বারগুলি

Hookah bar ban in Kolkata: সম্প্রতি শহরে হুকা বার বন্ধের কথা ঘোষণা করেন কলকাতার মেয়র। কী কারণে বন্ধ হচ্ছে এই বারগুলি?

ডিসেম্বর মানে শীতের আমেজ, ক্রিসমাস আর বর্ষশেষের পার্টি আর পার্ক স্ট্রিটে ভিড়। তবে এবছর সেই আমেজের আগেই বড়সড় ঘোষণা করল কলকাতা পুরসভা। ২ ডিসেম্বর কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিম সাংবাদিক বৈঠক করে শহরের সমস্ত হুকা বার বন্ধের নির্দেশ দেন। তিনি জানান, শহরের সমস্ত রেস্তোরাঁ ও বারকে হুকা বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। যাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, সেসব বাতিল করা হচ্ছে। এরপরও রেস্তোরাঁ, হোটেলগুলি যদি গোপনে হুকা বার চালায়, তাহলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খোদ মেয়রের এমন নির্দেশের পরই শহরজুড়ে অভিযান চালায় কলকাতা পুলিস ও লালবাজারের অ্যান্টি রাউডি স্কোয়াড। বেআইনিভাবে হুকা বিক্রির অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। জানা গিয়েছে, মূলত অভিজাত এলাকা থেকেই এদের পাকড়াও করা হয়েছে।

কথায় বলে, কলকাতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে আরেকটি কলকাতা। অবশ্য একটি নয়, খুঁজে দেখলে অনেকগুলো কলকাতাকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। যেখানে আছে নস্টালজিয়া, সিনেমা, সাহিত্য, আর্থিক সামাজিক বৈষম্য, রয়েছে ক্রমবর্ধমান হাইরাইজ। সেই শহরেরই এক কোণে লুকিয়ে আছে নৈশযাপন, রয়েছে পার্ক স্ট্রিট। পাব, বার, হুকার মিলমিশে এ যেন একদম অন্য কলকাতা। ‘তিন টানেতে রাজা উজির, চার টানেতে সুখী’ হওয়ার সমস্ত উপকরণই এখানে মজুত। পার্ক স্ট্রিটের অভিজাত রাস্তায় হাঁটলে দেখা যাবে সার দেওয়া হুকা। যেখানে জেগে ওঠে কলকাতার অন্য একটি দিক। সেই দিকের একটা অংশে লুকিয়ে আছে এক টুকরো অন্ধকার…

আরও পড়ুন : কোকে কোকেন ফেরাব, বলছেন এলন মাস্ক || সত্যিই কি ঠান্ডা পানীয়ে মিশত ভয়ানক মাদক?

হঠাৎ কেন হুকা বারগুলিতে হানা দিল শহরের পুলিস? কেন নিষেধাজ্ঞা নেমে এল? উত্তর আসবে একটি শব্দে – মাদক। হ্যাঁ, মাদকের নেশা বন্ধ করতেই রাতারাতি এমন পদক্ষেপ প্রশাসনের। পুলিসের কর্তারা বলছেন, সাধারণ মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণা, নিষিদ্ধ মাদকের সন্ধান পেতে সবসময় চোরাগলি, আড়াল আবডাল, কিংবা পাড়ার ‘কুখ্যাত’ তল্লাটে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় ‘যোগান’। কিন্তু শহরের অভিজাত বারে, যেখানে ঝাঁ চকচকে আলো, টাকা আর সুন্দর মিউজিকের সমারোহ, সেখানেও খোঁজ করলে যে ‘আসল জিনিসটি’ চলে আসবে সঠিক সময়ে, সেটা সবাই জানে না। ঠিক কোথায় গেলে পছন্দের মাদক পাওয়া যাবে, তা ঠিকই জানতে পারে নেশাড়ুরা। মাদক ব্যবসায়ীরাও গোপনে সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। পুলিস বলছে, এবার হুকা বারগুলিতে চলছে সেই মাদকের ফোয়ারা।

গাঁজা থেকে শুরু করে কোকেন, এলএসডি এমনকী মেথ – কলকাতার মাদক আবহের ঠেক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই হুকা বারগুলি। প্রকাশ্যে, আড়ালে আবডালে চলে আসল ‘কারবার’। কেবল পার্ক স্ট্রিট বললে ভুল হবে। সম্প্রতি শহর জুড়ে হুকা বারগুলির দিকে নজর রেখেছিল পুলিস। মূল উপলক্ষ্য ছিল মাদকের হদিশ পাওয়া। সেই সময়ই বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। সেখান থেকেই মেলে মাদকযোগের প্রমাণ। পুলিস এও জানায়, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ঠেকের ভিড়ও পাল্লা দিয়ে বাড়ে।

আরও পড়ুন : মাদকচক্রের জাল ঠিক কতটা গভীরে? বিজেপি নেত্রী সোনালী ফোগাতের রহস‍্যমৃত‍্যুতে যে ইঙ্গিত লুকিয়ে

এই ভিড় কাদের? আট থেকে আশি – প্রত্যেকেরই আনাগোনা লেগে থাকে বারে। হুকা বারেও মোটামুটি সব বয়সের মানুষই আসেন। তবে পানশালার কর্তাদের বক্তব্য, মূলত অল্পবয়সিদের মধ্যে হুকার জনপ্রিয়তা প্রবল। যুবক যুবতীরাই নন, অনেক সময় এর থেকেও কম বয়সি ছেলেমেয়েরাও হুকা বারে যাতায়াত করছে। উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েদের এমন আনাগোনা চিন্তায় রেখেছে পুলিসকেও। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের এই চক্র থেকে বের করার জন্য বারবার মাদকবিরোধী প্রচারও করা হয়েছে পুলিস প্রশাসনের পক্ষ থেকে। কিন্তু অবস্থা যে বদলায়নি, তা স্বীকার করছে পুলিস। এদিকে মাদক পাওয়ার জন্য চাই টাকাও। সেটা জোগাড় করতে গিয়ে অসৎ পন্থার অবলম্বনও করছে যুবসমাজ। বিগত কয়েক বছরে এমন অসংখ্য অভিযোগে নাজেহাল প্রশাসন। সেইসঙ্গে এসে মিশেছে হুকার ধোঁয়া। সেখানে হুকার মশ্লার সঙ্গেই মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাদক, এমন অভিযোগও পুলিসের কাছে এসেছে বলে জানা গিয়েছে।

করোনা পরবর্তী সময় তাই আরও কড়া মনোভাব নিয়েছে পুলিস। পাঠকদের মনে পড়বে, গত বছর জুলাইয়ে পার্ক হোটেলে গভীর রাত অবধি দেদার উল্লাস, পার্টি হওয়ায় পুলিসি অভিযান হয়। সাময়িকভাবে বন্ধ হয় পার্ক হোটেল। তারপরই সমস্ত বার, হোটেল, রেস্তোরাঁয় কড়া নজর রাখে পুলিস। এরই ফলস্বরূপ কলকাতা পুরসভার এমন সিদ্ধান্ত। মূলত মাদক রোধের জন্যই এই ব্যবস্থা বলে জানিয়েছেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম।

আরও পড়ুন : স্ট্রিপ ক্লাবের সাফল্য পেতে করিয়েছেন খুনও, এই ব্যক্তির কাহিনি জানলে চমকে উঠবেনই

অবশ্য আরও কিছু কারণের কথা জানিয়েছেন তিনি। বিগত কয়েক বছরে শহরের বুকে হুকা বারের সংখ্যা বেড়েছে। এই বিশেষ বারের জন্য খোলামেলা পরিবেশ দরকার। নয়তো ধোঁয়ায় ঢেকে দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে যত দিন গিয়েছে, হুকা বারের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। যুবসমাজও ভিড় করেছে এসব বারে। ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো নিত্য নতুন হুকা বার গজিয়ে উঠছে। সব জায়গায় পরিকাঠামোও ঠিকঠাক মেনে চলা হচ্ছে না। ফলে যারা বারে, হোটেলে গিয়ে হুকা খান না, তাঁরা সমস্যায় পড়ছেন। এই সংক্রান্ত অভিযোগও জমা পড়েছে প্রশাসনের কাছে।

এছাড়াও কলকাতায় হুকা বারগুলির লাইসেন্সিং সিস্টেমও নেই। সেই কথা মেনেও নিয়েছেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। লাইসেন্স না থাকার ফলে লাগাতার চেকিং করা যায় না। অন্যান্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত বারে যে সুযোগটা পাওয়া যায়। এই সুযোগেই মাদকের ব্যবহার হুকা বারগুলিতে আরও বাড়ছে বলে মনে করছে পুলিস প্রশাসন। সব মিলিয়ে শহরের নেশার রশিতে লাগাম পরানোর জন্যই এমন ব্যবস্থা বলে জানিয়েছেন মেয়র। এদিকে এমন সিদ্ধান্তে খুশি চিকিৎসক মহল। যুবসমাজের মধ্যে মাদক ব্যবহার বন্ধের দিকে একটি ধাপ অগ্রসর হওয়া বলে মনে করছেন তাঁরা। আদৌ কি এই উদ্যোগে বন্ধ হবে নেশাযাপন? উত্তর খুঁজছে তিলোত্তমা।

More Articles