২৬ জানুয়ারিকেই কেন প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে বাছা হল? যে ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে এর পেছনে

Republic Day of India 26 January : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ২৬ জানুয়ারির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাকে অমর রাখতেই এই সিদ্ধান্ত।

আরও একটা নতুন বছর, আরও একটা ২৬ জানুয়ারি। গোটা ভারত জুড়ে উদযাপন করা হচ্ছে প্রজাতন্ত্র দিবস। ১৯৫০ সালে এই দিনটিতেই ভারত এক সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশজুড়ে প্রথমবার লাগু হয় সংবিধান। ভোটাধিকার, মৌলিক অধিকার, দেশের নাগরিক হিসেবে সবার কর্তব্য উঠে আসে বিশ্বের সামনে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ হওয়ার পর ’৫০-র ২৬ জানুয়ারিই সবচেয়ে বড় মাইলস্টোন। ভারত নামের দেশের মেরুদণ্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সংবিধান, আইন।

তারপর পেরিয়ে গিয়েছে অনেকগুলি বছর। আরও অজস্র বছর পেরিয়ে যাবে, নদী দিয়ে গড়িয়ে যাবে জল। কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবসের মাহাত্ম্য কখনও ফিকে হবে না। সেই স্পর্ধা কারোর নেই। কেবল দিল্লির কুচকাওয়াজ, কিংবা পদ্ম পুরস্কার নয়, এই দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এরকম প্রশ্ন আসতেই পারে, এত দিন থাকতে ২৬ জানুয়ারিকেই কেন প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হল? এই বিশেষ দিনটির পেছনে কারণ কী? খুব সঙ্গত প্রশ্ন। আসলে এই ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে হঠাৎ বেছে নেওয়া হয়নি। বি আর আম্বেদকররা যথেষ্ট ভেবেচিন্তেই এই দিনটিকে সংবিধান প্রণয়নের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। কারণ? ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ২৬ জানুয়ারির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাকে অমর রাখতেই এই সিদ্ধান্ত।

আরও পড়ুন : বিশ্বের ৫ কোটি মানুষকে বাঁচিয়েছে নুন-চিনি জল! মরণোত্তর পদ্মবিভূষণে সম্মানিত দিলীপ মহলানবিশ

কী সেই বিশেষ ঘটনা? সেই কথায় আসতে গেলে ফিরে যেতে হবে আরও কয়েক বছর পেছনে। ১৯২০-র দশকে ইংরেজ শাসনাধীন ভারত দেখেছিল অসহযোগ আন্দোলন। দেখেছিল জাতীয় কংগ্রেস ও মহাত্মা গান্ধীর উত্থান। ‘অহিংস আন্দোলন’ কথাটি সেই সময় থেকে আরও প্রকট হয়। কিন্তু ১৯২২ সালের চৌরিচৌরার হিংসার ঘটনায় ব্যথিত হয়ে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন রদ করেন। কিন্তু ২০-র সেই দশক থেকেই একটু একটু করে স্বাধীনতা আন্দোলনের মানচিত্রে উঠে আসতে থাকেন একের পর এক চরিত্র। মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহরুর পাশাপাশি সামনে আসেন বিপ্লবী ভগত সিং, চন্দ্রশেখর আজাদরাও। সামনে আসেন সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুর মতো তরুণরাও।

২০-র এই দশকেই কংগ্রেসের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ রিপোর্ট ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করা হয়। যে রিপোর্ট কমিটির পৌরোহিত্য করেন মতিলাল নেহরু। ‘নেহরু রিপোর্ট’ অনুযায়ী গান্ধীরা বলেন, ভারতকে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস দিতে হবে। এটি পাওয়া মানে, ভারত নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারবে। কিন্তু মাথার ওপর ব্রিটিশ রাজ পরিবার থাকবে। তাদের জানিয়েই সব কাজ করতে হবে। এটি কখনই পূর্ণ স্বাধীনতা নয়। কানাডা বা অস্ট্রেলিয়া এই ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের অন্তর্ভুক্ত।

কিন্তু এই রিপোর্ট অনেকেই মেনে নিতে পারলেন না। তাঁদের বক্তব্য, এভাবে কারোর অধীনে একটি দেশ থাকতে পারে না। এটাকে স্বাধীনতা বলে না। কেবল চরমপন্থী বিপ্লবীরাই নন, কংগ্রেসের তরুণ সদস্যরাও এর বিরোধিতা করেন। যাঁদের মধ্যে ছিলেন সুভাষচদ্র বসু, জওহরলাল নেহরুও। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীরা এর পক্ষপাতী ছিলেন। সমস্ত পরিস্থিতি বদলে গেল বিশ দশকের শেষ পর্যায়ে।

আরও পড়ুন : বয়স ১০২! বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন সারিন্দা শিল্পীকে পদ্মশ্রী সম্মান দেশের

১৯২৯ সালে ভাইসরয় লর্ড আরউইন জানালেন, তিনি ভারতকে ডোমিনিয়নশিপ দিতে প্রস্তুত। এই ঘোষণায় বেঁকে বসল ইংল্যান্ড। কেন? কারণ, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কাছে ভারত তখনও ‘সোনার রাজহাঁস’। দেশের সম্পত্তি লুঠ করেই তাদের কোষাগার ভরছে। এত সম্পত্তি, এত জমি, এত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য – একে এত সহজে ছাড়া যায় নাকি! তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে অবশেষে নিজের জায়গা থেকে সরলেন ভাইসরয় আরউইন। গান্ধী, জিন্নাহ সহ অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে পরিষ্কার বলে দিলেন, ভারতকে ডোমিনিয়নশিপ দেওয়া যাবে না।

কথা দিয়ে কথা না রাখা! এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা! এই স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠারই অপেক্ষা ছিল। চাই না ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস, বদলে চাই পূর্ণ স্বাধীনতা। ১৯২৯ সালের কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে পাস হল বিখ্যাত ‘পূর্ণ স্বরাজ’-এর সিদ্ধান্ত। এবারের লড়াই হবে পূর্ণ স্বাধীনতার লড়াই। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি। ‘পূর্ণ স্বরাজ’-এর দাবি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সবাই দেশবাসীকে আহ্বান জানালেন, ২৬ জানুয়ারি দিনটিকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা হোক। সবাই ঘরের বাইরে আসুন, দেশের পতাকা উত্তোলন করুন।

আরও পড়ুন : নেতাজির প্রিয় বাহন! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়ে আশি বছরের ফোর্ড জিপ এখন কলকাতার বাসিন্দা

১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪৭ – এই ১৭ টি বছর ধরে ২৬ জানুয়ারি দিনটিকেই ‘পূর্ণ স্বরাজ’ বা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়েছে। ১৫ আগস্ট আসসল স্বাধীনতা পাওয়ার পর সেটা বদলে গিয়েছে। কিন্তু ২৬ জানুয়ারি তো নিজের গুরুত্ব হারায়নি। তাই এই দিনটিকে স্মরণীয় রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নেন বি আর আম্বেদকররা। ঠিক হয়, ২৬ জানুয়ারিতেই সংবিধান লাগু হবে। প্রজাতন্ত্র দিবসের সূচনা হবে। সেই ইতিহাস আজও চলছে।

More Articles