নেতাজির প্রিয় বাহন! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়ে আশি বছরের ফোর্ড জিপ এখন কলকাতার বাসিন্দা
Hawagarir Rupkotha: আশি বছরের যুবক ফোর্ড জিপিডবলিউ কলকাতার এ-গলি ও-গলি দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে নিজ মহিমায়, নিজস্ব ছন্দে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে বসেছেন এক আমেরিকান কর্নেল। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধ। কর্নেল বলে চলেছেন, কীভাবে আক্রমণ শানাতে হবে জাপানিদের বিরুদ্ধে। সেনারা মন দিয়ে কর্নেলের কথা শুনছেন। তাঁর বলা প্রায় শেষের দিকে কর্নেল ঘোষণা করলেন ‘If you kill a Jap, I will give you a Jeep.' প্রবল করতালির মধ্যে কর্নেল বক্তব্য শেষ করলেন।
কয়েকদিন পরে কর্নেল একটি রিভিউ মিটিং করলেন। কেমনভাবে জাপানি সৈন্যদের তারা মেরেছে, তিনি সেই বর্ণনা শুনতে চান। সৈন্যদের বলা শেষ হলে তিনি বললেন, তোমরা যথার্থ দেশপ্রেমিকদের কাজ করেছ, যাও একটা করে জিপ নিয়ে যে যার ক্যাম্পে ফিরে যাও। কর্নেল জানলা দিয়ে দেখছেন, প্রতিটি সেনা একটি ফোর্ড জিপিডবলিউ জিপের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে যারা উৎসাহের সঙ্গে নিজেদের বীরত্বের কথা শোনাল, তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কেন? তিনি গিয়ে সৈন্যদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা নতুন একটা জিপ পেয়ে খুশি নও? সৈন্যরা চুপ করে আছে দেখে কর্নেল সাহেব তাদের সাহস জুগিয়ে বললেন, তোমরা নির্ভয়ে তোমাদের মনের কথা বলতে পারো। একটি সৈনিক বলল, আসলে এটা তো একটা গাড়ি, ওরা ভেবেছিল প্রত্যেকে একজন জাপানি মেয়ে পাবে, কারণ ওদের মনে হয়েছিল জিপ জাপের স্ত্রীলিঙ্গ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা উঠে-পড়ে লেগেছিল জিপ গাড়ি তৈরি করতে। এমন একটি গাড়ি, যেটি অনায়াসে কামান টেনে নিয়ে যাবে; যে-কোনও রাস্তায় চলতে পারবে, এমনকী, জলেও চলবে। হেলিকপ্টারে এয়ার ড্রপিং করলেও গাড়িগুলো ভাঙবে না।
আরও পড়ুন: জেনে অবাক হয়েছিল ইউরোপের কর্তারা! কলকাতাতে রয়েছে এশিয়ার একমাত্র মার্সিডিজ ১৩০ এইচ
তিনটি কোম্পানিকে বরাত দেওয়া হলো এই বিশেষ ধরনের গাড়ি তৈরির– ফোর্ড, উইলিস ওভারল্যান্ড আর ব্যান্টাম। ব্যান্টাম জানিয়ে দিল, তারা এই দৌড়ে নেই। ফোর্ড আর উইলিস ওভারল্যান্ড জিপ বানাতে লাগল। জিপের বৈশিষ্ট্য হলো, বরফে ঢাকা রাস্তা দিয়েও অনায়াসে এই গাড়ি চলতে পারে। আমেরিকার হোলাবার্ডে জিপের পরীক্ষা করা হলো। উপস্থিত ছিলেন আমেরিকার নামকরা জেনারেলরা। গাড়ি দেখতে ছোট, একেবারে সাদামাটা- কিন্তু দুরন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন। হেলিকপ্টার থেকে প্যারাস্যুট দিয়ে জিপকে মাটিতে ফেলা হলো। দেখা গেল, তাতেও তার কোনও ক্ষতি হচ্ছে না, মাটিতে পড়েই সে ছুটতে লাগল শত্রুনিধনে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বময় কর্তা নেতাজি সুভাষচন্দ্র এই গাড়ি চড়েছেন এবং বিভিন্ন দুরূহ জায়গায় যাবার জন্য জিপ জিপিডবলিউ ছিল তাঁর একমাত্র বাহন।
১৯৪৫ সালে হঠাৎই বিশ্বযুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য দেশ-সহ ভারতের বিভিন্ন বন্দরে হাজার হাজার ফোর্ড জিপ দাঁড়িয়ে আছে। ক্রেতা কম, কারণ কারও হাতে পয়সা নেই। গ্রামের দিকে বহু জমিদার ফোর্ড জিপ কিনলেন নিজেদের কাজে ব্যবহার করার জন্য আর শিকারে যাওয়ার জন্য। এই জিপ গাড়িতে বেলচা, কোদাল রাখার ব্যবস্থা ছিল। বন্দুক রাখার স্ট্যান্ড লাগানো আছে আর ট্রেলারটি লাগালে অনায়াসে কামান টেনে নিয়ে যেতে পারে। ন্যারো গেজ রেললাইনের ওপর জিপ গাড়িটিকে তুলে চারটি চাকা ফাটিয়ে দিয়ে, ইঞ্জিনের সাহায্যে এগুলিকে মালগাড়ির ওয়াগন হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
যুবক রবি খেদওয়ালের স্বপ্ন ছিল, বিশ্বযুদ্ধের একটি জিপ যদি সংগ্রহ করা যায়। এই গাড়ি জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব, কারণ বিশ্বযুদ্ধের পর যাঁরা এই গাড়ি কিনেছিলেন, সেগুলো আর অবশিষ্ট নেই। ১৯৯১-'৯২-এ একজন খবর দিলেন, পুরুলিয়াতে একটি চার্চে এই গাড়ি পড়ে আছে। ছোট ছোট পুরুলিয়া। রবি এবং তার দাদা গিয়ে চার্চের ইন-চার্জের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের ইচ্ছার কথা জানালেন, যদি কর্তৃপক্ষ গাড়িটি বিক্রি করতে রাজি থাকে, তবে কলকাতার দুই যুবক জিপটি কিনতে আগ্রহী। পুরুলিয়া চার্চের পাদ্রি বললেন, এই প্রস্তাব তাঁর পক্ষে মানা অসম্ভব, কারণ গাড়িটি চার্চের সম্পত্তি এবং তা বিক্রি করতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন। তবে ইচ্ছে করলে রবিবাবু গাড়িটিকে একবার দেখে আসতে পারেন। চার্চের পিছনে গাড়িটিকে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয়েছে অনাদরে, অবহেলায়। একসময় যিনি প্রধান পাদ্রি ছিলেন, তিনি চড়তেন। শোনা যায়, বিশ্বযুদ্ধের পরে জিপটি কেনা হয় পুরুলিয়ার গ্রামাঞ্চলে কাজ করার জন্য। তখন পুরুলিয়া প্রায় মরুভূমির মতো শুকনো। গ্রামের রাস্তাও খুব খারাপ। এই খারাপ রাস্তাতে জিপ বহু বছর চার্চকে সেবা করেছে। কালের প্রবাহে জিপটির স্থান হয়েছে চার্চের পিছনে, লোকচক্ষুর আড়ালে। গাড়িটি একটি ময়লা ফেলার ভ্যাটে পরিণত হয়েছে। চারদিকে আবর্জনা। গাড়িটির ৯০ শতাংশ বিধ্বস্ত।
রবিবাবু ও তাঁর দাদা কলকাতাতে ফিরলেন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। গাড়িটি কেনা হলো না, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা যে অবস্থায় জিপটি পড়ে আছে, তা দেখা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক।
দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়- একদিন পুরুলিয়ার চার্চের ফাদার ফোন করলেন রবিবাবুকে, চার্চ কর্তৃপক্ষ গাড়িটি বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। হাতে চাঁদ পেলেন রবিবাবু। বিশাল এক ট্র্যাকে চেপে দক্ষিণ কলকাতাতে খেদওয়াল পরিবারের নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দিলেন ফোর্ড জিপিডবলিউ।
পাক্কা ছ'টি বছর সময় লেগেছিল জিপটিকে রাস্তায় নামাতে। আমেরিকা থেকে এল হুডের বোতাম। রবিবাবুর কাছে বাঁ-হাতে স্টিয়ারিং চার সিলিন্ডারের জিপটি যেন স্বপ্নের গাড়ি। তিনটি গিয়ার, আর মজা হচ্ছে স্টার্ট করার কোনও চাবি নেই। এর কারণ হলো এমন হতেই পারে যে, চালক গুলিতে আহত হয়েছেন, তার কাছে গাড়ির চাবি নেই, তাহলে গাড়িটাকে চালাবে কে? একটা পাওয়ার নব আছে, সেটাকে ঘুরিয়ে প্যাডেল পুশ করলেই গাড়িটি স্টার্ট নেয়। আর বিশ্বযুদ্ধের সময় তো ঘনঘন ব্ল্যাকআউট হতো, তাই হেডলাইট বনেটের ভেতরে। যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে কোথাও তাঁবু দেখা হয়েছে এই জিপের আলো সেখানে ব্যবহার করা হত।
১৫.৬৩ হর্সপাওয়ারের জিপের তেজ এখনও কমেনি। নয় নয় করে তো ৮০ বছর বয়স হলো। ৪*৪, যে প্রযুক্তিতে জিপটি তৈরি করা হয়েছে, তাকে বলা হতো গো ডেভিল টেকনোলজি। রবিবাবু কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কয়েকবছর আগে দিঘা যাচ্ছেন, ফোর্ড জিপে চেপে। পথে গাড়ির লম্বা লাইন। একটি লরি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, লরিটিকে সরানোর কোনও উপায় নেই, পুলিশের কর্তারা এসেছেন কিন্তু খেই পাচ্ছেন না কীভাবে রাস্তা পরিষ্কার করবেন। রবিবাবু এবং তার বন্ধুরা অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, হাইওয়েতে লম্বা গাড়ির লাইনের পিছনে আটকে গেলে যেমন হয়। হঠাৎ বুদ্ধি খেলে গেল আর অযান্ত্রিক তো কাঁচা রাস্তাতে চলতে সক্ষম। ব্যস! পাকা রাস্তা থেকে জিপগাড়ি নেমে পড়ল কাঁচা রাস্তায়। কোনও সমস্যা নেই, ইঞ্জিন গোঁ গোঁ করে শব্দ করতে করতে গোটা লাইন পার হয়ে তিনি আবার হাইওয়েতে উঠলেন সবাইকে অবাক করে।
হারিয়েই যেতে বসেছিল ফোর্ড জিপিডবলিউ এয়ার জিপ। রবিবাবুর ইতিহাস প্রেম, ঐকান্তিকতা, নিষ্ঠা আর ধৈর্য প্রাণ দিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর জিপটিকে। চলমান ইতিহাস। কোন ফ্রন্টে তিনি লড়েছেন, আজও তা অজানা। কিন্তু তার চালচলন দেখে বোঝা যায়, এই জিপের কী অসীম ক্ষমতা ছিল! যাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস পড়েন, তাঁরা এই ফোর্ড জিপটিকে দেখলে আনন্দ পাবেন এবং এর প্রযুক্তি দেখে বিস্মিত না হয়ে পারবেন না। আশি বছরের যুবক দিব্যি কলকাতার এ-গলি ও-গলি দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন নিজ মহিমায়, নিজস্ব ছন্দে।