অধীরের লড়াইয়ে জল ঢালছে কংগ্রেস হাইকমান্ডই

Adhir Chowdhury vs Mallikarjun Kharge: ক্ষমতার কাছাকাছি না যেতে পারলে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকেই প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়ে যাবেন না সেই গ্যারান্টিও কি খাড়্গে দিতে পারবেন?

তিনি দেখেননি সেই মানুষটিকে যিনি ভোটের দিন দলীয় কর্মীদের বাঁচাতে ও বিরোধী দুষ্কৃতীদের তাড়াতে কীভাবে দৌড়তে পারেন রাস্তায় রাস্তায়। তিনি দেখেননি সেই মানুষটিকে যিনি বন্যা কবলিত এলাকায় একটি স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ত্রাণের কাজে নেমে পড়তে পারেন। তিনি দেখেননি সেই মানুষটিকে যিনি মাঠে-ঘাটে ঘুরে রাজনীতি করতে ভালোবাসেন। তিনি দেখেননি সেই মানুষটিকে যিনি জেলে বসেও নির্বাচন জিততে পারেন।

'তিনি' মল্লিকার্জুন খাড়্গে ও 'মানুষটি' অধীর রঞ্জন চৌধুরী। আসলে অধীর হলেন রাজনীতির ট্র্যাজিক হিরো। সেই বাম আমল থেকে এখন তৃণমূল আমল — ট্র্যাজেডি তাঁর পিছু ছাড়েনি। তাঁকে সরকারি দলের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই লড়তে হয়েছে। এবার নিজের দলের সঙ্গেও তাঁর লড়াই প্রকাশ্যে এল।

ইন্ডিয়া জোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের থাকা না থাকা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় অধীরকে প্রকাশ্যে খুব ধমকে দিয়েছেন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে। বলে দিয়েছেন, তিনি ও হাইকমান্ড ঠিক করবেন কে জোটে থাকবেন ও কে থাকবেন না। অধীর ঠিক করবেন না। আর দলের লাইন না মানলে অধীর দল ছেড়ে দিতে পারেন।

এবারের নির্বাচনে পাঁচবারের সাংসদ অধীর চৌধুরী বহরমপুর আসনটি ধরে রাখতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে নানা মহলে নানারকম সংশয় দেখা দিয়েছে। সেই সংশয়ের সুযোগ নিয়েই বিদায়ী লোকসভার বিরোধী দলনেতা অধীরকে দলের সভাপতি এরকম চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি দিয়ে দিলেন কিনা জানা নেই। তবে তিনি যে অধীরকে চিনেও চেনেন না বা কংগ্রেসকে বাঁচানোর রাস্তা জেনেও জানেন না তা আবারও বুঝিয়ে দিলেন।

আরও পড়ুন- জিতলেও মানুষের নেতা হয়ে উঠতে পারবেন মোদি?

একথা ঠিক যে অধীর চৌধুরী তৃণমূলের সঙ্গে জোট করার থেকে সিপিআইএমের সঙ্গেই জোটে বেশি আগ্রহী ছিলেন। আবার একথাও ঠিক যে ভোটের আগে জোটের আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সভাপতি হয়েও তাঁর কোনও ভূমিকা ছিল না। তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা শুধু বলে আসতে পেরেছিলেন তাঁরা তৃণমূলের সঙ্গে জোট চান না, দরকার হলে একাই লড়তে চান। সেই কথা শুনেই অধীরের জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন রাহুল গান্ধিরা।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জোট না হওয়ার জন্য দরাদরিতে ব্যর্থ হওয়ার দায় রাহুল গান্ধি-মল্লিকার্জুন খাড়্গেরা অধীরের উপর চাপাতে পারেন না। জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের দেরি ও গড়িমসিতেই কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে জোট হয়নি।

ইন্ডিয়া জোটে সিপিআইএমকে রেখেও কেরলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করতে কোনও অসুবিধা হয় না খাড়্গেদের। সেখানে সিপিএমের মুখ্যমন্ত্রী পিনরাই বিজয়ন রাহুল গান্ধিদের গালাগাল করলে ঝাঁপিয়ে পড়তে অসুবিধা হয় না খাড়্গেদের। কারণ সেখানে ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছতে পারে কংগ্রেস। সেখানে বামেদের থেকে কংগ্রেসের বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আর পশ্চিমবঙ্গে দলকে শেষ করে দিতে কোনও অসুবিধা হয় না খাড়্গেদের। যেখানে বিজেপি-তৃণমূলের মেরুকরণের লড়াই থেকে বেরিয়ে বাম-কংগ্রেস একটি বিকল্প তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানে অধীরের লড়াইয়ে জল ঢেলে দিতে অসুবিধা হয় না হাইকমান্ডের। যে তৃণমূল রাজ্যে কংগ্রেসকে খেয়ে নিল, সেই তৃণমূলের জন্য নিজের রাজ্য সভাপতিকে কড়া তিরস্কার করতে অসুবিধা হয় না খাড়্গের। কারণ সেখানে ক্ষমতা অনেক দূরে। কেন্দ্রের ক্ষমতাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য এই মুহূর্তে। অধীরের একটা বা দু'টি আসন দেওয়া রাজ্য কংগ্রেসের থেকে তৃণমূল তাঁদের বেশি প্রিয়।

বাংলায় এখনও যে সব কর্মীরা হাত চিহ্ন নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য খাড়্গের হুঁশিয়ারি যথেষ্ট। কংগ্রেসের জাতীয় সভাপতি তো পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসকে তৃণমূল দলের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেই পারেন। 'তৃণমূল কংগ্রেস একটি জাতীয় কংগ্রেসের অনুমোদিত শাখা' বলে চালিয়ে দিতে পারেন।

আসলে যুগ যুগ ধরে কংগ্রেস হাইকমান্ডের এই উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তেই দলের এই হাল হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই হাইকমান্ডের চাপেই দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন এবং তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেছিলেন। আজ পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে শরদ পাওয়ার, পশ্চিমবঙ্গে মমতা ও অন্ধ্রপ্রদেশে জগন রেড্ডিই কংগ্রেস ছেড়ে নিজেদের দলকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। কংগ্রেস ছেড়ে দিলেও বাকি অনেক নেতার সেই শক্তি হয়নি। অধীর চৌধুরীও কংগ্রেস ছেড়ে একক প্রচেষ্টায় নিজের দল তৈরির ক্ষমতা রাখেন না। কারণ তিনি নিজেকে মুর্শিদাবাদের 'রাজ্য' সভাপতি করে রেখেছেন। এর মধ্যে যে উত্তরবঙ্গে ও বিশেষত যে মালদা-মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের নিজের শক্তি আছে, সেই এলাকায় ভোটগ্রহণও শেষ। সুতরাং অধীর এখন নরম টার্গেট।

উল্টোদিকে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে মল্লিকার্জুন খাড়্গে হেরে যাওয়ার পর অধীরকে লোকসভার বিরোধী দলনেতা করার সিদ্ধান্তে কংগ্রসের অনেকেই অখুশি ছিলেন। তার মধ্যে খাড়্গেও অন্যতম। সেই পুরনো ক্ষতও যে এই মন্তব্য করতে খাড়্গেকে অনুপ্রেরণা দেয়নি তাই বা কে বলতে পারে!

আরও পড়ুন- মোদি আর বিজেপি দুই-ই এবার ব্যাকফুটে || মুখোমুখি পরাকলা প্রভাকর

বিজেপিকে আটকাতে তৃণমূলের আসন সংখ্যা বাড়া জরুরি ও তাদের সমর্থনও বিরোধী জোটের জন্য জরুরি। ক্ষমতার কাছাকাছি গেলে তৃণমূল বিরোধী জোট থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারবে না — তা সে বাইরে থেকে সমর্থন (দিদিগিরি) বা ভিতরে সরকারে যোগ দিয়েই হোক। আবার ক্ষমতার কাছাকাছি না যেতে পারলে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকেই প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়ে যাবেন না সেই গ্যারান্টিও কি খাড়্গে দিতে পারবেন?

সুতরাং সমর্থন আদায়ের সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখতে নিজের দলের নেতাকে এভাবে প্রকাশ্যে তিরস্কার করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বরং জল আরও ঘোলা হলো।

রাহুল গান্ধি একটি পন্থা নিয়েছেন বটে যে দলের লাইন মেনে চলো, নয়ত কেটে পড়। সেই লাইনে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া থেকে শুরু করে অনেক নেতাই দল ছেড়েছেন। কিন্তু তাতে কংগ্রেসের খুব ভালো কিছু হয়নি।

একটি সর্বভারতীয় দলে আঞ্চলিক আশা-আকাঙ্খা থাকেই। তাকে সামলেই চলতে হয় জাতীয় নেতৃত্বকে। যুদ্ধং দেহি মনোভাব নিয়ে চললে আখেরে দলের কী হাল হয় তা দেখেছে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, অসমের মতো রাজ্য। শুধুই রাজ্য নেতাদের উপর সব দোষ চাপিয়ে হাইকমান্ডের ছড়ি ঘোরালে বিপদই বাড়বে। রাহুল গান্ধি এখনও নরেন্দ্র মোদি তো দূর অস্ত নিদেন পক্ষে সনিয়া গান্ধিও নন। তিনি দলকে ক্ষমতার কাছে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন বারবার। দলের রাশও সবসময় তাঁর হাতে নেই। তাঁর লাইন তাই বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।

অধীর চৌধুরী কখনও প্রকাশ্যে রাহুল গান্ধিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এমনটি হয়নি কিন্তু মাঠে ঘাটে রাজনীতি করা দলীয় সৈনিকদের উপর তলা থেকে হুমকি-ধমক দিয়ে আর যাই হোক দল রাখা যায় না।

কংগ্রেসের বড় শত্রু এই উপর তলা বা হাইকমান্ডই। এটি একটি প্রমাণিত সত্য।

 

More Articles