মিতা বলে ডাকতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার 'মস্তান' ভানু বোসের ম্যাজিক আজও অমলিন
Kolkata Mastan Bhanu Bose : ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর ভানু বোস পরস্পরকে 'মিতা' ডাকতেন। টালিগঞ্জে কোনও কারণে এলেই মিতার ম্যুর অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে একবার আসতেনই ভানু বোস।
ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের হাত ধরে ভানু বোস বলল, "ধনাদা তোমাকে যেতেই হবে"। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য মনে মনে ভাবলেন, ভর দুপুরে আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল তো। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারলেন না। নতুন গাড়ি কিনেছে ভানু বোস। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে তার অতি সামান্য আবদার। গাড়ি চড়িয়ে একটু ঘোরাতে চায় প্রিয় ধনাদাকে।
দুধ-সাদা রঙের একটা নতুন অ্যাম্বাসাডর ভানু বোসের। ক্রিক রো-র রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে সে গাড়ি নিয়ে যখন ভানু বোস যায়, লোকে বলে, "দেকেচ একেই বলে গাড়ি চালানো। গাড়ি তো নয়, যেন এরোপ্লেন মাটিতে চলছে"। স্টিয়ারিং হাতে পাজামা-পাঞ্জাবী কিংবা কোট-টাই পরে ভানু বোস যখন গাড়ি হাঁকান, কে বলবে পিঠ পিছে তাকেই লোকে শহর কাঁপানো মস্তান বলে জানে! রীতিমতো সাহেব-সুবো। আবার পাজামা পাঞ্জাবীতে হ্যান্ডসাম বাঙালি বাবু। নতুন গাড়ি কিনেছেন, তাই পুজো দিয়ে পাড়ায় নিয়ে এসেই আবার বেরোল গাড়িটা নিয়ে। কলেজ স্ট্রিট পেরিয়ে বৌবাজারের দিকে। মেডিক্যাল কলেজকে ডান হাতে রেখে উল্টোদিকের উঁচু বাড়িতে ঢুকল। ওই চারতলা বাড়িটাই সিসিল হোটেল। এই হোটেলের এক অংশে থাকেন ভানুর প্রাণপ্রিয় ধনাদা। বাংলার কিংবদন্তি গায়ক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। ক্রিক রো-র কালীপুজো আর জলসার সুবাদে বাংলার গায়ক-শিল্পীদেরসঙ্গে ভানু বোসের তখন একরকম আত্মীয়তার সম্পর্ক। আর ধনাদার সঙ্গে? সে তো যেন ভানুর বড় ভাই।
"ধনাদা তোমাকে যেতেই হবে।"
গাঢ় সবুজ রঙের ঘরটায় ঢুকেই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের হাত ধরে এমনই আবদার করে বসল ভানু বোস। "কোথায় যাব, আমার তো কোথাও যাওয়ার নেই," বিশালদেহী ভানুকে এক প্রকার নিরস্ত করতেই বলে উঠলেন বর্ষীয়ান সঙ্গীত গুণী। কিন্তু কে শুনবে কার কথা! ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে স্রেফ একটু ঘুরিয়ে আনবেন বলেই জোর করে তাঁকে গাড়িতে তুলল ভানু বোস। অগত্যা গাড়িতে উঠলেন ধনঞ্জয়বাবু। বেশ আয়েশ করে বসেছেন। গাড়ি স্টার্ট দিল ছোটকা।স্টার্ট দিল বলা ভুল, কার্যত গাড়ি উড়িয়ে নিল। তারপর সামনের বাস ওভারটেক করে, অ্যাম্বাসাডর ছুটছে, পিপ-পিপ-পিপ, হর্ন আর গতির তোড়ে হাতে টানা রিকশা, পথচারী, সাইকেল আরোহী ঘাবড়ে গিয়ে রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছে। সামনে আরেকটা গাড়ি, আবার ওভারটেক! দুটো ছুটন্ত মোটরসাইকেল সামনে, সে দুটোকেও মুহূর্তে পেছনে ফেলে উড়ছে ভানুর অ্যাম্বাসাডর। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য কিছু বলতে গেলেন বোধহয়, ভানু বোস তখন মত্ত। ভানুর হাতে গাড়ি যেন উড়ন্ত পক্ষীরাজ।
আরও পড়ুন- ধোঁয়াটে ক্রিক রো-র ঝলমলে জলসা! কলকাতা কাঁপাত মস্তান ভানু বোসের কালীপুজো
গাড়ি চড়ে হাওয়া খাওয়ার ভাবনা ততক্ষণে উবে গেছে ধনঞ্জয়বাবুর! ভালোয় ভালোয় ফিরলে হয়! বুকে হাত দিয়ে বসে আছেন কাঠ হয়ে। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখেই ভানু বোস তাকে জিজ্ঞাসা করছেন, "ধনাদা কেমন লাগছে?" একথার কী উত্তর দেবেন ধনঞ্জয়বাবু জানেন না। মুখ থেকে তার কথা বের হচ্ছে না। আপাতত মা কালী র নাম জপ করছেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। আর ভেবেই চলেছেন, ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরলে হয়! ভানু বোসের সেসব দিকে খেয়াল নেই। স্টিয়ারিং ধরে ভানু নিজেকে বাদশা ভাবে।
সেদিন অনেকক্ষণ পর ভানুর খপ্পর থেকে রেহাই মিলেছিল ধনঞ্জয়বাবুর। কলেজ স্ট্রিটে নিজের ডেরায় ফিরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। তবে বেজায় ভয় পেলেও সারাজীবন ভানুর এই ভালোবাসার অত্যাচার ভালো মনেই স্মরণে রেখেছিলেন ধনঞ্জয়বাবু। রগড় করে ছোটকার এই সব কাণ্ডকারখানার বর্ণনা দিতেন সময়ে অসময়ে। এক ঘরোয়া আসরে একবার শংকরলাল ভট্টাচার্যকে নিজের মুখে এই গল্প শুনিয়েছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। কলকাতার রাজনীতি থেকে সাংস্কৃতিক জগৎ- এমনই অবাধ গতিবিধি ছিল ভানু বোসের। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে কলকাতার সব মাঠে তিনিই মস্তান। কালচারালেও আছেন, ক্যালাকেলিতেও আছেন।
ভানু বোস নিয়ে এসব গল্প বুঝিয়ে দেয় তার স্যোশাল ডেজিগনেশন, যার সঙ্গে পুলিশের খাতায় তার বিরুদ্ধে ওঠা অনেক অভিযোগেরই মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যেমন, লালবাজারের হিস্ট্রি শিট ভানু সম্পর্কে লিখছে, ১৯৫৭ সাল নাগাদ বৈঠকখানা বাজার, মুচিপাড়া এলাকায় চুরি ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে ভানু বোসের নাম। ভানু বোস আর ছিঁচকে চুরি-ছিনতাই! কোথায় যেন তাল মেলে না! ওই চেহারা, কব্জিতে বাঘের থাবার জোর, ওই গলার আওয়াজ, ওই হাওয়ার বেগে গাড়ি হাঁকিয়ে যাওয়া, ওই স্টাইল, ওই মেজাজ! তার সঙ্গে চুরি-ছিনতাই? নাহ, যাচ্ছে না, স্রেফ যাচ্ছে না। ধনঞ্জয়বাবুর সঙ্গে এই যে গল্প, সেই একই সময়ের যখন পুলিশের খাতায় চুরির অভিযোগও উঠছে ভানুর বিরুদ্ধে। আরে বান্দার নাম ভানু বোস! খুন করেছে, স্টেনগান চালিয়ে এলাকা ফর্সা করেছে, ভোটকেন্দ্রে গোলমাল করেছে, গলা টিপে মেরে ফেলেছে, সব মানা যাবে কিন্তু তাই বলে ছিঁচকে চুরি, তাও ভানু বোস? ঠিক হজম হচ্ছে না। তার চলে যাওয়ার এতগুলো বছর পরেও তাকে ঘিরে বেঁচে রয়েছে যে গল্প তা এক কথায় বুঝিয়ে দেয়, ভানু বোস ওসব পাড়ার ছেনো রুস্তম নয়, মস্তান সাম্রাজ্যের সে এক প্রতিষ্ঠান। রুপোলি জগৎ থেকে সাদা-কালোর গেরস্থ জীবন থেকে অন্ধকার জগৎ সর্বত্রই তার অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ। তিনি ডন, শাসন করেন আন্ডারওয়ার্ল্ড!
আরও পড়ুন- রণ পায়ে ছাদ টপকাতেন! ফিরে দেখা কলকাতার ত্রাস ভানু বোসকে
ভানুর বিরুদ্ধে প্রথম গুরুতর অভিযোগ ওঠে এক পুলিশ অফিসারকে হত্যার চেষ্টায় তার সক্রিয়তাকে ঘিরে। সেসব দাঙ্গার মুহুর্মুহু সময়ে ঘটনাটা ব্যক্তিগতভাবে বিদ্ধ করেছিল ভানুকে। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-র অন্ধকার দাঙ্গার দিনগুলোর আগে থেকেই কলকাতাকে এক চাপা অবিশ্বাসের বাতাবরণ গ্রাস করেছিল। ভানু-গোপালদের রেজিস্ট্যান্স গ্রুপ তখন সংগঠিত হয়েছে বেশ জোরালো ভাবেই। একটা কিছু ঘটতে চলেছে এমন একটা ভাব চারপাশে। এরকমই একটা সময়ে স্থানীয় থানার ওসি ৩২ নম্বর সার্পেন্টাইন লেনে ভানুদের বাড়িতে হানা দেন। অবশ্যই ভানুর খোঁজে। ভানু সেদিন বাড়িতে ছিল না। পরে সে যখন জানতে পারে থানার বড়বাবু তাকে না পেয়ে তার মাকে ধাক্কা মেরেছেন, রাগে পাগল হয়ে ওঠে ভানু। আগুনখেকো ছেলেদের দলে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে খবরটা। চারদিক থেকে রব ওঠে 'বদলা চাই, বদলা চাই'। পারলে তখনই থানায় হামলে পড়তে চায় ছেলের দল কিন্তু ভানু তাদের বারণ করে। মলঙা লেনের মাঠে দাঁড়িয়ে ছোটকা বলে, "এ আমার মায়ের অপমান, এর বদলা আমি একাই নেব"। এই বলে মধ্য কলকাতার সাপের মতো পেঁচিয়ে থাকা গলির বাঁকে তীক্ষ্ণ শিকারির মতো অপেক্ষা করতে থাকে ভানু। মায়ের অপমানকারীরা এই পৃথিবীতে থাকতে পারে না, সেকথাই মনে মনে জপ করছে ভানু। শিকারের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে থাকে ভানু। ঘাপটি মেরে প্রহর গুনছে ভানু বোস। ওদিকে ওসি জানেন না, অন্ধকারে চিতার মতো সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছে তাঁর উপর। ওসির জিপটা গলির বাঁক নিতেই মওকা বুঝে হামলে পড়ল ভানু।
- কীরে, আমার খোঁজ করছিলি নাকি?
- কেহ, অ্যাই সিপাই এ কে?
- তোর বাপ রে!
- কেহ?
- তোর বাপ, ভানু বোস। তোর এত বড় সাহস তুই আমার মায়ের গায়ে হাত দিস? ওই হাত আমি ঝাঁঝরা করে দেব।
এরপরই কথা না বাড়িয়ে হাতের রিভলবার থেকে গুলি চালিয়ে দেয় ভানু। পুলিশের বড়বাবু মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। রেড অ্যালার্ট জারি হয় ভানু বোসের নামে। ভানু তখন প্রশাসনের কাছে ত্রাস। আর সুরি লেন, সর্পেন্টাইন লেনের গেরস্থদের কাছে বাঘের বাচ্চা!
এই সময়েই, ১৯৪৫-এ ডিক্সন লেন গুলিকাণ্ডেও নাম জড়ায় ভানু বোসের। এরপর আসে অভিশপ্ত ছেচল্লিশ। কিন্তু দাঙ্গার দিনগুলি পেরনোর পরই ১৯৪৮ সালে সুরি লেন গুলিকাণ্ড এবং ওই একই বছরে পোলক স্ট্রিট ডাকাতি কাণ্ডে জীবনে প্রথমবার নাম জড়ায় ভানু বোসের। তবে একটা কথা স্মরণে রাখতে হবে, ছেচল্লিশ সালের দাঙ্গার মতোই স্বাধীনতার পরই ১৯৪৮ সালেও কলকাতায় বিক্ষিপ্ত দাঙ্গা হয়েছিল। এই বছরেই ভানুর বিরুদ্ধে প্রথম ডাকাতির অভিযোগ ওঠে। এরপরও ১৯৫০ সালে শিয়ালদা হোটেল ডাকাতি এবং টালিগঞ্জ টাক্সি ডাকাতি কাণ্ডেও নাম জড়ায় ভানু বোসের। সব অভিযোগেই শেষমেশ প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পায় ভানু। সেটাই স্বাভাবিক কারণ মাথার উপর ভগবান বিধানদার হাত! কে ছোঁবে তাকে? এই পর্বে ভানু বোসের জীবনে দুটো ঘটনা ঘটছে। এক, ভানু আর তার দলবল প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক নেতাদের হয়ে কাজ করতে শুরু করে। দুই, নিজে দুষ্কর্ম থেকে সরে দাঁড়ায় ভানু। বরং তার নিজের হাতে গড়া নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয় বাংলা জুড়ে। এই পর্বেই একদিকে যেমন বিধানচন্দ্র রায়ের হয়ে ভোটের কাজ, বিধানবাবুর বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া নানা আন্দোলনকারীদের হটানোর কাজ করেছে ভানু বোস, অন্যদিকে এই সময়েই অতুল্য ঘোষের ভাগ্নে নির্মলেন্দু দে ওরফে বদুবাবুর খপ্পরে পড়ে ভানু বোস আর তার দলবল।
এই বদুবাবুর দেওয়া কাজে দক্ষিণ শহরতলিতে বারে বারে এসেছে ভানু বোস। জিপের কনভয় নিয়ে, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে। দক্ষিণ শহরতলির সমাজ জীবনে, রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তন আসছিল। উদ্বাস্তুদের হাত ধরে যাদবপুর, ঢাকুরিয়া, টালিগঞ্জে রাজনীতির হাওয়া বদলাচ্ছিল। বাম রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গেই অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাংলা কংগ্রেসের সংগঠন বাড়ছিল টালিগঞ্জ এলাকায়। বাংলা কংগ্রেসের ভরসা ছিল এলাকার এক উঠতি ডাকাবুকো যুবক রবো খানের উপর। রবো খান পরবর্তী সময়ে সিপিআইএম ঘনিষ্ঠ হয়। তো এই রবো খানের হাত ধরে কংগ্রেস ভেঙে বাংলা কংগ্রেসের যাত্রা পণ্ড করতে মাঝে মধ্যেই ভানু বাহিনীকে পাঠাতেন বদুবাবু। বিভিন্ন রাজনৈতিক হানাহানিতে জড়িয়ে পড়েছে রবো-ভানুর দলবল, এই সময়কাল জুড়ে।
আরও পড়ুন- যৌনকর্মী, বেপরোয়া প্রেমিকা! কে ছিলেন কলকাতার প্রথম মহিলা মস্তান নির্মলা দাসী?
আরও একটা কাজে দক্ষিণে আসতে হতো ভানুকে। সেগুলোও বদুবাবুরই দেওয়া কাজ। তার মধ্যে অন্যতম হলো, উদ্বাস্তু কলোনি উচ্ছেদ। টালিগঞ্জ স্টুডিওপাড়া লাগোয়া খোলামেলা পরিবেশে লায়েলকা দাগা সহ বহু বিত্তশালী লোকজন বাগানবাড়ি গড়ে তুলেছিলেন। উদ্বাস্তু ঢল নেমে এলে তাদের ব্যক্তিগত জমিগুলিতেও কলোনি গড়ে ওঠে। বদুবাবুর দ্বারস্থ হন বিত্তশালীরা। রিফিউজিদের হাত থেকে জমিগুলো উদ্ধার করে দিন, যা টাকা লাগে দেব। কাতর আবেদন তাদের। পার্টির ফান্ড ম্যানেজারদের এহেন অনুরোধে নির্মলেন্দু দে শেষমেশ ডেকে পাঠালেন ভানু বোসকে। তবে এইসব কাজে খুব একটা এঁটে উঠতে পারেনি ভানু। লেখক সুপ্রিয় চৌধুরী তার পাতাল পুরাণ বইতে এই পর্বের উল্লেখ করেছেন। ভিটেহারা মানুষের সমবেত প্রতিরোধের সামনে একপ্রকার পিছু হটতেই হচ্ছিল ভানু বাহিনীকে। কলোনিতে কলোনিতে তখন বাম দুর্গ। রক্ত গরম আগুনখেকো যুবকের দল দুর্গ পাহারা দিচ্ছে। ভানু বোসদের পিছু হটতে হচ্ছিল। তবু দক্ষিণে কাজ পেলে ভানু চলে আসত মূলত দুটো আকর্ষণে। এক, রেসের মাঠ। টালিগঞ্জে তখন ছিল রেসের মাঠ। ভানু বোসের দুটো রেসের ঘোড়া ছুটত ওই মাঠে। একটা ঘোড়ার নাম ছিল আজাদ হিন্দ। মাছের আড়তের পাশাপাশি রেসের ঘোড়া থেকেও বিলক্ষণ রোজগার হচ্ছিল ভানুর।
আরও একটা আকর্ষণ ছিল ভানুর। দক্ষিণে এলেই মিতার বাড়ি একবার তার যাওয়া চাই-ই চাই। মিতা কোনও মেয়ে নয় । ও-রসে তেমন আসক্তি ছিল না ক্রিক রো-র ডনের। ভানু বোসের মিতার নাম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সে সময়ের বাঙালি সমাজে একটা রেওয়াজ ছিল। একই নামের দু'জন পরস্পরকে মিতা বলে সম্বোধন করতেন। আর কে কে করতেন জানা নেই, তবে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর ভানু বোস পরস্পরকে এই সম্বোধনেই ডাকতেন। তাই টালিগঞ্জে কাজ বা মারপিট কোনও কারণে এলেই মিতার ম্যুর অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে একবার আসতেনই ভানু বোস। মিতার সঙ্গে তার আজীবনের বন্ধুত্ব বজায় ছিল।
আর ছিলেন মন্টু বোস। বসুশ্রী সিনেমাহলের মালিক। ভানু বোসের মতোই নজরকাড়া জলসার আয়োজক। ভানুর জলসা কালীপুজোয় আর মন্টু বোসের জলসা পয়লা বৈশাখে। দুই জলসাতেই মধ্যমণি মহানায়ক উত্তমকুমার। তাই এদিকে এলে একবার হাজরায় মন্টুবাবুর সিনেমাহলে আড্ডা দিয়ে যেতেন ভানু বোস। মন্টু বোসের সঙ্গে ভানুর আরও একটা যোগ ছিল। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব! আজীবনের ঘটি ভানু বোস ছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থক। বাঙালদের ক্লাবের ভোটে রীতিমতো স্বমহিমায় ধরাও দিতেন তিনি। রাজনীতির মাঠে যেমন বিধান রায়, দাদা জগা বোস, শত ঘোষদের নিয়ন্ত্রণে, তেমনই মস্তানির ময়দানে ভানুকে নিয়ন্ত্রণ করতেন নির্মলেন্দু দে। আর খেলার মাঠে? মন্টু বোস। সব মাঠেই মাঠ কাঁপানো প্লেয়ার আমাদের ভানু বোস।
দিন যত যাচ্ছিল ভানুর বিরুদ্ধে বাংলা জুড়ে ডাকাত দল নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ জোরালো হচ্ছিল। অনেকে বলছিলেন, ডাকাতির বখরা আসে ক্রিক রো-তে, ডনের ডেরায়। ক্রিক রো-তে খাটিয়া পেতে বসে থাকে ভানু। কখনও বা পাশেই জামাইয়ের চায়ের দোকানে, বসে থাকে। আর রাজ্যের ছেলেপুলে এসে ভিড় জমায় ভানুকে ঘিরে। শুধু তাই না, আন্তঃরাজ্য অস্ত্র সরবরাহ চক্রেরও মূল চাঁই মনে করা হতো এই ভানু বোসকেই। মনে না করারও কিছু নেই কারণ ভানু বোসের অস্ত্রের সংগ্রহ ছিল দেখার মতোই। ক্রিক রো-তেই ছিল সেই অস্ত্র সম্ভার। তা পাহারা দেওয়ার জন্যই একের পর এক অ্যালসেশিয়ান পোষা। ভানুর মতোই ভানুর পোষা প্রিয় কুকুর লাকির নামও ছড়িয়ে পড়ে শহরের পাতালপ্রদেশে। এই লাকিকে বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল। লাকি জানত কোন অজানা জায়গায় অস্ত্র রাখা আছে। লাকির কাজ ছিল অস্ত্র রাখা জায়গাগুলিতে ঘুরে বেড়ানো আর কোনও অবাঞ্ছিত ব্যক্তি সেইদিকে এলে দাঁত বের করে আক্রমণ করা। এমনই নিখুঁত বন্দোবস্ত ছিল ডনের।
তবে ভানু বোস পেরেছিল সমাজের উঁচুতলা, সাধারণ গেরস্থ বা তারকা সমাজের কাছে সমীহ আদায় করতে। এই জনপ্রিয়তাকে সঠিক পথে কাজে লাগাতে পারলে রাজনীতিতেও সফল হতেই পারত ভানু। ভানুর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু রাম চ্যাটার্জি পেরেছিলেন এ ব্যাপারে সফল হতে। মস্তান থেকে মন্ত্রী হয়ে যেতে পেরেছিলেন। ভানুও চেষ্টা করেছিল, নাম লিখিয়েছিল রামের মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক পার্টিতে। একবার কাউন্সিলর ভোটেও লড়েছিল কিন্তু সফল হয়নি। আসল সমস্যা হচ্ছে, মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকে নামও লিখিয়েছে আবার কংগ্রেস নেতাদের হয়ে দলবল নিয়ে কাজও করছে! এমন দুটো কাজ কি কখনও একসঙ্গে করার? তাই সাফল্যও আসেনি। ভানুর রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট ছিল না। বেশ কিছু কংগ্রেস নেতাদের হয়ে ভাড়াটে মস্তানের কাজ ছাড়তে পারেনি ভানু। ছেড়ে দিলে তার বহু ছেলে বিপদে পড়ে যেত, নেটওয়ার্ক ভেঙে যেত। এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে অর্থযোগ তো ছিলই ভানুর। তাই ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রকাশ্যে মাছের আড়ৎ, রেসের ঘোড়া কিংবা পরবর্তী সময়ে বাসের ব্যবসা করলেও এগুলোর বাইরে যে ভানুর বড় সাম্রাজ্য রয়েছে একথা অনুমান করতে পারতেন সবাই।
আরও পড়ুন- দার্জিলিংয়ের অনাথ শিশুই ছিল কলকাতার ত্রাস! কে এই ‘চাইনিজ ডন’?
তবে ভানুর সামাজিক প্রতিষ্ঠা, অ্যান্টি হিরো ইমেজের একটা বড় কারণ তার জলসা। বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ তো বটেই মুম্বইয়ের শিল্পীরাও আসতেন ভানুর জলসায়। মহানায়ক গভীর রাতে এসে শুনিয়ে যেতেন কোনও নাটকের সংলাপ। বিনা পারিশ্রমিকে গান গাইতে ভিড় লাগত শিল্পীদের। এই জলসার আরেকটা দিক ছিল। কালীপুজো এবং জলসা উপলক্ষ্যে যত চাঁদা বা স্যুভেনিরের বিজ্ঞাপন, তা কেউ সংগ্রহ করতে যেত না। লাইন দিয়ে লোকে ভানুর ডেরায় এসে চাঁদা দিয়ে যেত। ব্যবসায়ীরা দিয়ে যেত বিজ্ঞাপন। ভানু বোসের জলসা বলে কথা!
ভানু বোসের জলসাতেই চিত্রতারকাদের হাতের নাগালে, রক্ত মাংসে দেখার সুযোগ পেত বাঙালি। এ কম বড় পাওয়া নয় সে সময়ে। বিনোদন বলতে ম্যাটিনি শো। আর ম্যাটিনি আইডলদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ যদি পাওয়া যায় তবে তো সোনায় সোহাগা!
ভানু বোসের জলসাতেই কলকাতা প্রথম চর্মচক্ষুতে দেখেছিল মুম্বই ফিল্ম স্টারদের। কয়েক হাত দূরত্বে ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্নাদের উড়িয়ে নিয়ে এসে কলকাতায় হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ভানু। ধর্মেন্দ্র তখন হিন্দি সিনেমার সুপারস্টার। সেবার কালীপুজোর শেষে ভানুর জলসায় এসেছেন। ক্রিক রো-তে তিল ধারণের জায়গা নেই। ভিআইপিদের জন্য বরাদ্দ এন্ট্রান্স দিয়ে গ্রিনরুমে ঢুকতে যাবেন ধর্মেন্দ্র। তার সেক্রেটারি কানে কানে বলল, "সাহাব, ইয়ে সাহাব হ্যায় কলকাতা কি মশহুর ভানু বোস"! গ্রিনরুমে ঢুকতে যাচ্ছিলেন ধরম পাজি। ভানুর নাম কানে যেতেই তড়িৎ বেগে ঘাড় ঘোরালেন। ভানুকে দেখে বিস্মিত ধর্মেন্দ্র। এই সেই! এর নামই তিনি শুনেছেন এতদিন ধরে? বোস। ভানু বোস! কলকাতা কা ডন!