ধোঁয়াটে ক্রিক রো-র ঝলমলে জলসা! কলকাতা কাঁপাত মস্তান ভানু বোসের কালীপুজো

Kalipuja of Mastan Bhanu Bose : কালীপুজোয় এক অন্য অর্থনীতির জন্ম! সুভেনিয়রে টাকা তোলার এমন মার্জিত মডেল তৈরির দাবিদার একমাত্র ভানু বোসই।

ওয়েলিংটন স্কোয়ার আর ক্রিক রো-র নীচে একটা মৃত নদী ঘুমিয়ে আছে। বজরা, ডিঙি নৌকো, ছোট জাহাজ-সহ আস্ত একটা নদী। মরে পড়ে আছে মাটির তলায়, যা একদিন বয়ে যেত চাঁদপাল ঘাট থেকে বেলিয়া ঘাটা। আর বাতাস জুড়ে মৃত সময়। গোপাল পাঁঠা, ভানু বোস, জগা বোস, চাইনিজ ডন কৃষ্ণ বাহাদুর নেপালি মিশে আছে সেই মরা বাতাসে। পুরোনো বাবু মহলা বাড়ির কার্নিশ ছুঁয়ে সে বাতাস বয়ে যায় নিভৃতে আজও। শুধু কালীপুজো এলে সে বাতাসে ঢেউ জাগে। ছেলেদের দঙ্গলে আর বুড়োদের আড্ডায় প্রাণ ফিরে পায় মরা বাতাস, মৃত সময়। স্মৃতিতে জেগে ওঠে পুরোনো চরিত্রগুলো। ছায়া হয়ে ঘোরে অলি গলির তলপেট ছুঁয়ে।

কলকাতার মস্তানদের কালীপুজোর ইতিহাসের গোড়াপত্তন এই অঞ্চল, এই লেন, বাইলেন আর কানাগলির পাকস্থলী জুড়ে ছড়িয়ে আছে। শক্তি আরাধনার সঙ্গে বঙ্গের ডাকাতদের কালীপুজোর একটা ঐতিহ্য ছিলই। কলিকাতাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ঔপনিবেশিক কলকাতায় সন্ধে হলেই ফিরিঙ্গি পাড়ার জলজ্যান্ত ত্রাস ছিল যে সব ডাকাতের দল, গঙ্গার তীর ঘেঁষে গভীর রাতে তারাও মাততো কালী উপাসনায়। সে ছিল এক ধোঁয়াটে সময়। জঙ্গলাকীর্ণ ছিল গ্রামজ কলিকাতা। তারপর সময় বয়ে গেল কিন্তু অটুট রইল বাহুবলের সঙ্গে কলকাতার শক্তি আরাধনার ধারা। কলকাতা শহরের পঞ্চাশের দশক-ষাটের দশক জুড়ে বাংলা কাপানো 'মস্তান'- দের সঙ্গেও ছিল ডাকাতির যোগ। আর ছিল কালীপুজো। তবে মা কালীর দিব্যি, এদের কেউ কেউ আত্মোন্নতি সমিতি, যুগান্তর গোষ্ঠীর হাত ধরে হতে চেয়েছিলেন চরমপন্থী বিপ্লবী। যোগ দিয়েছিলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। তারপর একদিন নানা পথ, নানা ভাঙচুর পেরিয়ে জুটেছে মস্তানের তকমা। যে পিস্তল একদিন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল সেই আগ্নেয়াস্ত্রে লাগল দাঙ্গার কলঙ্ক। সময় বদলাল, বদলাল রাজনীতির অভিমুখ। দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, দেশ ভাগ, উদ্বাস্তু স্রোত, ভাঙা অর্থনীতির চালচিত্রে দাঁড়িয়ে থাকা একদল টগবগে যুবক, যাদের হাতে প্রচুর অস্ত্র আর পেটে খিদে- পরিস্থিতি তাদের মস্তান বানাল আর রাজনীতি দিল 'শেল্টার'। কলকাতার সংগঠিত আন্ডারওয়ার্ল্ডের যাত্রা শুরু হলো এভাবেই।

বাহুবলী কথাটার মধ্যে একটা বিক্রম আর সম্ভ্রম বোধ আছে। হালফিলের সিনেমার দৌলতে এই সব শব্দবন্ধ আমাদের কাছে আজকাল পরিচিত হলেও ক্রিক রো-র ভানু বোসকে শহর কলকাতা মস্তান বলেই জানত। লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের নোটে ভানু বোস ছিল 'ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল'। মুগুর ভাঁজা চেহারায় চাকু-চেইন-ভোজালি আর স্টেইনগান সহ সে গড়ে তুলেছিল আস্ত এক বাহিনী। খুন, ডাকাতি, অপহরণ-সহ ভানুর বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ। পুলিশ ধরে, গারদে ঢোকায় কিন্তু প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় ক্রিক রো-র ডন। আর ছাড়া পেয়েই পরদিন বেরিয়ে পড়ে মর্নিং ওয়াকে। ক্রিক রো পেরিয়ে, গুরু গোপাল পাঁঠার মলঙা লেন পেরিয়ে সে যায় ভগবানের সঙ্গে দেখা করতে। ভগবান তখন প্রাতঃরাশ সারতে টেবিলে বসেছেন। ঢিপ করে পায়ে প্রণাম ঠোকে ভানু। ভগবান বললেন, সকালে এসেছিস, বোস। কিছু মুখে দিয়ে যা। ভানুর ভগবান বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়। ডাক্তার রায়কে ভগবানই তো মানে ভানু, গোপালরা। ভগবান মাই বাপ। যতদিন মাথায় হাত থাকবে, কার সাধ্য ছুঁয়ে দেখে।

আরও পড়ুন- বোমাবাজি থেকে কালীপুজো! রূপোলি পর্দার থেকেও বেশি আকর্ষণীয় বাস্তবের ‘ফাটাকেষ্ট’

কুখ্যাতিও তো আসলে খ্যাতি। এলাকায় দবদবা, ভয়ের প্রতিষ্ঠা হলেই তো শুধু হয় না, চাই প্রভাবও। মানুষের মনে ভয় মিশ্রিত সম্ভ্রম, একটা জনমোহিনী ভাবমূর্তি। কালীপুজোকেই বেছে নিল ভানু বোস। কালী আরাধনা আর জলসা। প্যান্ডেলের বাঁশ পোঁতা থেকে ভাসান, তারপর বাংলা চলচ্চিত্রের তারকাদের এক মঞ্চে এনে রাত ভোর জলসা। তারপর একদিন প্যান্ডেলের বাঁশ খোলা। সব মিলিয়ে প্রায় টানা একমাস বন্ধ থাকবে ক্রিক রো-র যান চলাচল। অফিস পাড়া, ডালহৌসি আর শিয়ালদার মাঝখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা টানা একমাস বন্ধ! তো? কী হয়েছে? এত ট্যাঁ-ফোঁ কীসের বে! কে কী বলবে? রোয়াক আলো করে ডন বসে আছে। এটা ক্রিক রো। ভুলে যাস না এটা ভানু বোসের কালীপুজো।

ভানু বোস শুধু একটা পুজোই শুরু করল না, বলা ভালো এক অর্থনৈতিক মডেলও তৈরি করল। পুজো ঘিরে সুভেনিয়ার। আকারে আয়তনে সে প্রায় রামায়ণ-মহাভারত সাইজের, অথবা থান ইঁট। যাই বলুন না কেন, পাতায় পাতায় ঠাসা বিজ্ঞাপন। বড় বড় লেখকের বেশ কিছু লেখা। আর জলসার তো তুলনাই নেই।গোটা সিনেমা জগৎ হাজির ক্রিক রো-র ওই গলিতে। বাংলা সিনেমায় তখন হিট জুটি বিশ্বজিৎ আর সন্ধ্যা রায়। রুপোলি পর্দার নায়ক নায়িকাকে দেখে মুগ্ধ দর্শক। রুপোলি পর্দার স্বপ্নের হিরো-হিরোইনদের একবার কাছ থেকে দেখতে পেলে জীবন ধন্য হয় গেরস্তের। পাবলিক ডিমান্ড ভানু বোস ভালো বোঝে। সেবার কালীপুজোর জলসার মঞ্চে হাজির করে দিলেন বিশ্বজিৎ আর সন্ধ্যা রায়কে। পাবলিক তো পাগলপারা আর ভিড় সামলাতে স্বেচ্ছাসেবকরা হিমশিম খাচ্ছে। ক্রিক রো-র দু'ধারে লাগানো কোল্যাপসিবল গেট ভেঙে পড়ে আর কী! তারপর ধরুন, ভানু ব্যানার্জি-জহর রায়। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে ক্রিক রো। আর হেমন্ত মুখার্জি-শ্যামল মিত্তির হলে তো কথাই নেই। মাঝরাতে যেন বসন্তের বাতাস বয়ে যায়। আর সেবার তো বাংলা পেরিয়ে হিন্দি সিনেমার জগৎ। বম্বের ধর্মেন্দ্র থেকে ভোর রাতের কুয়াশা মেখে মঞ্চে উঠে এলেন বাঙালির হার্টথ্রব উত্তম কুমার! গুরু-গুরু-গুরু বলে ঝড় উঠল দর্শক আসনে। ভুবনজয়ী হাসি মুখে ছড়িয়ে হাত নাড়ছেন উত্তম কুমার আর মঞ্চের এক পাশে চেয়ার নিয়ে বসে ভানু বোস। ক্রিক রো-র বাঘ। তিনি গানেও আছেন আবার gun-এও আছেন। তার জীবনের রোমহর্ষক কাহিনি সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। মঞ্চে উপবিষ্ট ভানুর দিকে তাকিয়ে নমস্কার জানালেন উত্তম বাবু।

এই জলসার আরও একটি বিশেষ দিক ছিল। এখানে বেশিরভাগ শিল্পীই বিনা পারিশ্রমিকে গান গেয়ে যেতেন। 'ভানু বাবু'কে স্রেফ 'ভালোবেসে' মঞ্চ মাতাতেন হেমন্ত-শ্যামল-মান্না-তালাদ মামুদরা। বাংলা সিনেমার ছোট-বড় অভিনেতা অভিনেত্রীরা। বনশ্রী সেনগুপ্ত তখন সদ্য নাম করেছেন। তাঁকে জহর রায় পরামর্শ দিলেন ভানু বাবুর জলসায় একবার গান গাইতে। পয়সা না পেলেও পরিচিতি বাড়বে বহু গুণ। প্রবীণ শিল্পীর পরামর্শে এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন বনশ্রী। জলসার গ্রিনরুমে হারমোনিয়াম নিয়ে অপেক্ষা করছেন বনশ্রী। শিল্পীদের বিরাট লাইন। সবাই 'ভালোবেসে' এসেছেন ভানু বোসের জলসায় কলা নৈপুণ্য নিবেদন করতে। অনেক অপেক্ষা করে ভোর রাতে দু'টি গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন নবীন প্রতিভা বনশ্রী সেনগুপ্ত। ভানুর জলসায় শিল্পীরা গান গেয়ে ধন্য আর ভয়-জুলুম এড়াতে মোটা টাকা চাঁদা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার রাস্তা নিচ্ছেন ব্যবসায়ী থেকে সম্পন্ন গেরস্থ, সবাই।

ভানুর দেখানো সুভেনিয়ার মডেল পরবর্তীকালে যেন বাহুবলী কালীপুজোর, এমনকী মধ্য কলকাতার বেশ কিছু দুর্গাপুজোর অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। সত্তরের দশকে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় (লোকে তেমনই বলে) যে নব কংগ্রেসি গুন্ডাদের আবির্ভাব ঘটে এ শহরে, ভানুর পথ অনুসরণ করে তারাও শরণ নেয় বারোয়ারি শক্তি আরাধনার। কেউ ভানু বোসের শিষ্য তো কেউ আবার অনুজ প্রতিদ্বন্দ্বী। কেউ নিছক মস্তান, কেউ রাজনীতিতে কলকাতা কাঁপাচ্ছেন। স্বীকার করুন আর নাই করুন, বাৎসরিক শ্যামা আরাধনায় এরা সবাই দারুণভাবে ভানু অনুগামী, কমবেশি সবাই। ভানু শিষ্য ফাটাকেষ্টর কালীপুজোর কথাই ধরুন। গুরুর মতোই রক্তবর্ণা বিশাল কালী মূর্তি, জলসা আর মহাভারত সাইজের সুভেনিয়র। আরেক ভানু শিষ্য নেবুতলা পার্কের প্রদীপ ঘোষ। তার দুর্গাপুজোতে বেরোয় ওই বিশাল আকারের মোটা সুভেনিয়র। এমনকী সোমেন মিত্রের দুর্গাপুজো বলে পরিচিত সেই কলেজ স্কোয়ারের পুজোয় আজও প্রকাশিত হয় ওই সাইজের সুভেনিয়র। টাকা তোলার এমন মার্জিত মডেল তৈরির দাবিদার একমাত্র ভানু বোসই।

শুধু পুজো, জলসা, রাস্তা আটকানো? আর ভাসান! তাসা-ব্যাঞ্জো-ঝিনচ্যাক নাচ! কার কালী আসে? প্রসেশন নিয়ে যাচ্ছে কে? ভানু বোস আবার কে?
তা ভানু বোস ভাসান নিয়ে যাবে আর ফাটাকেষ্ট কি দাঁড়িয়ে দেখবে? কার কালী আগে যাবে এই নিয়ে ছিল প্রতিযোগিতা। পাড়ায় পাড়ায় টেনশন। এ বলে আমায় দেখ তো সে বলে আমায়।

একদিন যেমন গোপাল পাঁঠার গ্যাং ছেড়ে ভানু বোস তৈরি করেছিল নিজস্ব বাহিনী, ঠিক সেভাবেই ভানুর ছায়া পেরিয়ে ততদিনে কেউ কেউ নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে। যেমন ফাটাকেষ্ট। ষাটের দশকের শেষের দিকে কার ভাসান আগে যাবে, ফাটাকেষ্ট নাকি ভানু বোস এই নিয়ে সরগরম থাকত মধ্য কলকাতা। ক্রিক রোয়ের রক থেকে ভানু বোস পুলিশকে নাগাড়ে চমকাছেন, তার পুজোকে যেন আগে ভাসান দিতে দেওয়া হয়। না হলে ফল ভালো হবে না। অন্যদিকে গোঁ ধরে রয়েছে ফাটাকেষ্ট। এই প্রতিযোগিতায় জলসার প্রশ্নে গুরুকে এক ধাপ পেরিয়ে গিয়েছিল ফাটাকেষ্ট। গুরু ভানু বোস যেমন বাংলা সিনেমার নায়ক নায়িকাদের নিয়ে আয়োজন করতেন জলসা। ফাটাকেষ্টর জলসায় তেমন বম্বের শিল্পীদের উপস্থিতি। এক হাত দূরে রক্ত মাংসের রাজেশ খান্নাকে দেখালো কে? ফাটাকেষ্ট আবার কে?

সময় সবই খায়। যৌবন, প্রতিপত্তি, প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি অথবা দুর্নাম। প্রভাব বাতাসে মিলায়। স্বাধীনতার পরপরই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বদলাতে থাকে। একের পর এক বামপন্থী আন্দোলন মাথা চাড়া দেয়। একের পর এক মিছিল আছড়ে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের ওয়েলিংটনের বাসভবনে। এত্ত সাহস! ডাক্তার রায়ের বাড়ির সামনে জমায়েত! সোর্ড, চাকু আর ডাবের খোলা, পাথর কুচি নিয়ে ওয়েলিংটনে ছোটে গোপাল-ভানুরা। মার মার মার। পাথর, ডাবের খোলা ছুড়ে ছত্রখান করে দেয় জমায়েত। "আবে লেলিনের বাচ্চারা, ভুলে যাস না এ পাড়ায় ভানু বোস থাকে। ওসব বিপ্লব অন্য জায়গায় বুঝলি।" তবে মুখে যাই বলুক না কেন ভানু বোস, চমক-ধমকে মরচে একটা পড়ছিলই। সময় বদলাচ্ছিল। বসন্তের বজ্র নির্ঘোষের অভিঘাত অন্য সময়ের সংকেত বয়ে আনছিল। উদ্বাস্তুদের প্রতিরোধের মুখে পঞ্চাশের দশক থেকেই পড়তে হচ্ছিল ভানু বোস, গোপাল পাঁঠাদের। এবার একরোখা শিক্ষিত রাগী যুবকদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছিল ভানু বোসদের। মতাদর্শ মলোটভ ককটেল আর বোমা পিস্তলের মুখে ভানু বোস বুঝতে পারছিল সময় ফুরিয়ে এসেছে। এবার ঘরে ঢোকার পালা। শুধু তো রাজনৈতিক প্রতিরোধ না। আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ম মেনেই বৃদ্ধ শাহেনশাহকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হাজির হচ্ছিল নতুন নতুন নাম। ফাটাকেষ্ট তো ছিলই, এবার এল রনি ডেভিডসন। তালতলার খ্রিস্টান যুবক রনি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসল বৃদ্ধ ভানুকে। শুধু মুখে নয়, পুজো ভাসান কিংবা জলসায় টেক্কা দেওয়া নয়, সরাসরি হামলা। 'জান লেওয়া হামলা'।

ভানু বোসের প্রতাপ কমতেই কালীপুজোর, বর্ণাঢ্য জলসার জৌলুস কমতে লাগল। আটষট্টি ঊনসত্তর নাগাদ বন্ধ হয়ে গেল ক্রিক রো-র জলসা। কালীপুজো যদিও হতো, ছোট করে। মাঝরাতে মায়ের মূর্তির সামনে এসে বসত ভানু। ছড়িয়ে ছিটিয়ে সঙ্গে থেকে যাওয়া কিছু অনুগামী। নিতাই মামু, বংশ মামুরাও ভানুকে ছেড়ে গেছে ততদিনে। আসলে রাজা তো একবার রাজত্ব ফিরে পেতে চাইবেই। ছেলে শংকরকে দিয়ে আরও একবার বাহিনী সংগঠিত করতে চেয়েছিল ভানু। শংকর ভালো স্টেনগান চালাতে পারত। শংকরকে গ্যাং লিডার হিসেবে মানেনি বসন্ত মামুরা। ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তবে ভানুকে কোনওদিন ভোলেনি ক্রিক রো-র দুই বাঙাল মামু। দেশ ভাগের পর এই পাড়ায় তাদের আশ্রয় দিয়েছিল ভানু বোস। তাই সে স্মৃতি মনে রেখে মৌলালির মোড়ে কাঁসা পিতলের যে দোকানগুলি আছে, সেখানে গুরুর সঙ্গে দেখা হতো চ্যালাদের। বংশ মামুরা পরে সিপিএম করত। ভানুর সঙ্গে মৌখিক ভদ্রতাটুকু তারা রেখেছিল।

আরও পড়ুন- কেউ মদ‍্যপান করে উন্মত্ত, কেউ গৃহস্থের সামনে অপ্রকাশ্য! কালীতন্ত্রে কালীর নানা রূপ

কিন্তু রনি? সে তো ভানুকে এই পৃথিবীতেই রাখতে চায় না। ভানুর উপর এত খার ওর! ভানু তখন বয়স্ক। রকে বসে আড্ডা মারে। জলসা বন্ধ। প্রতাপ উধাও। শিল্পীরাও আর ঝাঁক বেঁধে আসে না। কালীপুজো হয় নমঃ নমঃ করে। তেমন কেউ আসে কই? তবে ব্যতিক্রমও আছে। উত্তম কুমারের ভাই তরুণ কুমার মাঝে মাঝেই আসেন ভানু বোসের বাড়ি। প্রাণ খোলা গল্প করে যান। তবে বাঘ বাঘই। বৃদ্ধ হলেও সে বাঘ। বৃদ্ধ ভানুর তাণ্ডব শেষ দেখেছিল ক্রিক রো। সত্তরের দশকে। রনি ডেভিডসন ভানুর পেছনে পড়েছে।

সেদিন রাতের খাওয়া সেরে পিছনের বারান্দায় হাত ধুচ্ছিল ভানু। জলের জগ হাতে স্ত্রী সরমা (নাম পরিবর্তিত)। হঠাৎ পিছনের ঝোপঝাড় জুড়ে কী যেন প্রবল নড়াচড়া। ঘটনা নজরে আসতেই সতর্ক হয়ে উঠল বোস দম্পতি। রনি! কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভানুকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে দিল রনি ডেভিডসন। স্বামীকে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিলেন সরমা বোস কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। গুলি এসে লাগলো সরমার পায়ে। লুটিয়ে পড়লেন তিনি। পাশ ফিরে সরমাকে লুটিয়ে পড়তে দেখে চিৎকার করে উঠলেন ভানু 'সরমা......"। ভানুর চিৎকারে লোক উঠে এল দোতলায়। সরমাকে নিয়ে তারা ছুটল হাসপাতালে। শোকে, ক্রোধে যেন অন্ধ হয়ে উঠল ভানু বোস। দেরাজ খুলে বার করল পিস্তল। গুঁজল কোমরে। আরেকটা পিস্তল উঁচিয়ে ধরে ছুটে নামলেন ক্রিক রো-র রাস্তায়। "রনিইইই, আজ তুই থাকবি অথবা আমি"। উন্মাদ হয়ে গেছে ভানু। ক্রিক রো দিয়ে যে গাড়ি ঢুকছে তাই থামিয়ে ভানু চেঁচাচ্ছে, "কোথায় রনি, কোথায় রনি, কোথায় পালাবি তুই!" গাড়ির পর গাড়ি সার্চ করছে ভানু আর তার সঙ্গীরা। এলাকা ঘিরে ফেলেছে মরা রাজার বৃদ্ধ বাহিনী। উন্মত্ত ভানুর চিৎকারে কাঁপছে ক্রিক রো। গাড়ি সার্চ করতে করতে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ভানু পুলিশের ভ্যানও দাঁড় করিয়ে বলছে, "কোথায় রনি? বেরিয়ে আয় শালা।" ভ্যান থেকে কর্তব্যরত পুলিশ ভানুর হাত জড়িয়ে ধরে বলছে, "ভানু বাবু শান্ত হন। শান্ত হন।" শত অনুরোধেও সেদিনের ভানু শান্ত হওয়ার নয়। সরমার উপর আক্রমণ মেনে নেবে না ভানু বোস। ভানুর ওই দিনের তাণ্ডবে এলাকা ছাড়া হতে হয়েছিল রনি ডেভিডসনকে। পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিল সরমা। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে কিছু দিনের জন্য কালনা চলে গিয়েছিলেন ভানু বোস। সাগরেদ মীর মহম্মদ ওমরকে নিয়ে সেই সুযোগে তালতলা, নেবুতলা, ক্রিক রো-তে থাবা শক্ত করে নেয় রোনাল্ড ডেভিডসন ওরফে রনি।

একদিন সেই অধ্যায়ও অতীত হলো। কলকাতার পেটে জমে থাকা গল্পের অংশ হয়ে গেল সময়ের প্রবহমানতায়। ভানু বোস পর্ব অতীত হলেও তার কালীপুজোর জলসার গল্প বেঁচে থাকল প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ক্রিক রো-র বর্তমান প্রজন্মের কাছেও সেই স্মৃতি সদা উজ্জ্বল। ভানু বোসকে এরা কিন্তু গুন্ডা মস্তান ভাবেন না। ওরা বলেন রক্ষক। ওরা মানে হাংকুদার মতো মানুষ জন। যারা রিমেক ভানু বোসের জলসার আয়োজন করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। হাংকুদার ভালো নাম হাংকু। খারাপ নাম নীলাংশু মুখোপাধ্যায়। ভানু বোসের স্মৃতিতে একটা জলসা করে চলেছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। আসলে হয়তো স্মৃতির লাশ বয়ে বেড়াচ্ছেন।

More Articles