রণ পায়ে ছাদ টপকাতেন! ফিরে দেখা কলকাতার ত্রাস ভানু বোসকে

Kolkata Mastan Bhanu Bose : ভানু বোস চাবুক মারছে আর মাঝে মধ্যেই চিৎকার করে বলছে 'লাকি'। প্রভুর হুকুম পেয়েই ঝুলন্ত ওই যুবকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে বাঘের মতো অ্যালসেশিয়ান।

'নরক গুলজার' ক্লাবে বিধানচন্দ্র রায় আসছেন। সুঁড়ি লেনের গেরস্থদের কথাটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। "বলো কী? নরক গুলজারে আসছেন বিধানবাবু?" ফিসফিসিয়ে এসব কথা ভেসে বেড়াচ্ছে এ রোয়াক পেরিয়ে ওই রোয়াকে। বেলা যত গড়াচ্ছে পুলিশ সিপাইদের তৎপরতা ততই বাড়ছে পাড়ায়। নেবুতলা পার্কের পাশে সারপেন্টাইন লেনের গা ঘেঁষে এই অপ্রশস্ত সুঁড়ি লেন জুড়ে তখন রাস্তার গ্যাসবাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। কেমন একটা আলো আঁধারি গোটা গলি জুড়ে। এরই মধ্যে ক্লাবের রাস্তায় ব্যস্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক সুদর্শন যুবক। প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা। ডন বৈঠক দিয়ে গড়া এক পেটানো শরীর। ছোটাছুটি করছে ছেলেটি। যে কোনও মুহূর্তে বিধানবাবু এসে পড়বেন। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, "ডাঃ রায় এসে গেছেন"। মোড়ের দিকে ছুটল ছেলেদের দল। বিধানবাবু এসে গেছেন। বিধানবাবুকে ক্লাবের দিকে নিয়ে আসছে ওই সুদর্শন যুবা। গলি পেরিয়ে ক্লাবের সামনে এসে দাঁড়ালেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। সাদা ফলকে লেখা ক্লাবের নাম 'নরক গুলজার'। বিধানবাবু সব জেনেই এসেছেন, তাই নাম দেখে মোটেই অবাক হননি। কিন্তু তিনি অবাক হচ্ছেন জানলার আকারে ক্লাবের সদর দরজাটি দেখে। একটা বেঁটে দরজাওয়ালা ক্লাব। সুদর্শন যুবকটির দিকে তাকিয়ে বিধানবাবু বলে উঠলেন, "ক্লাবের দরজা এত ছোট কেন রে? আমি লম্বা মানুষ, কীভাবে ঢুকব? পাশ থেকে জগা বোস কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তটস্থ গোপাল পাঁঠা। কে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। সেই সময়ই সবার হয়ে বলে উঠল ওই যুবক। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে বলল, "এই ক্লাব আমাদের মন্দির, সবাইকে এখানে মাথা ঝুঁকিয়েই ঢুকতে হয়, আপনাকেও মাথা ঝুঁকিয়েই ঢুকতে হবে স্যার"।

চারদিক নিস্তব্ধ। কারও মুখে কোনও কথা নেই। এ কে? কে ডাঃ রায়ের মুখের ওপর একথা বলতে পারে? কে ও? মল্লিকদের রোয়াক থেকে কে যেন বলে উঠল, "ও তো ছোটকা, ছোটকা, ভানু বোস"। ভানুর নাম শুনতেই কেমন সিঁটিয়ে গেল লোকজন। এদিকে ছোকরার কথায় একটু থমকেছেন বিধানবাবু। কিন্তু যখন এসেই পড়েছেন আর কী করা! অগত্যা মাথা ঝুঁকিয়েই ক্লাবে ঢুকলেন। বিধান রায়কে সেদিন সবিনয়ে কথাগুলো বলে দিয়েছিল যে, তার পাড়ার পরিচয় ডাকনামে ছোটকা। আর মধ্য কলকাতা তাকে চেনে এক নামে, ভানু বোস।  কারও কাছে ত্রাস, কারও কাছে রক্ষাকর্তা।

এই সেই নরক গুলজার ক্লাব, বর্তমানে গৃহস্থ বাড়ি। ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে জগা বোসের বড় ছেলে ইন্দ্রজিৎ বোস

নরক গুলজার ক্লাবটি ভানুর দাদা জগবন্ধু বোস ওরফে জগা বোসের প্রতিষ্ঠিত। সুঁড়ি লেনের মানুষজন জানেন এ ক্লাবের মাহাত্ম্য। সম্ভবত বিধান রায়ও জানেন। তবে চাক্ষুষ দর্শন এই প্রথম। অন্য ক্লাবে ক্যারাম ডাংগুলি, নরক গুলজারে শুধুই বোমা আর গুলি। শুধু কি তাই? নানা আগ্নেয়াস্ত্র রাখারও নিশ্চিত ঠিকানা এই নরক গুলজার। ঠাসা ঘন জনবসতির মাঝে আপাত নিরীহ ক্লাবেই ভানু বোসদের অস্ত্র সম্ভার। মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালি গেরস্থ পাড়ায় অস্ত্র মজুত রাখার এহেন ক্লাব! একটু ছন্দ কাটার মতোই ব্যাপার। তবে এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই ক্লাবের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে সমর্থন আছে অধিবাসীদের। আর এ নিয়ে ঢাক ঢাক গুড় গুড়েরও কিছু নেই। নামই বুঝিয়ে দেয় এ ক্লাব অন্য মাঠের খেলোয়াড়দের। আর সেই খেলোয়াড়রা এখন ক্লাব চত্বরে দাঁড়িয়ে। শুধু তো ভানু নয়, সেদিনের অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ক্লাব চত্বরে উপস্থিত গোপাল পাঁঠা, জগা বোস শচী মিত্র, একটু পেছনে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওই যুবকটি বোধহয় ইনু মিত্তির। পাশে সত্যেন, ভানু বোসের খাস চ্যালা। ইনু একা না, তারই মতো ভানুর ভক্ত বহু যুবক। ভানুকে স্নেহ করেন স্বয়ং ডাঃ রায়। ভরসা করেন এলাকার মানুষ। তাকে ঘিরে খানিকটা ভয় মিশ্রিত সম্ভ্রম রয়েছে এলাকাবাসীর। আর সেটুকু পুঁজি করেই বাঙালি পাড়ার পাকস্থলীতে অস্ত্রাগার চলে। আর এভাবেই ক্লাবের নাম ছড়িয়ে পড়ে গলি পেরিয়ে রাজনীতির অন্দরমহলে। তাই খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেও আসতে হয়।

আরও পড়ুন- ধোঁয়াটে ক্রিক রো-র ঝলমলে জলসা! কলকাতা কাঁপাত মস্তান ভানু বোসের কালীপুজো

বিধান রায় ঢুকলেন মাথা ঝুঁকিয়েই, জগা, ভানু অনুগামীরা জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল- ডাঃ রায় জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

ক্রিক রো-র সেই বিখ্যাত চায়ের দোকান। এখন বাড়ির গ্যারেজ। এই ঠেকে বসেই কলকাতা শাসন করতেন ভানু বোস

গৃহস্থ পাড়ায় যখন ক্লাবের নামে অস্ত্র ভাণ্ডার চলে, সেখানে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অধিবাসীদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন সেই কাজে আছে। কিন্তু কেন আছে? এই বিষয়টা বুঝতে পারলেই ভানু বোসদের উত্থান পর্বও সহজেই বোঝা যাবে। আজ, এত বছর পরও ভানু বোস এক বিতর্কিত এবং কিঞ্চিৎ কলঙ্কিত অধ্যায়ই বটে। এমনকী তার ছবি বাড়িতেও রাখেন না তারই নিকট আত্মীয়রা। ভানুর প্রসঙ্গ উঠলে তারা প্রথমেই ভানু বোস তাদের রক্তের সম্পর্কে আত্মীয় হলেও, আসলে যে তারা ভানু গোত্রীয় নন, সেকথা বলে বোঝাতে চান বেশ গুছিয়ে। একখানা ছবি চাইলে জানবেন তাদের বাড়িতে ভানু বোসের ছবি নেই। এতটাই দূরত্ব বজায় রাখার সতর্কতা! ভানু বোস যেন এক বিস্মৃত অধ্যায়। তাকে কেউ মনে রাখতে চায়ই না। পুলিশের হিস্ট্রি শিট ঘাটলে দেখা যাবে ভানু বোসের নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে বিশেষণ 'দ্য ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল'। কিন্তু এত কিছুর পরও ভানু বোসকে অস্বীকারও করা যায় না। কালীপুজো, জলসা আর অপরিহার্যভাবে শহরের আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিসসা-কাহিনি ভানুকে বাদ দিয়ে হয় না। ভানু বোস এক হারানো সময়ের আখ্যান, যার কাহিনি শুরু হচ্ছে এই মধ্য কলকাতার সারপেন্টাইন লেনের এক তস্য গলি থেকেই।

ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল বা মস্তান পর্বের বহু আগে কৃষ্ণধন বসুর জীবন শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা বাঙালি বাড়ির ছেলের মতোই, ৩২ নম্বর সারপেন্টাইন লেনের বাসাবাড়িতে। সাত ভাই আর পাঁচ বোনের সবার ছোট কৃষ্ণধন ওরফে ভানু। বাবা রাসবিহারী বসু শীলদের এস্টেটে মাসিক সত্তর টাকা মাইনের ছোট চাকরি করতেন। স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হয় ভানু। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে ছেড়েও দেয় কিন্তু বজায় থাকে সাঁতার কাটা আর শরীর চর্চা। বউবাজার ব্যায়াম সমিতিতে নিয়মিত চলতে থাকে ডন বৈঠক, ওয়েট লিফটিং আর সঙ্গে কুস্তি। যে সময়টা জুড়ে ভানু বোস বড় হয়ে উঠছিলেন সেই সময়টা বউবাজার যেন বিপ্লব তীর্থ! গোটা মধ্য উত্তর কলকাতাই যেন তাই। কুস্তির আখড়াগুলো বিপ্লবীদের গোপন কর্মকাণ্ডের ঠিকানা। ভানুও ভিড়ে গেল চরমপন্থী বিপ্লবীদের দলে। এই সময়টাতেই গোপাল পাঁঠার সঙ্গে ভানু বোসের আলাপ। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গোপাল পাঁঠার মতোই ভানু বোস, শচী মিত্ররা যোগদান করেছিলেন। সশস্ত্র সংগ্রামে অচল হয়ে গিয়েছিল কলকাতা। সেইসব ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই লড়াই করেছিল ভানু আর গোপাল। দাদা আর ভাই। লড়াইয়ের ময়দানে সুহৃদ। ভানু আর গোপালের বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে আছে মধ্য কলকাতার একটি গলি, সুধীর সেন বরাট লেন। সুরেন্দ্রনাথ কলেজের পাশেই এই রাস্তা এক ছাপোষা গেরস্থের নামে নামাঙ্কিত। সুধীর সেন বরাট কোনও সেলিব্রিটি বা মনীষী নন কিন্তু তার মৃত্যুর পরে এই রাস্তার নাম তার নামেই হয়। সৌজন্যে ভানু-গোপাল। আর নেপথ্যে রয়েছে এক রোমহর্ষক কাহিনি। ঘটনাটা ঠিক কোন সময়ের তা এখন আর কেউ সঠিক বলতে পারবে না।

ভানু বোসের পৈতৃক বাড়ি।

ভানুর বিরুদ্ধে তখন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ব্রিটিশ পুলিশ। দেখলেই গুলি চালানোর অর্ডার নিয়ে শহরময় ছুটে বেড়াচ্ছে তারা। প্রাণ বাঁচাতে আর নজর এড়াতে শিয়ালদা লাগোয়া এক তস্য গলির দোতলা বাড়ির ছাদ বেছে নেয় ভানু। প্রতি রাতে বাড়ির মালিক ঘুমিয়ে পড়লে একটা মই নিয়ে বাড়ির ছাদে ওঠে ভানু। সঙ্গে তুলে নেয় মইটাও। আবার সকাল হলে মই নামিয়ে সটান নেমে পড়ে। সাইকেলে মই চাপিয়ে হাওয়া হয়ে যায়, আবার রাতে আসে। এভাবেই চলছিল দিন। এরই মধ্যে ঘটে গেল সেই রাতের ঘটনা। ছাদে উঠে মই তুলে নিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে ভানু। হঠাৎ সজোরে এক ঝাঁকুনিতে ধড়ফড়িয়ে ওঠে। দেখে তার মুখের কাছে ঝুঁকে গোপাল পাঁঠা। লাফিয়ে উঠে বসে ভানু, "দাদা রে তুই এখানে?" গোপাল তাকে জানায়, এই ঠিকানাটা পুলিশ জেনে গেছে। ভোর রাতেই হানা দেবে তারা। গোপাল এসেছে ভানুকে 'রেসকিউ' করতে। ভানুকে একপ্রকার চ্যাংদোলা করেই মই বেয়ে নিচে নামে গোপাল পাঁঠা। নেমেই দু'জনে দে দৌড়! এদিকে গোপাল পাঁঠার ইনফরমেশন একেবারে সঠিক! ভোর রাতে এসে পৌঁছয় পুলিশ। গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলে তারা। ভানুর ঢংয়েই মই বেয়ে ছাদে ওঠে পুলিশ। সদ্য ফুটে ওঠা একটা ভোর, বাড়ির মালিক তখন ছাদের টবে জল দিচ্ছে। পুলিশ দেখে বেজায় ঘাবড়ে যায় লোকটি। ছাদের মধ্যেই দৌড়তে শুরু করে। পুলিশের কোনও সন্দেহই থাকে না, তাদের দেখে যে পালাতে চাইছে সেই আসলে ভানু বোস! গুলি চালিয়ে দেয় পুলিশ। লুটিয়ে পড়ে এক নিরপরাধ গেরস্থ বাঙালি। বেলা গড়াতে সবই স্পষ্ট হয়ে যায়। ভুল বুঝতে পারে পুলিশ। এলাকার সাধারণ মানুষের ক্ষোভের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। পরে এলাকাবাসীকে শান্ত করতে গলিটির নাম মৃত ওই ব্যক্তি সুধীর সেন বরাটের নামেই রাখে প্রশাসন । সেই থেকে সুধীর সেন বরাট লেন।

১৯৪৬ সালের জাতিদাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে নাম ছড়িয়ে পড়ে গোপাল পাঁঠার। কিন্তু বাস্তব আসলে এই যে, গোপালের বহু আলোচিত রেজিস্ট্যান্স গ্রুপ ভারত জাতীয় বাহিনী গড়েই উঠত না যদি না ভানু সেই বাহিনীকে সংগঠিত করত। অবশ্যই তা গোপাল মুখুজ্জের নির্দেশে এবং নেতৃত্বে। ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় গোপাল পাঁঠার নাম ছড়াল। আড়ালে থেকে গেল ভানু বোসের নাম। ভানুর নাম লোকে জানল কিছু বছর পরে। তখন লোকসমাজে তার পরিচয়, সে মস্তান। পাড়ার ছেঁদো মস্তান না, রীতিমতো কলকাতা কাঁপানো গুন্ডা। রাজ্য জুড়ে, এমনকী রাজ্যের বাইরেও ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মস্তানদলের মসিহা তিনি! এসবই সেদিন হয়েছিল যেদিন গুরু গোপাল পাঁঠাকে ছেড়ে ভানু নিজের দল গড়ল। কীভাবে সশস্ত্র বিপ্লবীরা পেশাদার মস্তান হয়ে উঠছে, এই পর্বটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সোহরাবর্দি কলকাতাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করবেন এই আশঙ্কায় একদিন ভানু-গোপালদের রেজিস্ট্যান্স বাহিনীকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল বহু বর্ধিষ্ণু হিন্দু পরিবার। ৪৬-এর দাঙ্গা মিটে যেতে স্বাধীনতার পর আর পাকিস্তান জুজু রইল না। ফলে এই সশস্ত্র বাহিনীরও আর প্রয়োজন ছিল না তেমন। অর্থের জোগানও ফুরিয়ে আসছিল। আর সশস্ত্র যুবকদের কাজে লাগাচ্ছিল রাজনীতির কারবারিরা। ভানুর ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটল। নরক গুলজারের মতো অস্ত্রাগার আর টগবগে যুবকদের নিয়ে গোপাল পাঁঠার দেওয়া অস্ত্রে গোপাল গ্যাং পরিত্যাগ করল ভানু। কোনও ঝগড়া নয়! দাঙ্গা মিটে যেতে, স্বাধীনতা আসার পর সশস্ত্র বাহিনী কলহ মেটাতেই সবাইকে স্বাধীন করে দিলেন গোপাল পাঁঠা। একদিন সবার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন, সেদিন আর কেউই তাকে অস্ত্র ফিরিয়ে গেল না। ভানুও সেই দলেই। তবে গোপালের সঙ্গে ভানুর আজীবন বন্ধুত্ব ছিল, বুড়ো বয়সেও।

আরও পড়ুন- দার্জিলিংয়ের অনাথ শিশুই ছিল কলকাতার ত্রাস! কে এই ‘চাইনিজ ডন’?

ভানু বোস

যাইহোক, ভানু বোসের গল্পে আসা যাক। একদিন মুসলিম আফগান গুন্ডাদের হাত থেকে মহল্লা বাঁচাতে নরক গুলজারকে পরোক্ষ সহায়তা করেছিল এলাকাবাসী। রেজিস্ট্যান্স গ্রুপগুলো এভাবেই জনভিত্তি পেয়েছিল। আর একটু একটু করে এরাই এবার ভাড়াটে মস্তান বাহিনীতে পরিণত হলো। সৌজন্যে, রাজনীতির কারবারিরা। ভানু বোস গোপাল পাঁঠার বাহিনী ছাড়ার পরই ভোট করার বরাত পান অক্ষয় কোলের কাছ থেকে। কোলে মার্কেটের বিখ্যাত অক্ষয় কোলে সেবার ভোটে দাঁড়ালেন বাঁকুড়ার কোতুলপুর থেকে। অক্ষয়বাবুর ভোট করতে সাত-আটশো ছেলের বাহিনী নিয়ে কোতুলপুর রওনা হয় ভানু বোস। সেই ভোটে কংগ্রেসের টিকিটে জেতেন অক্ষয়। আর পুরস্কার পান ভানু। কোলে মার্কেটে একটা মাছের আড়ৎ ভানুকে দেন অক্ষয়। একটা মাসকাবারি কাজ আর বিনিময়ে নেতাদের হয়ে ভোটে কাজ করা, বিরোধী দলগুলির মিছিল ছত্রাখ্যান করা। এসবই হয়ে দাঁড়ায় ভানু এবং ভানু বাহিনীর সংগঠিত কর্মকাণ্ড। সেই সূত্রেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও চেনেন ভানুকে। আর সেই সূত্রেই সুঁড়ি লেনের নরক গুলজার ক্লাবে আসা বিধানবাবুর।

ভানু বোস শুধু বাহিনীর অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল ছিল না। ডন বৈঠক দেওয়া পেটানো চেহারায় খালি হাতেও ছিল কামাল করা জোর। কাউকে একবার চেপে ধরলে রক্ষা নেই! গলা টিপে শ্বাস রোধ করে যমের দুয়ার টপকে দেওয়া দু'মিনিটের খেল! দিন যত যাচ্ছিল ভানুর মস্তান পরিচয়টাই বড় হচ্ছিল। কানাঘুঁষো শোনা যেতে থাকে ভানু বোস নাকি নিজের হাতেই খুন করেছে বত্রিশটা! স্টেনগান চালাতে দক্ষ। আবার লং জাম্প দিয়ে মধ্য কলকাতার একের পর এক বাড়ির ছাদ টপকে যেত ভানু। রণ পায়েও দ্রুত পেরিয়ে যেত ছাদ। আর খালি হাতে? যারা দেখেছে তারা আজও ভুলতে পারে না! ক্রিক রো, যে অঞ্চল ভানু বোসের জীবনের সাক্ষী সেসব এলাকা এখনও ভানুর গল্প বলে। ঘাওড়ি সেন এলাকায় দোকান চালায়। 'ভানু জেঠু' নিয়ে প্রশ্ন করতেই বলে ওঠে, "হাতের কী পাঞ্চ ছিল জানেন না! ঘুষির কী হিট।" গল্প চলতেই থাকে, "একদিন ভানু বোস মৌলালি আর ক্রিক রো-র ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক মারোয়াড়ি যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। অসতর্কতাবশত সে দাঁড়িয়ে থাকা ভানু বোসকে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে। ধাক্কা যতটা না গায়ে লাগল তার বহু গুণ অস্তিত্বে লাগল ভানু বোসের। ঘুরে গিয়ে ওই মারোয়াড়ি ভদ্রলোকের মুখে সোজা এক প্রবল ঘুষি। ঘুষির আঘাতে ওই অবাঙালি ভদ্রলোক নাকি টাল সামলাতে না পেরে ভল্ট খেয়ে ছিটকে পড়েন রাস্তায়! কুস্তি করা বাইসেপের এমন ঝলক ছিল ভানুর সিগনেচার! আরেকটা কাণ্ড করত ভানু বোস। মারপিটের সময় ঘুরে ঘুরে মারত। নিজেকে ক্রমাগত এপিঠ ওপিঠ ঘুরিয়ে চলত। একসঙ্গে এক দঙ্গল ছেলে ঠেকানো ছিল তার বাঁয়ে হাত কা খেল!" অসীম গায়ের জোরই ছিল ভানুর আরেক বড় অস্ত্র। ভানু বোস একবার ধরলে আর বাঁচার রাস্তা নেই, এই ছিল গুঞ্জন।

এসব ছাদ লং জাম্পে পার হতেন ভানু

ভানু বোসের প্রতিবেশী ছিলেন লেখক সাংবাদিক শংকরলাল ভট্টাচার্য। দুনিয়া যে চোখে ভানু বোসকে দেখেছে তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চোখে ছোটকাকে দেখেছেন শংকরলাল। তাঁর ভানুকে নিয়ে লেখা শেষ মস্তান আখ্যানে এক গল্পের উল্লেখ করেছেন তিনি। গল্পটা এই রকম,

ক্রিক রো-তে তখন গ্যাসবাতির আলো জ্বলে। তার উপর স্বয়ং ভানু বোস আর তার দলবল এলাকা কাঁপিয়ে বেড়ায়। ফলে সন্ধে তো বটেই, অন্য সময়েও পারতপক্ষে ক্রিক রো দিয়ে খুব একটা কেউ যাতায়াত করত না। একদিন হলো কী, টানা রিকশা করে এক মহিলা যাচ্ছিলেন মৌলালি থেকে। ক্রিক রো-র মুখে আসতেই মহিলা রিকশাওয়ালা কে বলেন, "ওরে বাবা! ক্রিক রো দিয়ে খবরদার না, অন্য রাস্তা দিয়ে চলো"। মোড়ের মাথায় বসেছিল ভানু বোস। মহিলার কথা কানে গেল তার। মহিলাকে উদ্দেশ্য করে ভানু বলল, কীসের ভয় দিদি। চলুন আপনার সঙ্গে আমি যাচ্ছি। দেখি তো কে কী করে! এই বলে টানা রিকশার সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে এল ভানু। ক্রিক রো পার করিয়ে দিয়ে ভানু বিদায় নিতে যাবে, মহিলা বললেন, অনেক উপকার করলে বাবা। তোমার মঙ্গল হোক। বলেই মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, "তা বাবা তোমার নাম কী?" উত্তরে ভানু বলল, "আমার নাম ভানু বোস।" যেই না বলা, মুহূর্তে বদলে গেল মহিলার হাসিমুখ। আতঙ্কে কালো হয়ে উঠলেন মহিলা। থরথর করে কাঁপছে তার যানবাহকও। আতঙ্কে অস্থির হয়ে চিৎকার করে উঠলেন মহিলা, "ওরে পালা পালা, রিকশা আগে নে!" মহিলার চিৎকার শুনে রিকশাওয়ালাও দে দৌড়! রিকশা নিয়ে মুহূর্তে মিলিয়ে গেল তারা।

আরও পড়ুন- যৌনকর্মী, বেপরোয়া প্রেমিকা! কে ছিলেন কলকাতার প্রথম মহিলা মস্তান নির্মলা দাসী?

ভানুর গল্পে মশগুল ক্রিক রো-র বাসিন্দারা

এই ছিল ভানুর প্রতাপ! সে যুগ মিডিয়ার নয়, সংবাদপত্রেও ভানুর নাম ছাপার কারণ নেই কিন্তু কলকাতার জনগোষ্ঠী তাকে জানত এক দুর্দমনীয় মস্তান হিসেবেই। মাছের আড়ৎ ভালোই চলছিল ভানু বোসের। সেই সঙ্গে মস্তানির বাজারও হয়ে উঠছিল রমরমা। সৌজন্যে রাজনৈতিক নেতা আর ব্যবসায়ীরা। ক্রিক রো-তে ভানুর ভাড়া বাসার পাশেই ছিল একটা মেস। আর মেসবাড়ির উল্টোদিকে এক বাড়ির ছাদে চিলেকোঠায় ভানু গড়ে তুলেছিল তার অস্ত্রসম্ভার। এর মধ্যে অনেককিছু বদলে গিয়েছিল ভানুর জীবনে। সারপেন্টাইন লেনের পৈতৃক বাড়ি বা সুঁড়ি লেনের নরক গুলজার ক্লাবের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল ভানুর। ক্রিক রো-তেই ভাড়াবাড়িতে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করে ভানু। এত কিছুর মূলে কিন্তু ভানুর প্রেম, যে প্রেমকে মেনে নেয়নি তার পরিবার। বউবাজারের এক বস্তি অঞ্চলের মেয়ে রানুর প্রেমে পড়ে ভানু। প্রেম করেই বিয়ে, তারপর সংসার। বাড়ি মেনে নেয়নি। তাই আলাদা হয়েই নিজের জগৎ গড়ে নেয় ভানু বোস। একদিকে সংসার আর অন্যদিকে গ্যাং। ভানু বোস কলকাতার মস্তান সাম্রাজ্যে সাইকেল বাহিনী বানিয়েছিল সফলভাবে। নানা জাতের সাইকেল। একাধিক গিয়ারযুক্ত দ্রুতগতির সাইকেল, উঁচু সিটের রেসিং সাইকেল। সাইকেল বাহিনী মূলত সামলাত শচী মিত্র। খিদিরপুর অঞ্চলের বাসিন্দা শচী একসময় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। পরে যোগ দেয় ভানুর মস্তান বাহিনীতে। এই দ্রুতগতির সাইকেল নিয়ে ক্রিক রো-র বিখ্যাত ভানু বোসের ঠেকে আসতো শচীর লোকজন। ক্রিক রো থেকেই চায়ের দোকানে বসে তখন মস্তান সাম্রাজ্য কন্ট্রোল করছেন ভানু বোস। তার লেফটেন্যান্টরা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়। বন্দরে শচী মিত্র, বরানগরে ইন্দ্র মিত্র ওরফে ইনু মিত্তির, কলকাতায় সত্যেন। আরও বিভিন্ন জেলায় আরও আরও নাম। সেই থেকে ভানু সম্পর্কে একটা গল্প ছড়ায়, সে নাকি দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া ডাকাতির বখরা পায়। পুলিশের হিস্ট্রি শিটেও এমন ইঙ্গিত আছে। লেখা আছে, পরবর্তী সময়ে নিজের হাতে দুষ্কর্ম করত না ভানু। তবে সব দুষ্কর্মের উপরই ছিল তার অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ, এতটাই তার প্রতাপ ছিল কলকাতার পাতালপুরীতে।

শুধু ছেলেদের ধরে রাখা বা তাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করাই না, গদ্দারি করলে প্রয়োজনে ভানুর ছিল বেমিসাল ওষুধ! শুধু মার বা প্রাণনাশ না। তার চেয়েও ভয়ের! লাকি, ভানুর পোষা অ্যালসেশিয়ান। তিনটে কুকুর পুষত ভানু। এর মধ্যে লাকি নামের কুকুরটি ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। তাকে প্রশিক্ষণও দিয়েছিল দারুণ। শংকরলাল তার আখ্যানে একটা দারুণ গল্প বলেছেন এই বিষয়ে।

ক্রিক রো-তে তখন গভীর রাত। গভীর ঘুম ভেঙে বালক শংকরলাল শুনতে পাচ্ছে প্রবল আওয়াজ আর আর্তনাদ। ঘুম ভেঙে যায়। জানলায় চোখ রেখে সে দেখে, বাড়ির পেছনের ছোট মাঠে গাছে ঝুলছে তিনজন। চাবুক হাতে পায়চারি করছে ভানু বোস। যারা ঝুলছে তারা গদ্দারি করেছে। তাই বরাদ্দ চাবুকের ঘা। ঝুলতে থাকা যুবকরা আর্তনাদ করছে, "ছোটকা এবারের মতো মাফ করে দাও আর করব না।" রাগে গরগর করছে ভানু, ভানুর সঙ্গে তার অন্য কয়েকজন গ্যাংম্যান। একজনের হতে চেন দিয়ে বাঁধা লাকি। ভানু বোস চাবুক মারছে আর মাঝে মধ্যেই চিৎকার করে বলছে 'লাকি'। প্রভুর হুকুম পেয়েই ঝুলন্ত ওই যুবকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে বাঘের মতো অ্যালসেশিয়ান। ঘাড়ে বসিয়ে দিচ্ছে দাঁতের কামড়। ভয়ে চিৎকার করছে ভানুর 'গদ্দার', "ছোটকা ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও।" রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সেই আর্তনাদ আছড়ে পড়ছে গোটা ক্রিক রো-র বুকে।

 

(চলবে)

More Articles