দার্জিলিংয়ের অনাথ শিশুই ছিল কলকাতার ত্রাস! কে এই 'চাইনিজ ডন'?
Kolkata Chinese Don : নেপালি কীভাবে চাইনিজ ডন হলো? সে এক অন্য গল্প। কৃষ্ণ বাহাদুরের জন্ম ১৯২৬ সালে, দার্জিলিংয়ে। কৃষ্ণ বাহাদুর আদতে এক নেপালি দম্পতির সন্তান।
গোপাল পাঁঠা তো গান্ধিজির কাছে অস্ত্র সমর্পণ করলেন না। উল্টে বলে এলেন, "দাঙ্গার সময় যে অস্ত্রে মা বোনের ইজ্জত বাঁচিয়েছি, মহল্লা বাঁচিয়েছি তা আপনার পায়ে সমর্পণ করব না"। প্রথমে তো তিনি বেলেঘাটায় হায়দারি মঞ্জিলে গিয়ে দেখাই করতে চাননি গান্ধির সঙ্গে কিন্তু রাজনৈতিক চাপ বাড়ছিল। গোপালকে গান্ধিজির সঙ্গে দেখা করতে বারে বারে অনুরোধ করছিলেন শত ঘোষের মতো স্থানীয় নেতৃত্ব। নেতারা আসছিলেন বাড়িতে। শেষমেশ আসরে নামলেন বিধান চন্দ্র রায়। অবিলম্বে বেলেঘাটায় গিয়ে মহাত্মার সঙ্গে দেখা করতে গোপাল পাঁঠাকে নির্দেশ দিলেন তিনি। ডাক্তার রায়ের কথা অমান্য করার 'ধৃষ্টতা' দেখালেন না গোপাল। নিমরাজি হয়েও রওনা হলেন বেলেঘাটা হায়দারি মঞ্জিলের দিকে। গোটা এক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে দাঙ্গায় রক্তাক্ত হয়েছে কলকাতা। দেখা পাওয়া যায়নি গান্ধির। সাতচল্লিশ সালে তিনি যখন এলেন ক্ষোভে ফেটে পড়ল যুবকদের একাংশ। শহিদ সোহরাবর্দিকে গান্ধির পাশে দেখে তাদের ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি পড়ল। গান্ধি যে পরিত্যক্ত বাড়িতে এসে উঠেছিলেন, সেই হায়দারি মঞ্জিল লক্ষ্য করে থান ইট ছুড়লো তারা। গোপালের মনোভাব ছিল সেই সব বিক্ষুব্ধ যুবকদের মতোই। গান্ধির কাছে আত্মসমর্পণ আর স্বেচ্ছামৃত্যু তার কাছে ছিল সমান। তবু যেতে হলো।
মেঝেতে বসে থাকা গান্ধির সামনে দাঁড়ালেন গোপালপাঁঠা। গোপালকে দেখে মনেই হচ্ছিল নিজের ইচ্ছায় তিনি আসেননি। গান্ধির সামনে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন আজীবন নেতাজিভক্ত গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। গান্ধির সঙ্গে যে দু' চার কথা হলো গোপালের, তা আদতে দোভাষীর মাধ্যমে। দোভাষীর ভূমিকায় অধ্যাপক নির্মল কুমার বসু। আর তার পরই গান্ধিকে নমস্কার করে গোপাল পাঁঠা বললেন, "যে অস্ত্রে দাঙ্গায় মা বোনদের...."।
এ ঘটনা সবার জানা। এ কথা হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল। জিইয়ে রইল দশকের পর দশক। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে গোপাল পাঁঠা নিজেই অন্য এক আখ্যান দিয়ে গেলেন এই পর্বের।
লালবাজারের গোয়েন্দাকর্তা নীহার রায়ের সঙ্গে গোপাল বাবুর তখন প্রতি রবিবারের আড্ডা, তার ভবানীপুরের পাঁঠার মাংসের দোকানে। একদিন গল্প করতে করতে নীহার বাবু গোপাল পাঁঠাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি কি গান্ধিজিকে অস্ত্র দিয়েছিলেন শেষমেশ?"
উত্তরে গোপাল পাঁঠা সেদিন নীহার বাবুকে জানিয়েছিলেন, "একটা ভাঙাচোরা লড়ঝড়ে অস্ত্র দিয়েছিলাম, ভালোগুলোর একটাও দিইনি। কী করব, সবাই অস্ত্র সমর্পণের জন্য চাপ দিচ্ছিল যে।"
আরও পড়ুন- গোপাল পাঁঠা : হিন্দুত্বের তাস না কি কলকাতা কাঁপানো মস্তান?
আবার একইসঙ্গে ওই সময়ই একটি আন্তর্জাতিক রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গোপাল পাঁঠা বলেছেন, তিনি গান্ধির কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেননি। এখন প্রশ্ন হলো, এটা কি বয়ান বদল? স্মৃতিভ্রম? নাকি অন্য কিছু? গোপাল পাঁঠার এই দুই পরস্পর বিরোধী বয়ানের মিসিং লিংক লুকিয়ে আছে আরেকটা শোনা কথার গল্পে। যে গল্পের আলো আঁধারিতে দাঁড়িয়ে এক দুর্ধর্ষ দুষ্কৃতী।
গল্পের স্থান মধ্য কলকাতা, কাল ১৯৪৭-এর গভীর রাত। পাত্র দুই ব্যক্তি, দূর থেকে যাদের মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। দুই চরিত্রের মাঝখানে শোয়ানো একটি আগ্নেয়াস্ত্র। রাতের অন্ধকারে দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে স্টেনগান। অন্ধকারে ওই বহুতল বাড়ির ছাদে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে চরিত্র দু'টি। গভীর আলোচনায় মগ্ন। আলোচনার মূল বিষয়, গোপাল পাঁঠা অস্ত্র সমর্পণ না করায় রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে। এখন কী করা যায়? কী হতে পারে মধ্যপন্থা? গোপাল নিজে অস্ত্র সমর্পণ করলেন না কিন্তু তাঁর গ্যাংয়ের দুই সদস্যকে কি অনুমতি দিয়েছেন অস্ত্র সমর্পণের? অবশ্যই লড়ঝড়ে , বহু ব্যবহৃত কোনও অস্ত্র। ভালোগুলির একটাও না!
কমান্ডারের অনুমতি পেয়েই কি এই মাঝরাতে পরিকল্পনাটা এখন সাজিয়ে নিচ্ছে গোপালের দুই আস্থাভাজন? এবার ওদেরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একজন জগা বোস। আর অন্য জন চাইনিজ ডন, যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে কলকাতার অন্ধকার জগতের এক ধূসর অধ্যায়। তারা ঠিক করে, পরের দিন এই অস্ত্র হায়দারি মঞ্জিলে গিয়ে দিয়ে আসবে। তাহলে গোপাল নিজে অস্ত্র সমর্পণ না করলেও তার বাহিনীর তরফে বকলমে অস্ত্র সমর্পণ করা হবে। অন্তত কিছুটা হলেও রাজনৈতিক চাপ কমবে মলঙ্গার দুর্ধর্ষ বাহিনীর ওপর থেকে। পরিকল্পনা ছকে নিয়ে নিজের বহুদিনের সঙ্গী স্টেনগানটিকে হাতে তুলে নিলেন চাইনিজ ডন জারবাতি। এই স্টেনগান সাক্ষী তার কত না দুষ্কর্মের! সেই বয়ঃসন্ধি পেরনো সময় থেকে এই 'মেশিন' তার সঙ্গী। স্টেনগানটির গায়ে একটা আলতো চুমু দিল সে। চাইনিজ ডন বা জারবাতি কোনওটাই তার আসল নাম না। একমাত্র পুলিশের খাতায় তার বাপ-মায়ের দেওয়া নামটি লেখা আছে। কৃষ্ণ বাহাদুর নেপালি। যদিও এই কুড়ি-একুশ বছর বয়সেই তাকে অন্ধকার জগৎ চিনে ফেলেছে 'চাইনিজ ডন' বা 'জারবাতি' নামে। কলকাতার প্রথম সংগঠিত আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক অন্যতম সেলিব্রিটি।
মহাত্মা গান্ধির সেক্রেটারি অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু বা মনুবেন গান্ধির লেখায় বেলেঘাটা হায়দারি মঞ্জিলে মহাত্মার সামনে অস্ত্র সমর্পণের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। সেই সময়ের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় গান্ধির সামনে তরোয়াল-ভোজালি-চাকু রাখা অস্ত্র সমর্পণের ছবি দেখা যায়। এ সবের মধ্যেই একটি ছবিতে জ্বলজ্বল করছে একটা স্টেনগান। বাংলার প্রথম সারির এক দৈনিকে প্রকাশিত এই ছবি আজও রাখা আছে কলকাতা পুলিশ মিউজিয়ামে। এই স্টেনগানই কি চাইনিজ ডন জারবাতি আর জগা বোসের তরফে রেখে আসা? ছেঁড়া ছেঁড়া গল্পগুলো জুড়ে নিলে এরকম একটা ধারণা গড়ে ওঠে বটে। তবে ঐতিহাসিকভাবে নাম নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। কারণ, অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন যারা তাদের নাম সেভাবে উল্লেখ নেই। আজ, এত দিন পর শুধু অনুমানই করতে আমরা পারি। আর মুখে মুখে ভাসা ছেঁড়া গল্প জোড়া দিয়ে এক ফেলে আসা সময়ের আভাস পেতে পারি মাত্র, যে গল্পের নামহীন নায়ক জারবাতি ওরফে চাইনিজ ডন ওরফে কৃষ্ণ বাহাদুর নেপালি। পুলিশের হিস্ট্রি শিটে এক দুর্ধর্ষ দুষ্কৃতী।
লালদিঘি সাক্ষী। সুঠাম ইমারত আর ঝাঁ চকচকে ব্রিটিশ প্রশাসনিক অঞ্চলের গা ঘেঁষে সেই কবে ১৮২০ সালে কলকাতায় প্রথম পা রেখেছিল হককা চাইনিজ সম্প্রদায়। প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ। একসময় এই অঞ্চলের নাম লোকে জানত এডওয়ার্ড টেরিটির নামে। ইতালি থেকে আসা এই জমি জরিপের সঙ্গে যুক্ত ভদ্রলোকই ছিলেন এই অঞ্চলের মালিক। মানে, তখনও তো ঘন বসতি গড়ে ওঠেনি। টেরিটি ছিলেন এই জমিগুলির মালিক। এসব ১৭০০ সালের কথা। তারপর এলেন হককারা। গড়ে তুললেন বসতি, ব্যবসা, বাজার। বাৎসরিক ড্রাগন নৃত্যের মধ্যে দিয়ে পালিত হতে লাগল চাইনিজ নববর্ষ। কলকাতাবাসীর কাছে এই অঞ্চল পরিচিত হলো চায়না টাউন নামে। পরে ট্যাংরায় হলো নতুন চায়না টাউন।
কৃষ্ণ বাহাদুর নেপালি হককা চাইনিজ জাতিগোষ্ঠীর আদৌ কেউ ছিলেন না। তবু কুড়ি বছর বয়সেই কৃষ্ণ বাহাদুর কলকাতার অন্ধকার জগতে পরিচিত হয়ে উঠলেন চাইনিজ ডন নামে। আরেকটা ডাকনাম ছিল কৃষ্ণের, জারবাতি। এ নামের কী যে মানে, সেকথার ইতিহাস আজ জানার উপায় নেই। তবে লালবাজারের গোয়েন্দাদের নোটে তার নামের পাশে লেখা, 'জহরবাদী'। কেন এমন নাম উল্লেখ? সে কথারও কোনও স্পষ্ট জবাব নেই। এ জহর হতে পারে কোনও অজ্ঞাত পরিচয় গ্যাং লিডার, যার সঙ্গে কৃষ্ণ বাহাদুরের মস্তান অস্তিত্ব জড়িয়ে ছিল হয়তো। এর খোঁজ পাওয়া আজ একপ্রকার দুঃসাধ্য। এ শহরে একের পর এক হাইরাইজ মাথা তুলছে, হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো বাড়িঘর। বদলে যাচ্ছে পুরনো পাড়ার চরিত্র। এক মৃত সময়ের সন্ধানে নেমেছি আমরা।
বদল এসেছে মলঙ্গার জনবিন্যাসেও। বহু নতুন মানুষ, 'ভদ্রবিত্ত' কর্মজীবী। তবু, এখানে পুরনো সময় যেন ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে পুরনো ইমারতগুলির মাঝে। সেই সময়ের আখ্যানে বহু নামের রেশ থেকে গেছে। মলঙ্গা লেনের আলো আঁধারি, স্টেনগান আর কৃষ্ণ বাহাদুর একটা মিথ হয়ে আছে মধ্য কলকাতায়। জারবাতি, নন্দুয়াদের ভোলেনি মলঙ্গা। এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে চোখ কপালে তুলে তারা বলেন, "ওরে বাবা! ডেঞ্জারাস লোক।"
নেপালি কীভাবে চাইনিজ ডন হলো? সে এক অন্য গল্প। কৃষ্ণ বাহাদুরের জন্ম ১৯২৬ সালে, দার্জিলিংয়ে। কৃষ্ণ বাহাদুর আদতে এক নেপালি দম্পতির সন্তান। ছোটবেলায় জ্ঞান হওয়ার আগেই বাবা-মা দু'জনকেই হারায় কৃষ্ণ। অনাথ এই শিশু সন্তানকে দত্তক নেন কলকাতার এক চাইনিজ দম্পতি। সেই সময় দার্জিলিংয়ে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন তারা। ফুটফুটে এই বাচ্চার সন্ধান পেয়ে দত্তক নেন এই নিঃসন্তান দম্পতি। ফিরে আসেন টেরিটি বাজারের ডেরায়।
বড় হচ্ছিল কৃষ্ণ, চায়না টাউনের অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে, খেলে আর ড্রাগন নাচ দেখে। তবে সুখ তার কপালে স্থায়ী হলো না। দু' তিন বছরের মধ্যেই একে একে মারা গেলেন কৃষ্ণের ধর্ম বাবা-মা, দু'জনেই। পাড়ায় বাড়ির পাশেই এক পর্ক বিক্রেতা ছিলেন। অনাথ কৃষ্ণের দায়িত্ব নিলেন তিনি। সারাদিন শুয়োরের মাংসের দোকান সামলান আর ছেলেটাকে আগলে রাখেন, সঙ্গে সঙ্গে রাখেন। পাড়ায় সম্পন্ন পরিসর থেকে এভাবেই ছিটকে যায় কৃষ্ণ। তাছাড়া সে যে জন্ম পরিচয়ে হককা চাইনিজ বা ইন্ডিয়ান চাইনিজ নয় সেকথা জানত সবাই। ফলে একটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় তার নিজের পাড়ায়। কলকাতার ওই পুরনো চায়না টাউন তখন আফিমের ডেন। চোরাচালান, অলিগলিতে রংবাজ ছেলেপুলের জটলা। সন্ধে হলেই মাতালদের আনাগোনা। নেশায় টলছে গোটা মহল্লা। অন্ধকার জগতের নাগাল পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না কৃষ্ণের। বারো বছরে পা দিতে না দিতেই অপকর্মে হাত পাকাতে শুরু করল সে।
চায়না টাউনের ঘেটো থেকে বের হয়েই বাবুদের অফিস পাড়ার ব্যস্ত কলকাতা, নানা মডেলের গাড়ি, সাহেব-মেম ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায়। কৃষ্ণ প্রথমেই শুরু করল পকেটমারি, তারপর চুরি। ওই পাড়ায় কৃষ্ণর বয়সি ছেলেদের একটা পকেটমার গ্যাং তৈরি হয়ে গিয়েছিল তখন। বাচ্চা ছেলেপুলে ঘুরে বেড়ায় রাস্তায়। এমনিতে ভাবলেশহীন। শুধু চোখ দুটোতে কড়া নজর, যেন জ্বলছে। চারপাশ যেন জরিপ করতে করতে চলেছে। অন্যমনস্ক পথচারী দেখলেই, সটান পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে নিয়ে নিমেষে উধাও। ধর্মতলা চত্বরে ক্রমে ত্রাস হয়ে উঠছিল চিনাপাড়ার এই ক্ষুদে গ্যাং। পকেটমারি, কেপমারি, চুরিতে সিদ্ধহস্ত দলটিকে বাগে আনতে পুলিশ ক্রমে সক্রিয় হলো। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই জেল যাত্রায় গেল কৃষ্ণ। তার পালক যে চাইনিজ পিতা, যার দিন কাটত পর্ক বেচে, অনেক চেষ্টা করেছিলেন কৃষ্ণকে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসার। স্থানীয় কিছু চাইনিজ সমাজের অভিভাবকতুল্য ব্যক্তির সাহায্যে রিহ্যাব সেন্টারে পাঠানো হলো কৃষ্ণকে। খ্রিস্টান মিশনারিদের পরিচালিত রিহ্যাব কিন্তু ফল দিল না। পকেটমারির দায়ে জেলে গেল কৃষ্ণ। কয়েকমাস পর জেল থেকে বেরিয়ে আরও যেন প্রবল হয়ে উঠল কৃষ্ণ। এক মাসের মধ্যেই অফিস পাড়ার আতঙ্ক ফিরে এল। চিনাপাড়ার ক্ষুদে গ্যাং এখন আরও যেন সক্রিয়। চার-পাঁচটা কেপমারির ঘটনা ঘটে গেল অফিস পাড়ায়। পাল্লা দিয়ে বাড়ল চুরির ঘটনা। অন্ধকার জগতের নিয়মেই আরও গভীর অন্ধকার টানছিল কৃষ্ণকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই কলকাতায় আমেরিকান সৈন্যদের আনাগোনা বাড়ল। এই সব সৈন্যদের কাছে তিনশো টাকার মধ্যে বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে পাওয়া যেত। কৃষ্ণের মতো বিপথে যাওয়া ছেলেরা যেন অতল পাতালপুরীর আহ্বান শুনতে পেল। হাতে হাতে ঘুরতে লাগল আগ্নেয়াস্ত্র। কৃষ্ণের গ্যাং আরও বলিষ্ঠ হচ্ছে। শুধু পকেটমারি না, এবার আরও বড় কিছুর ভাবনা কৃষ্ণের। হাতের অস্ত্রগুলো তাকে ভরসা দিচ্ছে।
টেরিটি বাজারের কিছু দূরে কৃষ্ণের জন্মের বছরেই ১৯২৬ সাল নাগাদ গড়ে উঠেছিল নাখোদা মসজিদ। ওই মসজিদ লাগোয়া অঞ্চলে মুসলিম ব্যবসায়ী, মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রভাব ছিল যথেষ্ট। মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন কারণে মুসলিম মহল্লার ছেলেদের সঙ্গে বচসা, হাতাহাতি লেগেই থাকত কৃষ্ণের দলবলের। ছেচল্লিশ সাল নাগাদ ভয়াবহ জাতিদাঙ্গা লাগার আগেই মুসলিম দুষ্কৃতী আর চিনাপাড়ার দুষ্কৃতীদের মধ্যে হাতাহাতি চরমে পৌঁছয়। এই সময় থেকেই অন্ধকার দুনিয়া কৃষ্ণকে চিনত জারবাতি নামে। তো সেই জারবাতির তো পাড়ায় থাকা দায়। মাঝে মধ্যেই হামলা। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। কৃষ্ণের খোঁজ করে কলুটোলার মিঞা মস্তানরা। একটা বটগাছের ছায়া খুঁজছিল কৃষ্ণ যে তাকে আশ্রয় দিতে পারবে। আর মধ্য কলকাতায় গোপাল পাঁঠা ছাড়া তাকে কে আর ভরসা দেবে? গোপাল পাঁঠার নাম অনেক শুনেছে কৃষ্ণ। অনেক বাহুবলী যুবকের আইকন গোপাল। কৃষ্ণও রওনা হলো মলঙ্গা লেনের উদ্দেশে।
চিনা বাজারে থাকলে কৃষ্ণের প্রাণহানি ঘটতে পারে তাই মলঙ্গা লেনেই কৃষ্ণকে উঠে আসার পরামর্শ দেন গোপাল পাঁঠা। গোপাল পাঁঠাও কৃষ্ণকে জারবাতি বলেই ডাকতেন। চ্যালা নন্দুয়াকে নিয়ে গোপালের পাড়ায় উঠে এল কৃষ্ণ বাহাদুর নেপালি। চিনা পাড়ার বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে আর মঙ্গোলিয়ান গড়নের জন্য কলকাতার অন্ধকার জগৎ তাকে এক নামে চিনত, চাইনিজ ডন বলে। কৃষ্ণ ওরফে জারবাতি ওরফে চাইনিজ ডন। খ্যাতি-কুখ্যাতি সবই বহুগুণ বেড়ে গেল ছেচল্লিশের দাঙ্গায়। গোপালের রেসিস্ট্যান্স গ্রুপ ভারত জাতীয় বাহিনীর সদস্য হিসেবে তার নামে কার্যত আতঙ্ক ছড়াতে লাগল মুসলিম মহল্লায়।
দাঙ্গা বা কোনও জরুরি অবস্থার সুযোগে কেউ কেউ ব্যক্তিগত হিসেব মেটানোর অবকাশ পেয়ে যায়। ছেচল্লিশের দাঙ্গা কৃষ্ণকেও বহু ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করার সুযোগ করে দিল। যাদের জন্য কৃষ্ণ বাহাদুরকে নিজের ছোটবেলার পাড়া ছাড়তে হয়েছিল, দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে তাদের ওপর চড়াও হয় কৃষ্ণ। নাখোদা মসজিদ চত্ত্বর দাপিয়ে ফেরে সে। কলকাতার বিবেক, শুভবুদ্ধি যেন ওই ক'টা দিন গভীর নিদ্রায় গিয়েছিল। জেগে উঠল জারবাতিরা। আগ্নেয়াস্ত্রর সঙ্গে ছোট থেকেই পরিচয় জারবাতির। এবার গোপাল পাঁঠার বিপুল অস্ত্র সম্ভারের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। স্টেনগান হাতে তুলে নেয় কৃষ্ণ। তারপর শুরু মহল্লা মহল্লায় দাপট। মিঞা মস্তানদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয় জারবাতি। মলঙ্গায় একা গোপালে রক্ষা ছিল না, সঙ্গে জুটল জারবাতি। চরমপন্থী বিপ্লবী অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অস্ত্র সম্ভার দেখাশোনা করতেন মলঙ্গার অধিবাসী প্রমথনাথ দাস ওরফে লন্টু মহারাজ। অনুকূলের চরম বিশ্বাস ছিল লন্টুর উপর। এই লন্টু মহারাজই ছিলেন গোপাল পাঁঠার গুরু। অস্ত্র প্রশিক্ষণ, শরীর শিক্ষা সবই লন্টু মহারাজের কাছেই শিখেছে গোপাল। পরবর্তী সময়ে গোপাল পাঁঠার অস্ত্র সম্ভার সামলেছে জারবাতি। গোপাল পাঁঠার কাছে সেই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল সে।
ততদিনে চাইনিজ ডন আতঙ্কের অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে মধ্য কলকাতায়। দাঙ্গার সময়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, বড় বাজারের বাঙালি এবং মারোয়ারি পরিবারগুলোর কাছে মোটা অঙ্কের অর্থ সাহায্য আদায় করতে যেত জারবাতি। গোপাল পাঁঠার নামে, তার ভারত জাতীয় বাহিনীর নামে এবং জারবাতির উপস্থিতিতে 'অর্থ সাহায্য' ভালোই উঠতো। মুসলিম ব্যবসায়ীদের প্রতিদ্বন্দ্বী মারোয়ারি ব্যবসায়ীরা ভালো অঙ্কের 'প্রোটেকশন মানি' দিত জারবাতির হাতে। গোপাল পাঁঠার সঙ্গে অনেকে অনেকভাবেই বেইমানি করেছে, গদ্দারি করেছে। টাকা, অস্ত্র হাত করতে চেয়েছে কিন্তু জারবাতি কখনও গদ্দারি করেনি। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত গোপালের প্রতি আনুগত্যে সে ছিল অবিচল। গোপাল বাহিনীর হয়ে টাকা আদায় করত সে। অত্যাধুনিক অস্ত্র চালাতে সে হয়ে উঠেছিল রীতিমতো দক্ষ। দাঙ্গা থেমে গেলে এক নতুন সময় উপস্থিত হলো ভারত জাতীয় বাহিনীর সদস্যদের জীবনে। কৃষ্ণ এতদিন যে সব বনেদি বাঙালি বাড়ি কিংবা মারোয়ারি গদিতে প্রোটেকশন মানি আদায় করতে যেত, তাকে দেখে রীতিমতো জামাই আদর করত তারা। মুসলিম প্রধানমন্ত্রীর শাসনে অভিজাত হিন্দু, বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে এক গভীর নিরাপত্তাহীনতা ছিল তাদের মধ্যে। ব্যবসা, সম্পত্তি লুঠ হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই সেদিন ওদের চোখে কৃষ্ণরা ছিল রক্ষক! কিন্তু দাঙ্গার দিনগুলি অতীত হতেই, স্বাধীনতা আসতেই একদা রাজনৈতিক মদতপুষ্ট মুসলমান আফগানি ডনদের ভয় আর রইল না। ফলে বিত্তবান হিন্দুদের চোখে আর দামও রইল না গোপাল বাহিনীর। কেমন যেন বিরক্তির সঙ্গে ই ওদের এড়িয়ে যেতে লাগলেন বিত্তবানরা। জারবাতি যায় বিভিন্ন বাড়ি, দোকান, ব্যবসা কেন্দ্রে কিন্তু টাকা আদায় হয় না। উল্টে জোটে অবহেলা।
এই নতুন পরিবেশ কৃষ্ণ বাহাদুর নেপালিদের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। একটা চালু বাহিনী বজায় রাখতে চাই টাকা। সেই টাকা তুলতে এবার ডাকাতির পথ বেছে নিল জারবাতিরা। এই দুষ্কর্মের নেপথ্যে নাম জড়াল গোপাল পাঁঠারও।
পুলিশের খাতায় ছোটবেলাতেই নাম তুলেছিল জারবাতি, চুরি-পকেটমারির দৌলতে। এবার ডাকাতির ঘটনায় নাম জড়িয়ে গেল জারবাতি কৃষ্ণ বাহাদুর নেপালির। ১৯৫০ সালের ৫ জুন গড়িয়াহাট গিনি ম্যানসনে ডাকাতি হয়। শহর কাঁপানো এই ডাকাতিতে ৩০ হাজার টাকার সোনার গয়না লুঠ হয়। গ্রেফতার করা হয় কৃষ্ণ বাহাদুর নেপালি, গোপাল পাঁঠা সহ বেশ কয়েকজনকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী কৃষ্ণ বাহাদুর ওই দিন ঘটনাস্থলে স্টেনগান নিয়ে অপারেশনে নামে। গোপাল পাঁঠা যদিও স্পটে যাননি। স্পটে নেতৃত্ব দেয় জারবাতি। পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী ওই ঘটনায় জারবাতি গ্রেফতার হলেও প্রমাণের অভাবে ছাড়াও পেয়ে যায়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কৃষ্ণ বাহাদুর নেপালি পাড়ি দেয় বোম্বে। শহর কলকাতা তার কাছে আর সম্ভাবনাময় বলে মনে হচ্ছিল না। নতুন কিছুর সন্ধানে সদ্য স্বাধীন দেশের বাণিজ্য নগরীতে পাড়ি জমায় কলকাতার "চাইনিজ" ডন। লালবাজারের কর্তাদের মনে হয়েছিল আপদ বিদেয় হলো। ক'টা দিন স্বস্তিতে কাটানো যাবে কিন্তু তাদের সে গুড়ে বালি। কাজকর্ম কিছু না জোটাতে পেরে ফের কলকাতায় ফিরে এল কৃষ্ণ বাহাদুর। মলঙ্গায় তার ঘরে তখন নন্দুয়া থাকে, কৃষ্ণর শাগরেদ। সেই ঘরেই এসে উঠল কৃষ্ণ। আবার মলঙ্গা, আবার কলকাতা, আবার পুরনো সঙ্গী সাথী।
কৃষ্ণের আরেক শাগরেদের নাম ছিল শিউ প্রসাদ সাউ। বৌবাজারে তার চালের দোকান। এই শিউ প্রসাদও দাঙ্গার সময় গোপাল পাঁঠার বাহিনীতে ছিল। পরে কোনও কাজকর্ম জোটাতে না পেরে চালের দোকান দেয়। কৃষ্ণ তার দোকানে যেতে শুরু করল। কাজ নেই, পকেটে পয়সা নেই। ঘরের গোপন জায়গায় অস্ত্র রাখা আছে। এদিকে পেটে ভাত জোটে না। এদিকে কর্ম করে, ব্যবসা করে খাওয়া শিউ প্রসাদেরও ধাতে নেই। সে চমকাতে পারে। ব্যবসা সামলে লাভের মুখ দেখার বিদ্যা তার জানা নেই। ব্যবসা খারাপ যাচ্ছিল। তাছাড়া এইসব দাগী লোকজনের দোকানে মধ্যবিত্ত আসে না। ব্যবসার হাল খারাপ। কৃষ্ণকে শিউপ্রসাদ বলল, "বুঝলি জারবাতিদা আমাদের বন্দুক হাতেই মানায়, ও কারোবার হাম লোগোকে লিয়ে নেহি হ্যায়।" করতে চাইলেও শালা কেউ করতে দেবে না। কথাটা মনে ধরে কৃষ্ণর। কয়েক দিন ধরে সেও ভাবছে এই নিরামিষ জীবন অসহ্য হয়ে উঠেছে। লোকে ওদের গরু-ছাগল ভাবছে। শিউ প্রসাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে কৃষ্ণ। কী করা যায়? চারিদিকে, গোটা বাংলা জুড়ে তখন অসংখ্য ডাকাত দল সক্রিয়। কৃষ্ণরা ভাবে এমনই কোনও গ্যাং আবার গড়ে তুলবে। সংগ্রহে রাখা অস্ত্র তো আছেই। চাই তাগড়া জোয়ান ছেলেপুলে। জান কবুল লড়তে পারে যারা। সেই দলবল বানাতে চাই অর্থ। অর্থ কোথা থেকে আসবে? শিউ প্রসাদের দোকানে বসে এসব নিয়ে আলোচনা করতে করতেই কৃষ্ণ বাহাদুরের নজর পড়ে বাজারের বিল কালেক্টর শ্যামলাল গুপ্তার দিকে। প্রতিদিন বাজারের এই বিল কালেক্টর প্রতিটি দোকানদারদের থেকে টাকা তোলে। বাজার কমিটির নিযুক্ত এই বিল কালেক্টরকে প্রতিদিন দেখে কৃষ্ণ, শিউ প্রসাদরা। দেখে তার কালেকশনের ব্যাগটা। শিকারি যেন শিকারের সন্ধান পেয়ে গেল!
একদিন গ্রীষ্মের দুপুর। রোজকার মতো শ্যামলাল গুপ্তা টাকা কালেকশন করছে। আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল কৃষ্ণ শিউ প্রসাদরা। অস্ত্র, বোমা দুটোই সঙ্গে করে এনেছে। আজই অপারেশন শ্যামলাল-এ নামবে তারা। শ্যামলাল গুপ্তা ওদের দেখেনি। টাকা কালেকশনে ব্যস্ত। কৃষ্ণ এগিয়ে যায়। ঠান্ডা গলায় বলে "থলে টা দিয়ে দে।" শ্যামলাল হকচকিয়ে যায়। বলে, "নেহি দেঙ্গে, কভি নেহি দেঙ্গে। কৌন হ্যায় আপলোগ।"
আরও পড়ুন- ধোঁয়াটে ক্রিক রো-র ঝলমলে জলসা! কলকাতা কাঁপাত মস্তান ভানু বোসের কালীপুজো
বাজারে বেলা হয়ে এলেও তখনও বহু লোক। ব্যবসায়ীরা পসরা গুছিয়ে নিচ্ছে। কথা বাড়ানোর মুডে নেই কৃষ্ণ। এদিকে শ্যামলালও বুঝতে পারছে, আগন্তুকের উদ্দেশ্য ভালো নয়। শ্যামলাল ভাবল, চিৎকার করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ভয় পেয়ে শ্যামলাল চিৎকার করতে যাবে এমন সময় শ্যামলালের গায়ে বোমা ছুঁড়ে মারে কৃষ্ণ। প্রচণ্ড আওয়াজ আর তারপরই চারিদিক ধোঁয়া আর ধোঁয়া। বাজারে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় শেষ বেলায়। তার মধ্যেই শিউ প্রসাদ শ্যামলালের হাত থেকে টাকার থলি কাড়তে যায়। কেড়ে নিতে গিয়ে দেখে শ্যামলাল মরেনি। কৃষ্ণর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চিৎকার করে ওঠে শিউপ্রসাদ, "ভাই, ইয়ে তো অভি তক জিন্দা হ্যায়।"
মাথায় খুন চেপে গেছে জারবাতির। কোমরে গোঁজা আগ্নেয়াস্ত্র বের করে শ্যামলালের দিকে তাক করে সে, বুক ঝাঁঝরা করে দেয় গুলিতে। লুটিয়ে পড়ে শ্যামলাল। টাকার থলি নিয়ে চম্পট দেয় শিউ প্রসাদ সাউ আর কৃষ্ণ বাহাদুর নেপালি। পুরনো বৌবাজারে অদূরে রূপম নামে একটি সিনেমাহল ছিল, পঞ্চাশের দশকে। ভর দুপুরে এমন ভয়ানক কাণ্ড ঘটিয়ে বেশিদূর যেতে পারল না জারবাতি। পরিত্যক্ত রূপম সিনেমা হলে আশ্রয় নেয় সে।
বৌবাজারে ভর দুপুরে এই ঘটনা ঘটে যায়। পঞ্চাশের দশক, বৌবাজার তখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি। ঢিল ছোড়া দূরত্বে কলকাতা পুলিশের হেড কোয়ার্টার। পাশেই রাজ্যের প্রশাসনের হেড অফিস রাইটার্স। আর তার মাঝখানেই ঘটে গেল এমন ঘটনা। ভর দুপুর বেলায় বৌবাজারের মতো জায়গায় এমন ঘটনা ঘটায় চাপ বেড়ে গেল পুলিশ প্রশাসনের। রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠে গেল। পুলিশের তৎপরতা তুঙ্গে উঠল।
এদিকে ঘটনার দু'দিন পেরিয়ে গেল। ধরা পড়ল না দুষ্কৃতী। আত্মগোপন করেই আটচল্লিশ ঘণ্টা কাটিয়ে দিল জারবাতি। শিউ প্রসাদের দেখা নেই। আটচল্লিশ ঘণ্টা পেরোতেই যেন আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে উঠল জারবাতির, ভাবটা এমন, তাকে আর কে ধরবে! পরিত্যক্ত সিনেমাহলের ভেতর ইতিউতি ঘুরতে শুরু করল সে। বাইরে তখন ব্যস্ত শহর।
রূপম সিনেমাহলের সামনে একটা ছোট চায়ের দোকান ছিল। চা দোকানের মালিক অল্পবয়সি এক ছোঁড়া। দু'দিন আগেই বৌবাজারে অতবড় কাণ্ড ঘটেছে। চায়ের দোকান সামলাতে সামলাতে সে হঠাৎ লক্ষ্য করে পরিত্যক্ত সিনেমা হলে কে যেন ঢুকে রয়েছে। ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না, তবে কেউ একটা রয়েছে। তার কেমন যেন দু'দিন আগের ঘটনাটার কথাটা মনে হলো। এদিকে তাকে যে কেউ নিশ্চুপে লক্ষ্য করছে, সে কথা মাথাতেই আসেনি কৃষ্ণের। নিশ্চিন্তেই ছিল সে। চাওয়ালা ছেলেটি পুলিশে খবর দেয়। জানায়, সন্দেহজনক ওই ব্যক্তির কথা। ধরা পড়ে যায় চাইনিজ ডন।
শ্যামলাল গুপ্তা মার্ডার মামলায় ফাঁসির সাজা ঘোষণা করে আদালত। কৃষ্ণের পাশে কেউ নেই, পয়সা নেই, উকিলের খরচ মেটানোর লোক নেই। সঙ্গী সাথীদের কারও দেখা নেই। গোপাল পাঁঠা, ভানু বোস, জগা বোস কেউ পাশে দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছে না কারণ খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির দু'হাত দূরে ভর দুপুরে এই খুন মুখ পুড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দলের। গোপালদের উপর বিধান রায় ক্ষেপে আছেন। জারবাতির পাশে কেউ দাঁড়ানোর সাহস করল না।
পালিত ছেলেকে শুধু ভুলে থাকতে পারলেন না পর্ক বিক্রেতা বাবা। ছেলের ফাঁসি রদ করাতে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে লাগলেন। ইন্ডিয়ান চৈনিক অ্যাসোসিয়েশনের লোকেদের ধরে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল কৃষ্ণ। বহু দরবারের ফলে ফাঁসি রদ হলো কৃষ্ণের, পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো জারবাতির। তারপর থেকে তার খবর আর কেউ রাখেনি। মলঙ্গা লেনের প্রবীণ মানুষজনের স্মৃতিতে বহু দিন বেঁচে ছিল কৃষ্ণ বাহাদুর নেপালি ওরফে জারবাতি ওরফে 'চাইনিজ ডন'। কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক ধূসর সেলিব্রিটি।