কলের গানেই নিহিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রেরণা, যে ইতিহাস অনেকেরই অজানা আজও
Mahishasuramardini: তিনের দশক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত দীর্ঘ এই সময়ে অনুষ্ঠানটির স্ক্রিপ্ট ,গান, গানের সুরও বদলেছে বারবার। বদলায়নি শুধু 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী'। তাঁকে ঘিরে বাঙালির আবেদন চিরন্তন ।
পিতৃপক্ষের শেষ, মাতৃপক্ষের সূচনা। বছরভরের অপেক্ষা কাটিয়ে মা দুর্গা আসছেন সুদূর কৈলাস থেকে বাপের বাড়ি। মহালয়া দিনটির সঙ্গে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণজল পৌঁছে দেওয়ার ধারণা বা রীতি বাঙালির দীর্ঘদিনের। তবে সেই অদ্ভূত ব্রহ্মমুহূর্তকে বাঙালির শারদোৎসবের দোসর করে তোলার মধ্যে জেগে রইল বেতারের একটি অনুষ্ঠান। এত বছর পরেও যার আবেদন কমেনি একফোঁটাও। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেডিও ক্রমশ গুরুত্ব হারিয়েছে আমবাঙালির জীবনে। তবু এই একটি মাত্র দিন বাঙালি তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে নামিয়ে আনে আদ্যিকালের সেই যন্ত্রটিকে। হ্যাঁ, ইউটিউব থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্রই এক ক্লিকে মিলবে সেই অনুষ্ঠানের রেকর্ডেড সংস্করণ। তবু কুসুম কুসুম আলো ফোঁটা ভোরে রেডিওর বিজ্ঞাপনের কুয়াশা ঠেলে সেই অমোঘ 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' সঙ্গীত-বীথির ঘোষণাই যে বাঙালির কাছে মহালয়ার অন্য নাম, তাতে সন্দেহ নেই। কার্যত সারা বিশ্বের বেতার সম্প্রচারের ইতিহাসে এমন কৃতিত্ব বা জনপ্রিয়তা আরও কোনও অনুষ্ঠানের রয়েছে কিনা বলা দুষ্কর। আজও মহালয়ার ভোরে বাণীকুমারের রচনা, পঙ্কজ মল্লিকের সুর এবং বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গ্রন্থনায় সেই প্রভাতি অনুষ্ঠানই বাঙালির শারদোৎসবের শুভ মহরৎ ঘটায় প্রতিটা বছর। তবে কলকাতা বেতারে প্রভাতি অনুষ্ঠানের সূচনা কিন্তু আদৌ এই 'মহিষাসুরমর্দিনী' দিয়ে হয়নি।
১৯২৭ এর ২৬শে অগষ্ট তারিখে,ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বেতার কেন্দ্র হিসাবে পথ চলা শুরু করল কলকাতা বেতার। ডালহৌসি স্কোয়্যারের পশ্চিমে, নির্জন পরিবেশে মাসিক আটশো টাকা ভাড়ায় পাঁচ বছরের লিজে ভাড়া নেওয়া হয়েছিল ১ নম্বর গারস্টিন প্লেসের পুরনো বাড়িটির দোতলা ও তিনতলাটি। সেই বেতারকেন্দ্রের দ্বারোদঘাটন করলেন গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন সুলতান চিনয়। স্টেশন ডিরেক্টর নিযুক্ত হন সি সি ওয়ালিক এবং ভারতীয় অনুষ্ঠানের পরিচালক, বিশিষ্ট ক্ল্যারিওনেট বাদক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। ঘোষণা ও সংবাদপাঠের জন্য নিযুক্ত হন ১৯১১-র আইএফএ শিল্ড বিজয়ী মোহনবাগানের হাফব্যাক্ রাজেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। তারপর ওই একই বছর, কলকাতা বেতারে একে একে যোগ দেন রাইচাঁদ বড়াল, হীরেন বসু, নলিনীকান্ত সরকার, বেহালার জমিদার-তনয় বীরেন রায় প্রমুখ। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯২৮-এর শেষের দিকে ‘চিত্রা সংসদ’-এর সদস্য হয়ে যোগ দেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য (বাণীকুমার), বিজন বসু প্রমুখ গুণী ব্যক্তিরা। পঙ্কজকুমার মল্লিক অবশ্য কর্মী হিসেবে নয়, যোগ দিয়েছিলেন সংগীতশিল্পী হিসেবে।
আরও পড়ুন: মুসলমানের বাজনায় মহালয়ার ভোর! সম্প্রীতির অনন্য নজির ‘মহিষাসুরমর্দিনী’
তো এহেন সব দিকপাল ব্যক্তিত্বরা বেতারের জন্মলগ্ন থেকেই নিরলস চেষ্টা করে যেতেন ভিন্নধারার আকর্ষণীয় সমস্ত অনুষ্ঠান প্রযোজনার। যাতে আমবাঙালির অভ্যাসে, মননে মিশে যেতে পারে রেডিও নামক এই নয়া মাধ্যমটি। কলকাতা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাক পর গানের রেকর্ডের চাহিদা বাড়তে শুরু করল। হিজ মাস্টার্স ভয়েস অর্থাৎ এইচএমভি-র উদ্যোগে তখন বাজারে মুক্তি পেয়ে চলেছে একের পর এক সুপারহিট রেকর্ড। সেই সময়কার জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে একজন ছিলেন হীরেন্দ্রকুমার বসু। গায়ক হওয়ার পাশাপাশি সুরকার ও গীতিকার হিসেবেও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো। একাধারে ছিলেন ছবিনির্মাতা এবং সাহিত্যিকও বটে। তাঁরই প্রযোজনায় এইচএমভি থেকে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হল 'প্রভাতে আশ্রম দৃশ্য' নামের একটি রেকর্ড। ভোরবেলায় পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত আশ্রমে যে আধ্যাত্মিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়, সেটাই ছিল সেই প্রভাতি উৎসবের ভিত্তি। আর কার্যত সেই অনুষ্ঠানই পরবর্তীকালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রভাতী অনুষ্ঠান করার চিন্তাভাবনাকে উস্কে দিয়েছিল।
মহিষাসুরমর্দিনীর আগেও একাধিকবার ভোরে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছে বেতার-তরঙ্গে। এরই মধ্যে 'প্রভাতে আশ্রম দৃশ্য' রেকর্ডটি শুনে মুগ্ধ হয়ে স্টেশন ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার হীরেন্দ্রকুমার বসুকে অনুরোধ করলেন, অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ভোরবেলায় সম্প্রচারের জন্য অনুরূপ একটি অনুষ্ঠান রচনা করতে। তবে তখনও বেতারে অনুষ্ঠান রেকর্ডের কোনও ব্যবস্থা নেই। এমনকী গালার চাকতির আগমনও সেই সময় বেতারে ঘটেনি। ফলে সমস্ত অনুষ্ঠানই গারস্টিন প্লেসের স্টুডিও থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হত বেতার-তরঙ্গে।
১৯৩০ সালের জুন মাসের এক ভোরে চারটে নাগাদ আয়োজন করা হল কলকাতা কেন্দ্রের ইতিহাসের সর্বপ্রথম প্রভাতি অনুষ্ঠান 'প্রভাতি'-র। কার্যত এটিই হল বর্তমান মহিষাসুরমর্দ্দিনী অনুষ্ঠানের পূর্বসূরি। ডালহৌসি স্কোয়ারের পশ্চিমে কলকাতা কেন্দ্রের সেই পুরনো ভবনটি, সেই ১ নম্বর গারস্টিন প্লেসের আশপাশটা বরাবরই ছিল নির্জন ও গাছগাছালিতে ভরা। পরবর্তী কালে এই গারস্টিন প্লেসের বেতারকেন্দ্রটি নিয়ে নানা ভূতুড়ে গল্পগাছা শোনা গিয়েছে। বলাই বাহুল্য, এখনও শোনা যায়। সেই গারস্টিন প্লেসের বেতারকেন্দ্রে বসেই সম্প্রচারিত হল কলকাতা বেতার কেন্দ্রের প্রথম প্রভাতি অনুষ্ঠান। কোনওরকম কৃত্রিমতার পরশ যাতে সে অনুষ্ঠানকে ছুঁতে না পারে, সে কথা মাথায় রেখে স্টুডিওর একটি মাইক্রোফোন জানলার বাইরের অভিমুখে রেখে ফেড-ইন করে দেওয়া হল। ভোরের পাখির কিচমিচ, আবহসঙ্গীতের সঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গ্রন্থনা ও মিস আভাবতীর কণ্ঠের জাদু এমন ভাবে শ্রোতার মনকে নাড়া দিয়েছিল যে ১৯৩২ সালে বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পুজোর সন্ধিক্ষণে সম্প্রচারের জন্য বাণীকুমার রচনা করলেন আরও একটি সংগীতালেখ্য—'বসন্তেশ্বরী'। এই বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত পরিচালনা করেন রাইচাঁদ বড়াল। পন্ডিত হরিশচন্দ্র বালী ও পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুর ওই অনুষ্ঠানে যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা করল। বলাই বাহুল্য, সেই অনুষ্ঠানও ছুঁয়ে গেল শ্রোতার মন।
যেখানে অবস্থিত ছিল ,শোনা যায় রেডিও অফিসের পাশাপাশি তেনাদেরও বসবাস ছিল যেখানে । অনুষ্ঠানে কৃত্রিমতাকে বর্জন করার উদ্দেশ্যে সেই ভোররাতে স্টুডিওর একটি মাইক্রোফোন জানলার বাইরের অভিমুখে রেখে ফেড-ইন করে দেওয়া হল। বাইরে ভোরের পাখির অকৃত্রিম কলতান, আবহসঙ্গীতের সঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গ্রন্থনা ও মিস আভাবতীর কণ্ঠের জাদুতে সেই অনুষ্ঠান এমন ভাবে শ্রোতার মনকে নাড়া দিয়েছিল যে ১৯৩২ সালে বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পুজোর সন্ধিক্ষণে সম্প্রচারের জন্য বাণীকুমার রচনা করলেন আরও একটি সংগীতালেখ্য-বসন্তেশ্বরী। এই বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত পরিচালনা করেন রাইচাঁদ বড়াল। পন্ডিত হরিশচন্দ্র বালী ও পঙ্কজকুমার মল্লিকের দেওয়া সুরে গীত হয়েছিল ওই অনুষ্ঠানের সকল গান।তবে জানা যায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছাড়াও আলেখ্যটিতে নাকি চন্ডীপাঠ করেছিলেন বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য ওরফে বাণীকুমার স্বয়ং!এই অনুষ্ঠানও ছুঁয়ে গেল শ্রোতার মন।
এবার বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসবে শ্রোতাদের উপহার দিতে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজনে উঠেপড়ে লাগলেন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার-সহ অন্যান্যরা। পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর সহায়তায় এই অনুষ্ঠানেরও স্ক্রিপ্ট রচনা করলেন বাণীকুমার। গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বেশিরভাগ গানের সুর পঙ্কজকুমার মল্লিক দিলেও পন্ডিত হরিশচন্দ্র বালিও কয়েকটি গানের সুর দিয়েছিলেন। সাগির খাঁ-র সুরে গাওয়া হল 'শান্তি দিলে ভরি' ও রাইচাঁদ বড়ালের সুরে 'নিখিল আজি সকল ভোলে'। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, এই অনুষ্ঠানের বর্তমান বহুল প্রচলিত সংস্করণে আরও অনেক গানের মত এই গানটিও শোনা যায় না। ১৯৩২ সালের মহাষষ্ঠীর ভোরে সরাসরি সম্প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটির নাম অবশ্য 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' ছিল না। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৬ সাল, মোটামুটি এই সময়কালের মধ্যে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারের দিনের বদলও ঘটেছে কয়েকবার। কখনও মহাষষ্ঠীর ভোরে, কখনও আবার মহালয়ার ভোরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা নামে সম্প্রচারিত হয়েছে এই অনুষ্ঠান।
১৯৩৬ সালের মহাষষ্ঠীর ভোরে সর্বপ্রথম 'মহিষাসুর বধ' নামে ভোর ছ'টা থেকে সাড়ে সাতটা অর্থাৎ দেড় ঘন্টা দৈর্ঘ্যের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পরের বছর থেকে অনুষ্ঠানটির নাম পাকাপাকিভাবে 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' রেখে দেওয়া হল। ঠিক হল, প্রতিবছর মহালয়ার ভোরেই সম্প্রচারিত হবে সেই বিশেষ প্রভাতি অনুষ্ঠান। ১৯৩২ সালের শুরুর দিনটি থেকেই অনুষ্ঠানটির মধ্যে ফুটে উঠেছিল ভারতবর্ষের একান্ত নিজস্ব সুমহান সংস্কৃতি। যেখানে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের কোনও ভেদাভেদ ছিল না। দক্ষিণামোহন ঠাকুর, তারকনাথ দে, রাইচাঁদ বড়ালদের সঙ্গে যন্ত্রসংগীতে ছিলেন মুন্সি,আলি, খুশি মহম্মদেরাও। লাইভ সম্প্রচারের সেই যুগে এডিটিংয়ের কোনও জায়গা নেই। অনুষ্ঠানের দিন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবেই মুসলমান যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীরা সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পেরে সংস্কৃত শ্লোকের পাশাপাশি বাংলা গ্রন্থনার সময়ে ভুলবশত বাজিয়ে গিয়েছিলেন সুর। সেই সুর আট থেকে আশির মন জয় তো করলই, পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানের মিলনের সুর হয়েও এক উৎসবের পটভূমি তৈরি করে দিল মহালয়ার ওই ভোরে।
মহালয়ার সেই অনুষ্ঠান জুড়ে চাঁদের হাট। পঙ্কজ মল্লিক,বিমলভূষণ, মানিকমালা, প্রফুল্লবালা দেবী, কে নেই সেখানে। ততদিনে প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলেছে সেই অনুষ্ঠান। তার মধ্যে প্রায় প্রতি বছরই স্ক্রিপ্টের মধ্যে নানা বদল আনতে লাগলেন বাণীকুমার-পঙ্কজ মল্লিকেরা। সংযোজন ও বিয়োজন ঘটতো অনেক অংশের,পুরোনো গানের বদলে রচিত হত নতুন নতুন গানও। পঙ্কজ কুমার মল্লিকও অনেক গানে নতুন ভাবে সুরারোপ করতেন। বদলে যেতেন শিল্পীও। এই জন্যই পুরোনো শিল্পীর বদলে এই বিশেষ অনুষ্ঠানে নানান সময়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, শৈলদেবী, রাধারানী, সাবিত্রী ঘোষ, সুপ্রভা সরকার, সুপ্রীতি ঘোষ, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, বাঁশরী লাহিড়ী, অম্বুজ কুমার মল্লিক, আরতি মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু-সহ অগণিত বহু শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন।
বাঙালির এই প্রাণের প্রভাতি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গুজবও কম নেই। শোনা যায়, কোনও এক বছর নাকি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বদলে এই অনুষ্ঠানে চন্ডীপাঠ করেছিলেন নাজির আহমেদ নামের এক ব্যক্তি। অনুষ্ঠানটির স্রষ্টারা অনুষ্ঠানটিতে নানাবিধ বদল ঘটালেও বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ ও নথি ঘেঁটে বলা যায় যে এরকম কোনও ঘটনা কোনদিন ঘটেনি। তবে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠানটির নানান ভাবে বদল ঘটানোর জন্য গুটিকয় ব্যক্তির সমালোচনাও শুনতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র লিখছেন— "কিন্তু সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে যে অভিনন্দন পাওয়া যায়, তার তুলনায় তিক্ত অসন্তুষ্ট কণ্ঠের নিন্দা,অতি সামান্য ও ক্ষীণ।" সমালোচনার মুখে পড়তে হলেও তাঁরা কখনও এই অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে পরীক্ষানিরিক্ষার রাস্তা থেকে সরে আসেননি। আজকের যে মহিষাসুরমর্দ্দিনীর বহুল প্রচলিত সংকলনটি আমরা শুনতে পাই, তা এই অনুষ্ঠানের রূপকারদের দীর্ঘ গবেষণার ফসল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আক্ষেপ করেছিলেন, রেকর্ড করার ব্যবস্থা থাকলে মহিষাসুরমর্দ্দিনীর একটি অপূর্ব সংকলন তৈরি হতে পারতো। গারস্টিন প্লেসে রেডিও অফিস থাকাকালীন একবারই ১৯৪৬ সালে এই অনুষ্ঠানটির সরাসরি সম্প্রচার করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জর্জরিত কলকাতায় ভোররাতে রেডিও অফিসে শিল্পীদের আসা নিরাপদ ছিল না। সেইবার মহালয়ার ভোর রাতে আগে থেকে রেকর্ড করে রাখা মহিষাসুরমর্দ্দিনী সম্প্রচার করা হয়। তবে গালার চাকতির সেই রেকর্ডটি ওই বছরই নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে গারস্টিন প্লেস থেকে কলকাতা কেন্দ্রের অফিস ইডেন গার্ডেন্সের বর্তমান আকাশবাণী ভবনে স্থানান্তরিত হবার পরও এই অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হত।
ছয়ের দশকের শুরু থেকেই মহিষাসুরমর্দ্দিনীর লাইভ ব্রডকাস্ট টেপের স্পুলে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।তবে তারপর থেকে লাইভ ব্রডকাস্ট আর বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।১৯৬২ সালেই এই বিশেষ প্রভাতি অনুষ্ঠান শেষবারের মত সরাসরি সম্প্রচার করা সম্ভব হয়। নথি বলছে, বাষট্টি সালে শেষবারের লাইভ অনুষ্ঠানে কণ্ঠসংগীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন সুমিত্রা সেন, বাঁশরী লাহিড়ী, সুপ্রীতি ঘোষ, কৃষ্ণা দাশগুপ্ত, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরী মিত্র, অসীমা ভট্টাচার্য, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলবন্ধু ঘোষ, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, অরুণকৃষ্ণ ঘোষ, অম্বুজ কুমার মল্লিক, রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাত মিত্র, রবীন বসু ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের পরে অন্যান্য অনেক কিছুর মতো আকাশবাণীর বাজেটেও কাটছাঁট শুরু হয়। চিরকালের মত বন্ধ হয়ে যায় ভোর রাতে মহিষাসুরমমর্দ্দিনীর সরাসরি সম্প্রচার। ১৯৬৩ সালে মহালয়ার ভোর রাতে ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালের 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী'র লাইভ ব্রডকাস্টের একটি সম্পাদিত রূপ সম্প্রচার করা হয়। ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালেও এর অন্যথা হয়নি। ১৯৬৬ সালে আবার এই অনুষ্ঠানের নতুন রেকর্ড করা হয়। তার সঙ্গে লাইভ ব্রডকাস্টের কিছু অংশ জুড়ে তৈরি করা হয় একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলন।
আরও পড়ুন:মাত্র দেড়শো টাকা আর চূড়ান্ত অপমান! সেই মহালয়া উত্তমের কাছে ছিল অভিশাপের মতো
রেকর্ডিংয়ের যুগে মহালয়ার আগে কয়েকদিন ধরে রেকর্ডিং পর্ব চলত। মহালয়ার আগের রাতে আকাশবাণী ভবনে চলে আসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। দোতলার ড্রামা সেকশনের ঘরটায় সারা রাত একাই বসে অপেক্ষা করতেন ভোর রাতের জন্য। নজর রাখতেন অনুষ্ঠান প্রচারের সময় যাতে কোনও বিঘ্ন না ঘটে। সেসময় প্রযুক্তি এত আধুনিক হয়নি। ঘোষককে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হত দেড় ঘন্টার অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ দু'টি টেপের মধ্যে একটি থেকে আরেকটিতে যাওয়ার সময়। সেই জায়গায় ঢাক,কাঁসর,ঘন্টার শব্দ-যুক্ত আরতির আবহ এমনভাবে দুটটি টেপেই মিক্স করা হত যাতে দ্বিতীয় টেপে চেঞ্জ-ওভারের সময় দুটি টেপই ফেড-ইন করা থাকলে শ্রোতারা টেপ বদলের বিষয়টি না বুঝতে পারেন। সংগীত বিভাগের প্রোগ্রাম অফিসারের পাশাপাশি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রও সমানভাবে এইদিকে খেয়াল রাখতেন। সেই ১৯৬৬ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বার চারেক 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' রেকর্ড করা হয়েছে। প্রতিবছর রেকর্ডিংয়ের পর সম্পাদনা করে মহিষাসুরমর্দ্দিনীকে একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলনের রূপ দিতেন এই অনুষ্ঠানের এক বিস্মৃত-নায়ক,আকাশবাণীর সুধীর মুখোপাধ্যায়। ১৯৭৬ সালে মহালয়ার ভোরে প্রচারিত হল 'দেবীং দুর্গতিহারিনীম' অনুষ্ঠানটি। যে অনুষ্ঠানটিতে গ্রন্থনা করেছিলেন উত্তম কুমার, সুর দিয়েছিলেন খোদ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তবে সেই অনুষ্ঠানটি ভয়াবহ ভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন মানুষ। পরের বছর থেকে ফের মহালয়ার ভোরে বেতারে ফিরল চিরচেনা 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী'। সেই রূপটিই বাঙালি সর্বত্র শুনতে পায় আজ। যেমনটা আগেই বলেছি এই প্রচলিত সংকলনটি তৈরির আগেও বহুবার এই অনুষ্ঠানের নানান রদবদল করা হয়েছে। এই সংগীতালেখ্য থেকে অনেক বছর বাদ গিয়েছে বহু জনপ্রিয় গানও। তার বদলে জায়গা পেয়েছে ভিন্ন গান। আমাদের পরিচিত গানগুলি ছাড়াও মহালয়ার ভোর রাতে কখনও বেজে উঠেছে- 'মোহ আবরণ তোল', 'আকাশ যে মধুময় ছন্দে', 'জয় জয় পরমা শঙ্করী', 'নিখিল আজি সকল ভোলে', 'হে চারুপূর্ন সৌম্য শিখরিণী'র মতো এমন অনেক অজানা গান। লাইভ ব্রডকাস্টের যুগে যেহেতু একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত রেকর্ড করার ব্যবস্থা ছিল না তাই বলা যেতে পারে সেই সময়ের অনুষ্ঠানগুলি বিলীন হয়েছে কালের গর্ভে। আর মহিষাসুরমর্দ্দিনী অনুষ্ঠানের কিছু রেকর্ডিং ও সংকলনের পুরনো স্পুল আকাশবাণীর সংগ্রহশালায় রাখা আছে। টেপের ফিতে বেশিদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ভঙ্গুর হয়ে যায়। ফলে পরবর্তীকালে তা পুনরুদ্ধার করাও সম্ভব হয় না।
তবুও আকাশবাণীর নিরলস প্রচেষ্টায় ডিজিটালাইজেশনের ফলে এই বিশেষ অনুষ্ঠানের অনেক অজানা সংস্করণ শ্রোতাদের সামনে এসেছে। পঙ্কজ কুমার মল্লিকের নামাঙ্কিত ফাউন্ডেশনের প্রচেষ্টায়,বাণীকুমার ও পঙ্কজ কুমার মল্লিকের ব্যক্তিগত খাতা থেকেও উদ্ধার হয়েছে 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী'র কিছু পুরনো সংস্করণের রূপ। তিনের দশক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত দীর্ঘ এই সময়ে অনুষ্ঠানটিতে স্ক্রিপ্ট ,গান, গানের সুরও বদলেছে বারংবার। বদলায়নি শুধু 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী'। তাঁকে ঘিরে বাঙালির চিরন্তন আবেদন। তাই আজও মহালয়ার ভোরে ঘুম ভাঙায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই অপরাজিত কন্ঠস্বর— 'আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির।' নিয়ে আসে শরতের আলোমাখা আগমনী ভোর।