'আমরা শুধু সব ধর্মকে সহ্যই করি না...' ১৩০ বছর আগে শিকাগোয় ঠিক কী বলেছিলেন স্বামীজি?

Swami Vivekananda Chicago Speech 1893: "আমরাই ইহুদিদের খাঁটি বংশধরদের অবশিষ্ট অংশকে সাদরে বুকে করে রেখেছি",

১৮৯৩, ১১ সেপ্টেম্বর। ২০২৩ সালের হিসেবে সময়কাল ধরতে গেলে ঠিক ১৩০ বছর আগেকার একটি দিন। শিকাগোতে দাঁড়িয়ে স্বামীজি বললেন, “হে আমার আমেরিকাবাসী বোন ও ভাইয়েরা।" না এতটুকু যে তিনি বলেননি, স্বাভাবিক। কিন্তু আর ঠিক কী বলেছিলেন? বিবেকানন্দ সুদূর শিকাগোতে গিয়ে কী এমন বলেছিলেন যার পুরোটা বাদ পড়ে গিয়ে শুধু বেঁচে রইল এই একটি লাইন, "হে আমার আমেরিকাবাসী...” ভারতবর্ষ এখন শিক্ষা নিয়ে কমই ভাবে, ধর্ম নিয়ে উন্মাদনাকে চিরকালই পাশের বাড়ির সমস্যা বলেই মনে করে। ধর্ম হোক বা আত্মবোধ গভীরে বোধ থেকে খতিয়ে দেখতে ভুলে গিয়েই যত বিপত্তি, সবটুকু বাদ পড়ে কেবল ওই একটি লাইনে আমাদের স্বাভিমান গোঁত্তা খায়। অথচ একটু খোঁজখবর, একটু তলিয়ে দেখাই আমাদের স্বামীজির সেদিনের বক্তব্যের এমন এক নির্যাসের হদিশ দেবে যা এই সময়ের প্রেক্ষিতে আরেকবার ভাবতে বাধ্য করবে। ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোর ধর্ম মহাসম্মেলনে দাঁড়িয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বললেন, “আমি গর্বিত! কারণ আমি এমন এক ধর্মের মানুষ যা আমাদের বিশ্বকে সহনশীলতা আর গ্রহণশীলতা দুই'ই শিখিয়েছে। আমরা বিশ্ব শান্তিতেই বিশ্বাস করি না, আমরা সকল ধর্মকেই সত্য বলে গ্রহণ করি।” (I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all religions as true.)

শিকাগোতে ধর্ম মহাসম্মেলনে স্বামীজি ঠিক কী বলেছিলেন?

"হে আমেরিকাবাসী বােন ও ভাইয়েরা, আপনারা আমাদের যে আন্তরিক ও সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, তার উত্তরে কিছু বলতে উঠে আমার হৃদয় অনির্বচনীয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সন্ন্যাস সঙ্ঘের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সব ধর্মের যিনি জননী স্বরূপ, তাঁর নামে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর ধন্যবাদ জানাচ্ছি সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের কোটি কোটি হিন্দু নরনারীর পক্ষ থকে।

এই সভামঞ্চের কয়েকজন বক্তা প্রাচ্যদেশের প্রতিনিধিদের সম্বন্ধে বলেছেন যে, দূরদেশ-আগত এইসব ব্যক্তিও বিভিন্ন দেশে সহিষ্ণুতার ভাবপ্রচারের গৌরব দাবি করতে পারেন-- আমার ধন্যবাদ তাঁদের প্রতিও। আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে গৌরব বােধ করি, যে ধর্ম জগৎকে শিখিয়েছে পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্বজনীন গ্রহীষ্ণুতার আদর্শ। আমরা শুধু সব ধর্মকে সহ্যই করি না, সব ধর্মকেই আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করি। যে ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভাষায় ইংরেজি ‘এক্সক্লুশন' শব্দটি অনুবাদ করা যায় না, আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ব অনুভব করি। আমি সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ব বোধ করি, যে জাতি পৃথিবীর সব ধর্মের ও সব জাতির নিপীড়িত ও শরণার্থী মানুষকে চিরকাল আশ্রয় দিয়ে এসেছে। আমি আপনাদের একথা বলতে গর্ব অনুভব করছি যে, আমরাই ইহুদিদের খাঁটি বংশধরদের অবশিষ্ট অংশকে সাদরে বুকে করে রেখেছি; যে বছর রােমানদের অত্যাচারে তাদের পবিত্র মন্দির ধ্বংস হয়, সেই বছরেই তারা দক্ষিণ ভারতে এসে আমাদের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। জরথুষ্ট্রের অনুগামী মহান পারসিক জাতির অবশিষ্ট অংশকে যে ধর্মের মানুষেরা আশ্রয় দিয়েছিল এবং আজ পর্যন্ত যারা তাদের প্রতিপালন করে আসছে, আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ব অনুভব করি।

আমি আপনাদের কাছে একটি স্তোত্রের কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করব, যেটি আমি খুব ছােটবেলা থেকেই আবৃত্তি করে আসছি এবং কোটি কোটি নরনারী নিত্য যেটি পাঠ করেন:

রুচীনাং বৈচিত্র্যাদজুকুটিলনানাপথজুষাং। নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামৰ্ণব ইব।

১—বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু তারা সকলেই যেমন এক সমুদ্রে তাদের জলরাশি ঢেলে দেয়, তেমনই হে ভগবান, নিজের নিজের রুচির বৈচিত্রের জন্য সরল-জটিল নানা পথ ধরে যারা চলেছে, তাদের সকলের একমাত্র লক্ষ্যস্থল তুমিই।

বর্তমান মহাসম্মেলন, যা পৃথিবীতে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত শ্রেষ্ঠ সম্মেলনগুলির অন্যতম, তা কিন্তু গীতা-প্রচারিত সেই অপূর্ব মতেরই সত্যতা প্রতিপন্ন করছে, গীতার এই বাণীই ঘােষণা করছে:

‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।'

২— যে যে-ভাব আশ্রয় করে আসুক না কেন আমি তাকে সেই ভাবেই অনুগ্রহ করে থাকি। হে অর্জুন, মানুষ সর্বতােভাবে আমার অভিমুখেই চলে।

সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি এবং তার ভয়াবহ ফলশ্রুতি ধর্মোন্মত্ততা বহুদিন ধরে এই সুন্দর পৃথিবীকে গ্রাস করে রেখেছে। জগৎকে তারা হিংসায় পরিপূর্ণ করেছে, মানুষের রক্তে পৃথিবীকে বারবার সিক্ত করেছে এবং জাতির পর জাতি এর ফলে হতাশায় নিমগ্ন হয়েছে। এই সমস্ত ভয়ঙ্কর পিশাচ যদি না থাকত, তাহলে মানবসমাজ এখনকার থেকে অনেক বেশি উন্নত হত। কিন্তু তাদের অন্তিমসময় উপস্থিত এবং আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, এই সম্মেলনের সম্মানে আজ সকালে যে ঘণ্টাধ্বনি হলো তা যেন সমস্ত ধর্মোন্মত্ততা, তরবারি অথবা লেখনীর সাহায্যে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রকার অত্যাচারের মৃত্যুঘণ্টা হয়; একই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে যেসব মানুষ, তাদের পরস্পরের মধ্যের সমস্ত অসদ্ভাবের সমাপ্তি ঘােষণা করুক ওই ঘণ্টাধ্বনি।"

বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হর্ষধ্বনিতে ভরে যায় ওই স্থান। শিকাগাের এই সম্মেলনের প্রথম দিনের বক্তৃতা স্বামীজি এবং ভারতের এক পরিচয়কে আমেরিকায় স্থাপন করে। যে হিন্দুধর্মের কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন, যেখানে সহিষ্ণুতার গান গেয়েছিলেন এবং 'এক্সক্লুশন' শব্দটি না থাকায় গর্বিত হয়েছিলেন, সেই ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার এবং এক্সক্লুশনের অস্ত্রই কি করে তোলা হলো না? যে হিন্দুধর্মে গর্ব খুঁজে পেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, যে ধর্ম দিয়ে মন জয় করেছিলেন আমারিকাবাসী ভাই ও বোনেদের- সেই ধর্মই ব্যুমেরাং হয়ে আস্ত ভারতীয় সংস্কৃতি ও রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠল কালে কালে। ১৩০ বছর আগে বিবেকানন্দ বললেন, “সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা এবং তার ভয়ঙ্কর বংশধর ধর্মান্ধতা দীর্ঘকাল ধরে এই সুন্দর পৃথিবীকে হিংসায় ভরিয়ে তুলছে, মানুষের রক্তে ভরিয়ে তুলছে। সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।” অবাক লাগে, এই ২০২৩-এ দাঁড়িয়ে ঠিক কী বলতে হতো তাঁকে?

More Articles