ধনঞ্জয়কে ফাঁসি দিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন নাটা মল্লিক! কেমন হয় জল্লাদের জীবন?

Hangman Nata Mullick: ধনঞ্জয়ের কাছ থেকে কোন প্রতিরোধ পাননি তিনি, উল্টে তাঁকে সবরকম সহযোগিতা করেছিলেন ধনঞ্জয়। বিষয়টা অস্বাভাবিক তো বটেই, অপ্রত্যাশিত ছিল।

দীর্ঘ ২৫ বছরের চাকরি। বহু ফাঁসি। রাজ্যে কোনও ভয়াবহ অপরাধের বিচারপর্বে, সাজাঘোষণার আগে-পরে তাঁকে নিয়ে আজও চর্চা হয়। অথচ তিনি নেই আজ ১৬ বছর হয়ে গেল প্রায়। ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিক প্রয়াত হন ২০০৯ সালে, ৮৯ বছর বয়সে। তবু, বঙ্গদেশে ফাঁসির সম্ভাবনা আজও তাঁর নাম ভাসিয়ে তোলে সংবাদের শিরোনামে। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে চাকরি করতেন নাটা মল্লিক। একজন মানুষ, যিনি আরেকজন মানুষকে সরকারি অনুমতিতে ফাঁসি দেন, তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর জীবন স্বাভাবিকভাবেই অন্যের কাছে আকর্ষণের। সাধারণ মানুষের মন জানতে চেয়েছে নাটা মল্লিকের ফাঁসি দেওয়ার নানা অভিজ্ঞতা। জানতে চেয়েছে, ফাঁসি দেওয়ার সময় অনুতাপ গ্রাস করত কিনা তাঁকে। আরজি কর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে সঞ্জয় রায়ের সাজা ঘোষণার আগে তাই আবারও তাঁর কথা উঠে আসছে।

নাটা মল্লিকের বাবাও ছিলেন ফাঁসুড়ে। শিবলাল মল্লিক। তিনিও প্রায় কয়েকশো ফাঁসি দিয়েছিলেন, সবই স্বাধীনতার আগে। ছোটবেলায়, স্বাধীনতা সংগ্রামী সূর্য সেনকে ব্রিটিশ সরকার যখন ফাঁসি দিয়েছিল তখন জল্লাদ দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন নাটা মল্লিক। শোনা যায়, এর জন্য সারা জীবন অনুতপ্ত বোধ করেছিলেন নাটা। নাটা মল্লিকের ছেলে মহাদেব পরে জানিয়েছিলেন যে তিনি শুনেছেন সূর্য সেনের ফাঁসির পর তাঁর দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ওই ফাঁসির পর আর কাজে ফিরে আসতে পারেননি তিনি।

আরও পড়ুন- ধনঞ্জয়-সঞ্জয় একই মুদ্রার দুই পিঠ? ৩৪ বছর আগের ঘটনা কেন এত প্রাসঙ্গিক?

জানা যায়, হেতাল পারেখকে ধর্ষণ ও হত্যার জন্য ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে ফাঁসি দেওয়ার পরে, ৮৪ বছরের প্রবীণ জল্লাদ নাটা মল্লিক বিধ্বস্ত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। যাঁর কাছে ফাঁসি দেওয়াই পেশা, কেন ধনঞ্জয়ের ফাঁসিতে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি? কর্মজীবনের শেষ ফাঁসি ছিল ধনঞ্জয়ের মৃত্যুর ঘটনাটিই। সেই সময় নাটা মল্লিকও নিজের এমন ভেঙে পড়ার প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারেননি। কেবল জানিয়েছিলেন, ধনঞ্জয়ের কাছ থেকে কোন প্রতিরোধ পাননি তিনি, উল্টে তাঁকে সবরকম সহযোগিতা করেছিলেন ধনঞ্জয়। বিষয়টা অস্বাভাবিক তো বটেই, অপ্রত্যাশিত ছিল।

নিয়ম অনুযায়ী, ফাঁসির পর দেহ নামিয়ে দেওয়ার আগে বাধ্যতামূলকভাবে ৩০ মিনিট ওভাবেই ঝুলিয়ে রাআখতে হয়। নাটা মল্লিকই সাধারণত মৃতদেহ নামিয়ে আনতেন। ধনঞ্জয়ের ক্ষেত্রে তিনি তা করতে চননি। মৃতদেহ নামিয়ে আনতে নির্দেশ দিয়েছিলেন নিজের দুই ছেলে এবং এক নাতিকে। ভারতে বক্সার জেলে ফাঁসির দড়ি তৈরি হয়, সেই ১৯৩০ সাল থেকেই। সূর্য সেনের ফাঁসির দড়িও বক্সার জেল থেকেই এসেছিল। মেশিনে এই দড়ি তৈরি করেন জেলের কয়েদিরাই। নাটা মল্লিক মোট পঁচিশটি ফাঁসি দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার আগে কুড়িটা, পরে পাঁচটা। শেষ ফাঁসি দেওয়া ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে, ২০০৪ সালে।

আরও পড়ুন- আরজি কর ধর্ষণ কাণ্ডে চূড়ান্ত রায়ে একমাত্র দোষী সঞ্জয় রায়! কী সাজা?

নাটা মল্লিকের ছেলে মহাদেব অভিযোগ করেছিলেন, প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তাঁর বাবাকে চিকিৎসার জন্য কখনও টাকা দেয়নি সরকার। শেষদিকে বয়সের কারণে নাটা মল্লিক আর কাজ করতে পারতেন না। তখন একটি তথ্যচিত্র থেকে নাটা যে আয় করেছিলেন তা দিয়েই সংসার চালাতেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা জোসি জোসেফের 'ডে ফ্রম আ হ্যাংম্যানস লাইফ' বলে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন। ১৯৯০ সালের হেতাল পারেখ ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্তের ফাঁসির সাজা হয়। ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসির সময় নাটা মল্লিকের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়েই ওই ৮৩ মিনিটের তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছিল।

নাটা মল্লিক নেই। ফাঁসুড়ের কাজ করেন তাঁর পুত্র মহদেব। তবু, এই বাংলার শেষ ফাঁসির সাজা বাস্তব করেছিলেন যিনি, সেই নাটা মল্লিকের কথা কী ভীষণ জ্যান্ত আজও! পেটের তাগিদেই ফাঁসুড়ে হয়েছিলেন যিনি, শেষ ফাঁসিতে ভেঙে পড়েছিলেন খোদ সেই জল্লাদই! মায়া-মমতাহীন বিশেষণে জল্লাদ শব্দটা কি ঠিক মানানসই হলো আর?

More Articles