আমরা কাশ্মীরের 'আপনা আদমি' হতে পারি না?
Kashmir: অবাক হয়েই জানতে চাইলাম, "আপ মুসেওয়ালা কো শুনতে হো?" গানের মাঝে বাধা পাওয়া বিরক্ত ইব্রাহিম বলে উঠলেন, "শুনেঙ্গে নেহি? ও আপনা আদমি হ্যায়।"
মানসবল লেকের জল রুপোর আয়নার মতো, পাহাড়ের ছায়া ছাড়া তাতে আর বিশেষ ধারাপাত নেই। সন্ধে নামলে গাঢ় কমলায় ঢেকে যায় প্রথমে, তারপর চিনার চুড়ো ছুঁয়ে রাত নামে; ঝপ করে এক মুঠো অন্ধকার গিলে নেয় লেকের জল, পাহাড়ের ছায়া আবছায়া হয়ে মিশে যায় জলের অতলে। জোনাকির মতো একটা-দুটো সরকারি বাংলোর আলো জ্বলে ওঠে, দূরে।
ফিরোজ ভাইয়ের ট্রাভেরা এতক্ষণে "তু প্যায়ার হ্যায় কিসি অওর কা" সুরে স্টিয়ারিং ধরে ফেলেছে, ওর কাশ্মীরি উচ্চারণে হিন্দি গান কানে অন্যরকম শোনায়, ভালো বা খারাপ না, অন্যরকম। যেমন আমার বাবার ভাঙাচোরা হিন্দি, কোথাও দরদাম করতে গেলে বলে "একঠো কমতি কর দো"! আমায় বলে বোঝতে হয় যে, দাম কম করতে বলছে। ফিরোজ ভাই এই ক'দিনে বাবার ভাঙাচোরা বাংলা বুঝতে শিখেছে, বাবাও ফিরোজ ভাইয়ের কাশ্মীরি টানে উর্দু মেশানো হিন্দিতে মজা পেয়ে গেছে। ফিরোজ ভাই অনেক কথা বলেন, কখনও কাশ্মীরি ইতিহাস, ৪৭-৬২-৮৭ ঘুরে ফিরে আসে তাঁর কথায়, রাজনীতির কারবারিদের কথা বলেন, ক্ষোভ রাগ উগরে দেন, কারা মুখে আজাদির কথা বলত অথচ নিজের ছেলেমেয়েদের সরকারি চাকরি করতে পাঠাত, মাথার শিরা দপদপ ওঠে ওঁর উত্তেজনায়। 'কমরেডন' তারিগামীর কথা বলার সময় গলা উঁচু হয় একটু। সব নেতারা বাংলো-হোটেল বানিয়েছে, আর তারিগামীকে দেখো নিজের বাড়িটাও ঠিক বানায়নি! সব নেতা ইডি-সিবিআইয়ের ভয়ে চুপ করে যায়, কিন্তু "কমরেডওন কো কিসি বাত কা ডর নহি, এক পয়সা নহি খায়া উসনে, আপনা আদমি হ্যায়।" কী অদ্ভুত বিশ্বাস ভেসে ওঠে ওঁর উচ্চারণে। সেক্রেটারিয়েট ক্রস করতে করতে আপন মনেই বিড়বিড় করে, আগে এখানে ইন্ডিয়ার পাশাপাশি কাশ্মীরের ঝান্ডাও উড়ত, এখন খালি ইন্ডিয়ার। দীর্ঘশ্বাস বাড়ে, আরও আস্তে আস্তে ফিরোজ বলে ওঠেন, "আমরা তো ইন্ডিয়ার সঙ্গেই ছিলাম।" পরের কথাগুলো আর বলেন না ফিরোজ। আমাদের বলেন না। ভয়? সংকোচ? অবিশ্বাস? গানের ভলিউম বাড়িয়ে দেন ফিরোজ, আর গলা মেলান না।
আরও পড়ুন- ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: কাশ্মীর বৈরিতার যে ইতিহাসে দাঁড়ি পড়েনি আজও
মানসবলের অন্ধকার চিরে এখন আমরা এগোচ্ছি 'কমরেডন' মাজিদ সাহাবের বাড়ির দিকে। ওঁর বাড়িতে আজ রাতে আমরা তাঁর মেহমান। মাজিদের ৬ বছরের মেয়ে মেহনুর অধীর অপেক্ষায় বসে আছে সেখানে, ওর ভাই জুবেইর ক্লাস ৫-এ পড়ে। আপেল রাঙা মুখ দুই ভাইবোনের। আপাত লাজুক কিন্তু চোখ বলছে, সুযোগ পেলে এরাও আমাদের বাড়ির লেজকাটা হনুমানগুলোর চেয়ে কিছু কম যাবে না। কাবাহ আর বাড়িতে তৈরি বিস্কুট এসেছে আমাদের জন্য, কাশ্মীরি লাল কার্পেটের উপর ফুলের নকশা করা কম্বল পাতা, মেহমানদের জন্য কাঙড়ি, ঠান্ডা কমাতে বেতের সাজিতে আধো নিভু কয়লার কোনও বিকল্প নেই। মাজিদের ভাই এসে বসেছেন আমাদের সঙ্গে, ওঁর মা-বাবাও একটু পরেই। মাজিদ সাহেবের ভাই পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর, বন বিভাগে চাকরি করেন। দেওয়াল জোড়া উর্দু, ইংরেজি বই দেখিয়ে বললেন, "এসব বই মাজিদ পড়ে। আমি এত পড়তে পারি না। কমরেড লোগ বহত কাবিল হোতে হ্যায়"। মেহনূর এর মধ্যে আঁকার খাতায় চিনার পাতা এঁকে ফেলেছে, জুবেইর ইউটিউবে ক্রিকেটের রিলস দেখছে। কাকার কথায় চোখ তুলে তাকিয়েছে একবার, পরক্ষণেই মহম্মদ সামির দুর্দান্ত বোলিংয়ে মাথা ডুবিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ক্রিকেট পছন্দ? মাথা নেড়েছে চোখ না সরিয়েই। ফেভারিট প্লেয়ার? মনে হলো, প্রথমটা শুনল না। আরেকবার বলাতে বড় দ্বিধা নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, "আফ্রিদি"। আমি চোখ ছোট করে বললাম, "পুরানা ইয়া নয়া?" আরও আস্তে আস্তে জবাব দিল, "শাহিন আফ্রিদি"। আমি ভাবতে লাগলাম, আমার প্রজন্মের কাউকে ব্রেট লি বা তার আগের প্রজন্মের কাউকে ব্রায়ন লারা বলতে গলায় এই কুণ্ঠা, এই উদ্বেগ আমি শুনেছি কিনা? এই উদ্বেগ কি পরিচিতির? এই দ্বিধা কি রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদের ফলশ্রুতি? আমাকেও কি এই রাষ্ট্রের, সংখ্যাগুরুর একজন হিসাবে দেখে? আমি কি ওর আব্বার কমরেডন হয়ে উঠতে পারিনি এখনও?
রাতে খাবার খেতে খেতে মাজিদ কমরেড বলছিলেন, কোভিডের সময় মালদার কিছু শ্রমিক আটকা পড়েছিলেন গান্ডয়ালে। এক তৃণমূল মন্ত্রীর ফোন আসে কমরেড তারিগামীর কাছে, মাজিদ ভাই আর তাঁর বন্ধুরা, কমিউনিস্ট পার্টি দায়িত্ব নেয় সব্বার। খাওয়া-দাওয়া, থাকা, বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা কমতি হয়নি কোনও কিছুর। কাশ্মীরে পার্টির শক্তি কম, সেপারেটিস্ট এবং রাষ্ট্রযন্ত্র দু'জনের বিরুদ্ধেই আপোষহীন লড়াই আছে, কঠিন লড়াই, তবে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই। কমরেড মাজিদ, কমরেড তারিগামীরা এই লড়াইয়ে আছেন, নিরবচ্ছিন্নভাবেই। মাজিদ ভাইরা স্বপ্ন দেখেন মেহনূরদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যতের, "ওয়াদিকে মৌসম ভি, একদিন তো বদলেঙ্গে"। শান্তি বলতে ওরা শ্মশানের শান্তি বোঝেন না। বন্দুক হাতে পাহারাদার ভারী বুটের আওয়াজ থেমে যাক চান, লাল চৌকে কাজের দাবিতে মুখরিত মেহনতির আওয়াজ শুনতে চান, ঈদ-দিওয়ালি-বড়দিনে ঝলমলে লেকের জলে শিকারাতে শুনতে চান "সোচো কে ঝিলোঁ কা শহর হো"। ওদের ভালো থাকার লড়াইয়ে আমাদের পাশে চান, স্বজন হিসাবে, আপনা আদমি হিসাবে।
পহেলগাঁওয়ের ঘোড় সওয়ার ইব্রাহিম এক হাতে বুলবুলের লাগাম ধরে ছিলেন। মাঝে মাঝে আদর করে ওকে 'বাচ্ছা' বলে ডাকছিলেন। বুলবুলও বাধ্য ছেলের মতো পাহাড়-পাথর পেরিয়ে যাচ্ছিল সন্তর্পণে। হঠাৎ দেখি ইব্রাহিমের ছোট মুঠোফোনে, কর্কশ আওয়াজে বেজে উঠছে পঞ্জাবি গানের কলি, দিল্লি প্রবাসী কান আরও একটু কান পেতে শুনে নিয়েছে চেনা আওয়াজ। সিধু মুসেওয়ালার "Nitt controversy create milugi/Dharman de naam te debate milugi" বাজছে। একটু অবাক হয়েই জানতে চাইলাম, "আপ মুসেওয়ালা কো শুনতে হো?" গানের মাঝে বাধা পাওয়া বিরক্ত ইব্রাহিম বলে উঠলেন, "শুনেঙ্গে নেহি? ও আপনা আদমি হ্যায়।" 'আপনা আদমি', নিজের লোক। এই উত্তরের জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। কাশ্মীরি ছেলেটিও 'আমাদের' মতো গান শুনতে শুনতেই পাহাড় পেরোয় ভাবতে কোথায় যেন বাঁধে। আমাদের চোখে কাশ্মীরি ছেলের সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডের টেন্সড কনস্পিরেসি মিউজিক বা হালের "পাত্তা অনারোকা, পাত্তা চানারোকা" অথবা ক্লাসিক "ভুমরো ভুমরো" ছাড়া বিশেষ কোনও সাবটাইটেল চোখে পড়ে না। সিধু মুসেওয়ালার 'আপন' হয়ে যাওয়া আমাদের আজন্ম লালিত 'othering'-কে প্রশ্ন সূচকের সামনে ফেলে দেয়। আমাদের গ্যালারির দর্শকাসনের আরামের গালে সপাটে চড় মারে।
আচ্ছা পাঁচ দোয়াবের মাটি, সোনালি গমের ক্ষেতের সিধু মুসেওয়ালা ইব্রাহিমের আপন হলো কেমন করে? ওদের ভাষা আলাদা, ধর্ম আলাদা, জীবন, যাপন সব। তবে? না কি ব্যর্থ যৌবনের জ্বালা, চাকরি না পাওয়ার জ্বালা, মাস্টার্স করার পর টুরিস্ট গাইড হয়ে যাওয়ার গ্লানি, সিধুর গানে সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক, উপত্যকার চিনার, পাইন, কেশর ক্ষেতের সবুজকে মিলিয়ে দেয় পঞ্জাবের ডানকি মেরে কানাডা যাওয়া ছেলেটির চোখের স্বপ্নের সঙ্গে। সিধুর গানে ইব্রাহিমের বুলবুল হয়ে ওঠে পক্ষীরাজ, কাঁটাতার পেরোয় ওরা, সেনা চৌকি, প্রতিদিনের ধর-পাকড়, মিথ্যা এনকাউন্টার, নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকা, সব ফেলে পালিয়ে যেতে চায় ওরা, অনেক অনেক 'তরক্কি' করতে চায়, কারণ সিধু গেয়ে গেছে "Sach bolega taan milu 295, Je karega tarakki putt hate milugi"।
আরও পড়ুন-পহেলগাঁও হামলার মূল অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী আসলে একই
বেশ কয়েক বছর আগে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল মনে আছে। পাকিস্তানের সেনা ছাউনি থেকে লাউড স্পিকারে বাজানো হচ্ছে সিধু মুসেওয়ালারই 'বামবিহা বোলে', গানের তালে এপারে নেচে উঠছে ভারতের সেনারা। একসঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। বরফ ঢাকা পাহাড় চুড়োয় তখন ভালোবাসার মরশুম, শিশুর মতো নেচে উঠছে রাইফেল ধরা উর্দি পরা মানুষগুলো। আবছা হয়ে যাচ্ছে রক্ত, ঘৃণা, কাঁটাতার, রাজনীতির ব্যাপারীরা। সিন্ধুর দুইপাড়ে, আপেল বাগান, বরফচুড়ো জুড়ে তখন খালি 'বামবিহা' বা চাতকের ডাক। বর্ষার খবর এনেছে সে, ছয় দশকের বেশি জ্বলতে থাকা এ ভূখণ্ডে বৃষ্টির নামার খবর।
গত ডিসেম্বরে যখন এই লেখা শেষ করেছিলাম তখনও পহেলগাঁওয়ের বৈসরনের গায়ে নিষ্পাপ রক্তের দাগ নেই, সারা দেশ জুড়ে কাশ্মীরি মুসলিম ছাত্রদের ওপর আক্রমণ নেই, নদিয়ায় তখনও এসে পৌঁছয়নি ঝন্টু শেখের লাশ, খবর চ্যানেলের দাদাবাবুরা তখনও সেকুলারদের বেরিয়ে যাওয়ার নিদান দিয়ে উঠতে পারেননি, সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে ঘৃণা তখন একটু কম। তাই হয়তো এই লেখায় অনেক আকাশকুসুম, প্রায় বেয়াড়া আশার ভিড়। রাতারাতি বদলে যাওয়া পড়শি, স্বজন এই লেখায় নাক কোঁচকাবেন হয়তো, তাঁদের ফোনের মধ্যে, মাথার মধ্যে তৈরি হওয়া জোব্বা পরা দাড়িওয়ালা, সুরমা চোখের ভিলেনের সঙ্গে আমার ঘোড় সওয়ার নায়কের মিল নেই। ওর মুখের আদল অনেকটা আদিল হুসেইন শাহের মতো, সন্ত্রাসবাদের বন্দুকের সামনে বুক পাততে যার হাত কাঁপেনি, নাকি ওই সাজ্জাদ ভাটের মতো, পিঠে করে টুরিস্টদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিল যে? আসলে আমার ইব্রাহিমরা কাশ্মীরের ওই হাজার হাজার মানুষের মতো দেখতে যারা রাস্তায় নেমেছেন, মানুষ বাঁচিয়েছেন, আর হাত জোড় করে বলে গেছেন 'মাফি মাফি'। দশকের পর দশক অন্যায়, পেলেট, গুম করে দেওয়ার পরেও যারা আঁচল পেতে আমাদের ভ্রমণবিলাসকে সযত্নে লালন পালন করেছেন।
আমরা ইব্রাহিমদের 'আপনা আদমি' হয়ে উঠি। অবিশ্বাসের কাঁটার ভিড়ে গোলাপি কাগজফুল ফুটুক, আমাদের ভবিষ্যতের বুলবুলরা লাফিয়ে পেরিয়ে যাক সাম্প্রদায়িক বিষ।
বামবিহা, এবার একটু প্রেমের বৃষ্টি এনো প্লিজ।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। এর দায় ইনস্ক্রিপ্টের নয়।