দিঘা জগন্নাথ মন্দির: তৃণমূলের দুর্নীতি থেকে নজর ঘুরবে সাধারণ মানুষের?
Digha Jagannath Temple: কেউ মনে করছেন মন্দির পেয়ে মানুষ দুর্নীতি ভুলে যেতে পারে আবার কারও মতে, মন্দির দিয়ে দুর্নীতির ইস্যুকে ঢাকা দেওয়া যাবে না।
৩০ এপ্রিল দিঘা জগন্নাথ ধামের উদ্বোধন। তার আগের দিন অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল হবে হোম যজ্ঞের অনুষ্ঠান। উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৭ তারিখেই পাঁচ মন্ত্রীকে দিঘায় পৌঁছে যেতে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই তালিকায় ছিলেন অরূপ বিশ্বাস, স্নেহাশিস চক্রবর্তী, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, পুলক রায় এবং সুজিত বসু। অন্যদিকে কলকাতা সামলানোর জন্য এবং অন্যান্য জেলার সমস্যা দেখতে দায়িত্ব দিয়েছেন পুরমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে।
জানা যাচ্ছে, মন্দির উদ্বোধনের জমকালো অনুষ্ঠান দেখার জন্য ১২০০০ দর্শকের আসন তৈরি করা হচ্ছে। এই আসন ভরানো হবে পূর্ব মেদিনীপুরের অধিকাংশ বাসিন্দা এবং তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দিয়ে। খবর, অনুষ্ঠান যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়, তার জন্য অপেক্ষাকৃত ‘শান্ত’ ও ‘শৃঙ্খলাপরায়ণ’ নেতা ও লোকেদের খোঁজা হচ্ছে।
পুরীর আদলে দিঘা জগন্নাথ ধাম তৈরি হলেও, অযোধ্যা রাম মন্দিরের সঙ্গে মিল রয়েছে এই মন্দিরের। দিঘা জগন্নাথ মন্দির এবং অযোধ্যা রাম মন্দির, দু'টিই সম্পূরা ঘরানার। রাজস্থানের বংশীপাহাড়পুর থেকে আনা গোলাপি বেলেপাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে এই দুই মন্দিরই। কারিগরও একই। সারা দেশজুড়ে প্রায় হাজারেরও বেশি নির্মাণশ্রমিক কাজ করেছে দিঘার জগন্নাথ ধাম তৈরিতে। জানা যাচ্ছে, মুর্শিদাবাদের এক ঠিকাদার শেখ আইজুদ্দিন সব কারিগরদের নিয়ে এসেছিলেন।
২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে দিঘা জগন্নাথ ধাম উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে বাংলায় ক্রমশই চড়ছে রাজনীতির পারদ। বিজেপির হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং হিন্দু ভোটারদের মন জয় করতে দিঘায় জগন্নাথ মন্দির তৈরি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এমনটাই মত রাজনৈতিক মহলের একাংশের। কিন্তু কী বলছেন দিঘাবাসী? ইনস্ক্রিপ্ট কথা বলল তাঁদের সঙ্গে।
আরও পড়ুন-রাম মন্দিরের পরেই দিঘাতে মমতার জগন্নাথ ধাম! ১৪৩ কোটির মন্দিরে কী থাকছে?
হকাররা কি মন্দিরের বাইরে বসতে পাবেন?
এই বিষয়ে নিউ দিঘার এক হকার বলেন, “কাওকেই তো বসতে দিচ্ছে না। মন্দিরের কাছে রোড সাইডে যারা আছে তাদের উঠে যেতে বলা হয়েছে। পরে কী হবে, বসতে দেবে কিনা বলা যাচ্ছে না। পুরো রাজনীতি হচ্ছে এখানে।” কেমন রাজনীতি? প্রশ্নের জবাবে ওই হকার বলেন, "রাজনীতি বলতে - দিদি যা বলবে তাই হবে।"
এতদিন রাজনীতি সচেতন মানুষরা বলছিলেন, মন্দির নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। এবার হকারদের কথাতেও স্পষ্ট শোনা গেল সেই সুর।
এছাড়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে, ভিআইপি নয়, সাধারণ মানুষরা যেন বেশি গুরুত্ব পায় কিন্তু হকাররা বলছেন উল্টো কথা। হকাররা বসবেন কীভাবে মন্দিরের সামনে? সেখানে তেমন জায়গাই রাখা হয়নি, বক্তব্য স্থানীয় হকারদের। টাকা খরচ করা হয়েছে, সুন্দর মন্দির হয়েছে কিন্তু সবটাই ভিআইপিদের কথা মাথায় রেখে। আরেকজন হকারের সঙ্গে ইনস্ক্রিপটের কথপোকথনে উঠে এল এমনই তথ্য।
জগন্নাথ মন্দিরের পিছনেই বাড়ি, টোটো চালান। স্ত্রী নিউ দিঘায় শসা, পেয়ারা মাখা, বিস্কুট, চকলেট ছোট্ট ঠেলায় বিক্রি করেন। মন্দির উদ্বোধনের কারণে উঠে যেতে বলা হয়েছে তাঁদের। ওই টোটোচালক বলছেন, “এখানে রাজনীতি হচ্ছে। প্রথমে আমরা মন্দির তৈরি নিয়ে খুশিই ছিলাম। কিন্তু পরে দেখা গেল গরিবের পেটে লাথি মেরে বড়লোকদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ হকারদের উঠে যেতে বলছে অথচ বাস কাউন্টারগুলোকে তুলতে পারছে না। কারণ ওগুলো নেতাদের।” নিজের দুর্দশার কথা তুলে তাঁর আরও অভিযোগ, “বৃষ্টিতে জল পড়ে, টালির চালার ঘর। অথচ সরকার বাড়ি করার টাকা দিয়েছে দোতলা বাড়ির মালিকদের।”
এই অভিযোগ নতুন নয়। পূর্বেও আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরকারের বিরুদ্ধে এই ভূরিভূরি দুর্নীতির অভিযোগ মন্দির দিয়ে ঢেকে দেওয়া যাবে?
এক ভাতের হোটেলের মালিক ইনস্ক্রিপ্টকে বলেন, “মন্দির হওয়ায় এবার হয়তো মানুষ বেশি আসবে। ব্যবসা ভালো হবে কিন্তু মন্দির দিয়ে মানুষকে দুর্নীতি ভুলিয়ে দেওয়া যাবে না।" ২৬ হাজার চাকরিহারা শিক্ষকের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, "টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছে অনেকে, অযোগ্যদের জন্য যোগ্যদের চাকরিও গেল। এটা খারাপ লাগছে।” তাঁর মতে, দুর্নীতির টাকায় মন্দির তৈরি করা মানুষ মোটেই ভালো চোখে দেখবে না।
যদিও বর্ধমান থেকে দিঘায় ঘুরতে আসা এক পর্যটকের কথায়, ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্র, তাই মন্দির পেয়ে মানুষ দুর্নীতির কথা ভুলে যেতেও পারে।
আবার কেউ বলছেন, দুর্নীতি ইস্যু মানুষের মাথায় আছে। মন্দির দিয়ে তা মানুষকে ভোলানো যাবে না।
আরও পড়ুন-মুম্বই হল দিঘা! কাঁথি অবধি নতুন মেরিন ড্রাইভে কতটা সহজ হল সৈকত পর্যটন?
সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম শিক্ষা দুর্নীতি। মন্দির উদ্বোধনের আবহেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি গিয়েছে ২৬ হাজার শিক্ষকের। সাধারণ মানুষ কী চাইছেন! মন্দির না চাকরি?
নিউ দিঘার আরেক টোটো চালকের কথায়, “মন্দিরের প্রয়োজন ছিল, বরাবর থাকবেই। এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু চাকরির তো এই অবস্থা। শুনছি তো চাকরি চলে যাচ্ছে।” তবে মন্দির নিয়ে রাজনীতি পছন্দ করেন না তিনি।
কলকাতা থেকে দিঘায় ঘুরতে আসা পর্যটক ইমতিয়াজ আলি বলেন, “মন্দির হয়েছে খুবই ভালো লাগছে। আমরা মুসলিম হলেও আমরা খুশি। আমরাও মন্দির ঘুরে দেখব।” চাকরিও সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া দিঘা জগন্নাথ মন্দিরকে ইস্যু করে ২৬-এর নির্বাচন হবে বলেও তিনি মনে করছেন। তিনি বলেন, "ভোটের রাজনীতি তো আছেই। নাহলে নির্বাচনের আগেই কেন উদ্বোধন? এটা তো আগেও করতে পারত।”
সাধারণের কথায়, মন্দির হয়েছে খুবই ভালো কথা কিন্তু চাকরিও দরকার। কেউ মনে করছেন মন্দির পেয়ে মানুষ দুর্নীতি ভুলে যেতে পারে আবার কারও মতে, মন্দির দিয়ে দুর্নীতির ইস্যুকে ঢাকা দেওয়া যাবে না। মেরুকরণের রাজনীতি যখন ক্রমশই মাথাচাড়া দিচ্ছে, রাজনীতিতে গুরুত্ব পাচ্ছে মন্দির-মসজিদ। ইনস্ক্রিপ্ট আম জনতার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে মাত্র। প্রশ্ন তুলতে চেয়েছে, এই মন্দির নির্মাণ উন্নয়নের না কি ভোটের ভেট?