বাংলা মাধ্যমে পড়েই ইউপিএসসি পরীক্ষায় বাজিমাত! কোন মন্ত্রে লুকিয়ে বাপ্পা সাহার সাফল্যের রহস্য
UPSC : দারিদ্র্যকে জয় করে দ্বিতীয় স্থানাধিকারীর শিরোপা জিতে নিলেন বাংলার ছেলে বাপ্পা সাহা
প্রতিকূলতা টলাতে পারেনি তাকে, লক্ষ্যে অবিচল থেকেই সর্বভারতীয় পরীক্ষায় লড়াই করে দ্বিতীয় স্থানাধিকারির শিরোপা ছিনিয়ে নিলেন আলিপুরদুয়ারের বাপ্পা সাহা। যেন প্রকৃতই রূপকথার চরিত্র বাপ্পা। বাবা পেশায় একজন সাধারণ রাজমিস্ত্রী। ছোটবেলা থেকেই অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তার জেরে ইচ্ছে শক্তিতে কোনও দিন ভাটা পড়েনি বাপ্পার। মেধায় শান দিয়েছে নিয়ত। আর তারই ফল মিলেছে হাতে-নাতে। ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরিচালিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসস্টিক্যাল সার্ভিস পরীক্ষায় সর্ব ভারতীয় স্তরে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন তিনি।
আলিপুরদুয়ার শহর সংলগ্ন দক্ষিণ মাঝেরডাবরি এলাকার বাসিন্দা বছর তেইশের বাপ্পা সাহা। ছোট থেকেই সে পড়াশোনায় তুখোড়। বাবা গোপাল সাহাকে কষ্ট করতে দেখেছে বলেই হয়তো পড়াশোনার মূল্য ভালোই বুঝত সে। এই চিলতে মাটির কাঁচা বাড়িতে তার বেড়ে ওঠা। বাড়িতে সামান্য বিদ্যুৎ পর্যন্ত ছিল না। অবশ্য হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনায় ছেদ পড়েনি কখনওই। কাচের গায়ে কালো ভুসি পড়লে তাকে ঝেড়ে নিয়েই এগিয়ে গিয়েছে বাপ্পা।
গ্রামের প্রাথমিক স্কুলেই লেখাপড়ার শুরু। তারপর সেখান থেকে ভর্তি হয়েছিলেন আলিপুরদুয়ারের গোবিন্দ হাইস্কুলে। মাধ্যমিকের নম্বর ভালো ছিল বলে বিজ্ঞান নিয়েই পড়া শুরু করে উচ্চমাধ্যমিকের। তারপর সেখানেও দারুণ সাফল্য। ২০১৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বাপ্পা। একের পর এক অসাধারণ রেজাল্টের নজির রয়েছে তার। আজকাল যুগের কাছে সত্যিকারের দৃষ্টান্ত বাপ্পা। যখন ইংরেজি মাধ্যমকেই একমাত্র বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অভিভাবকরা তখন বাপ্পার এই অভূতপূর্ব সাফল্য যেন সব কিছুর যোগ্য জবাব। কে বলে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করলে ভবিষ্যত অন্ধকার? বাপ্পা সাহার মতো এমন অনেকেই হয়তো স্বপ্ন বুনছেন বেঙ্গলি মিডিয়ামের কাঠের বেঞ্চে বসেই।
আরও পড়ুন - চাইলে পারবেন আপনিও! দেখিয়ে দিলেন ইউপিএসসি-তে সফল হওয়া তিন কন্যা
২০১৯ সালে উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট নিয়ে BSC পাশ করার পর সেই বছরই এগ্রিকালচার স্ট্যাটিসস্টিক্যাল নিয়ে দিল্লির ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচার ইন্সটিটিউটে MSC-তে ভর্তি হয় বাপ্পা। স্বপ্নপূরণের তখন সবে শুরু, আরও অনেকটা পথ চলা যে বাকি, তা নিশ্চয়ই জানত উত্তরবঙ্গের নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেটি। পাশ করে বেরিয়েই চাকরি পেতে হবে, হাতে নষ্ট করবার মতো সময় ছিল না তাঁর। তাই পড়তে পড়তেই বিভিন্ন সর্বভারতীয় পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল সে। চলতি বছরের জুন মাসে ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা UPSC পরিচালিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসস্টিক্যাল সার্ভিস পরীক্ষা বসে বাপ্পা। তারপর থেকেই অপেক্ষায় ছিল ভালো ফলাফলের। প্রাথমিক তালিকায় নাম আসার পর থেকে শুরু হয় ইন্টারভিউ এর প্রস্তুতি। গত ১৯ ডিসেম্বর দিল্লির ইউপিএসসি ভবনে অনুষ্ঠিত হয় ইন্টারভিউ। অবশেষে গত সপ্তাহে প্রকাশ্যে আসে চূড়ান্ত ফলাফল। আর সেখানেই জ্বলজ্বল করছে বাপ্পার নাম। তাও একেবারে দ্বিতীয় স্থানে। বাংলা তথা বাঙালির কাছে এ যে গর্বের তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
পরিবারের সকলের পাশে থাকাই কি তার সাফল্যের চাবিকাঠি? নাকি দরিদ্র থেকে ঘুরে দাঁড়ানো যে অকৃত্রিম তাগিদ আজীবন পুষে রেখেছিল ছেলেটি এই ফলাফল তারই বহিঃপ্রকাশ? উত্তর যাই হোক না কেন আসল হল বাস্তবের এই রূপকথাটুকুই। যাকে ঘিরে আজ স্বপ্ন দেখবে আরও অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েরা।
মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করা এবং জীবনের লক্ষ্য স্থির রাখা, এটুকুতেই জোর দিয়েছে বাপ্পা। বাঁধাধরা গতে বন্ধ পড়াশোনায় কোনদিনই বিশ্বাস ছিল না তার। কিন্তু যখন যতটুকু পড়েছেন তাকে আত্মস্থ করেছে, আর এতেই মিলেছে সাফল্য। আজ সময় বদলেছে, বাপ্পাকে নিয়ে এখন আশার আলো দেখছে গোটা পরিবার। বাপ্পাও ভোলেনি পুরনো দিনের কথা। প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাই সে চায় এলাকার গরীব বাচ্চাদের পড়াশোনার ভার নিতে। আধুনিকতার ঘেরাটোপে যে বাংলা মাধ্যম আজ কোণঠাসা, তাকে মশাল হাতে নতুন পথ দেখাতে পারে এমন হাজার হাজার বাপ্পারাই।