বাংলাদেশ বইমেলায় তসলিমার বই রাখা নিয়ে অশান্তি? আসলে যা ঘটেছে
Bangladesh Amar Ekushe Book Fair: অভিযোগ, সব্যসাচী স্টলটি আসলে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ। আর সেখানে জমায়েত করেছিল মাদ্রাসা ছাত্ররা।
বাংলাদেশে চলছে একুশে বইমেলা। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে এটিই বাংলাদেশে প্রথম অমর একুশে বইমেলা। বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্র সংশোধনের কাজ চলছে বলে দাবি সেই দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, নতুন বাংলাদেশকে অন্যভাবে গড়তে চান তাঁরা। তবে নতুন বাংলাদেশের চিত্রটা ঠিক কেমন? হাসিনা পরবর্তী সেই বাংলাদেশে কি বিরুদ্ধ মতের স্থান আছে? জানা গিয়েছে, তসলিমা নাসরিনের বই রাখা নিয়ে অমর একুশে বইমেলার একটি বইয়ের স্টলে ব্যাপক উত্তেজনা ঘটেছে। সোমবার সন্ধ্যায় বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকা ‘সব্যসাচী’ নামের স্টলে এই ঘটনাটি ঘটে। ওই স্টল বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ পুলিশ। কিন্তু কেন তসলিমার বই বিক্রি ঘিরে এই উত্তেজনা? শুধুই কি বই বিক্রি? কী ঘটেছে আসলে?
বাংলাদেশের নানা সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, সব্যসাচী স্টলটির বিরুদ্ধে নাস্তিকতা প্রচারের অভিযোগ তোলে একাংশের নাগরিক, অভিযোগ তাঁরা জামাতপন্থী। এই স্টল গুঁড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করা হয়। তারপর সন্ধেয় বইমেলার ওই স্টলের সামনে জমায়েত হয় কয়েকজনের। অভিযোগ, এই ব্যক্তিরা স্টল থেকে তসলিমা নাসরিনের বইগুলি সরিয়ে দিতে বলেন। স্টলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি প্রতিবাদ করেন। শুরু হয় বচসা। সামান্য হাতাহাতিও হয়। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতেই পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে স্টলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে সরিয়ে দেয়, স্টলটি ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়। ঠিক কী ঘটেছে? কারাই বা জমায়েত করে উত্তেজনা সৃষ্টি করল?
আরও পড়ুন- নির্বাচন নেই, হিংসা আছে! অন্তর্বর্তী সরকার আদৌ শান্তি চায়? যে প্রশ্ন তুলছে বিএনপি
প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। দেখা যাচ্ছে সব্যসাচী স্টলের সামনে বেশ ভিড় এবং স্টলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিও উত্তেজিত। সাজ্জাদ সহ অনেকের অভিযোগ, সব্যসাচী স্টলটি আসলে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ। আর সেখানে জমায়েত করেছিল মাদ্রাসা ছাত্ররা। ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, স্টলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়াতে স্টল গুঁড়িয়ে দেওয়ার ডাক দেওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারপর জয় বাংলা স্লোগান না দিতে দেওয়া নিয়ে তর্ক শুরু হয়। আওয়ামী বিরোধী স্লোগান ওঠে জনতার তরফে। তখন পুলিশ স্টলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে সরিয়ে নিতে গেলে তিনি এক মাদ্রাসা ছাত্রকে থাপ্পড় মারেন। তবে কয়েক সেকেন্ডের জন্য উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও কোনও প্রতিশোধমূলক হামলা হয়নি। এমনকী ওই স্টলে ভাংচুরও হয়নি।
ওই স্টলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির নাম শতাব্দী ভব। ভব সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি ভিডিওতে বলেছিলেন, সব্যসাচী যেভাবে হুমকি পেয়েছে, সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রশাসনের সমস্ত মহল থেকেই তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং প্রশাসন ও বাংলা আকাদেমির কর্তাব্যক্তিরা তাঁকে অনুরোধ করেছেন তসলিমার বইগুলি স্টল থেকে সরিয়ে নিতে। সেই অনুরোধ না মানতে তিনি যে অপারগ, তাও স্বীকার করেছেন ভব। তাই মেলা থেকে তিনি বই সরিয়ে নিচ্ছেন। শতব্দী ভবর অভিযোগ, নতুন বাংলাদেশে প্রশাসনের উচিত ছিল, সব্যসাচীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তা না করে 'নিষিদ্ধ-নিষিদ্ধ' খেলাই চলছে।
অমর একুশে বইমেলায় হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, এই হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশি নাগরিকদের অধিকার এবং বাংলাদেশের আইনকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। লিখেছেন, “বইমেলায় এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা বাংলাদেশের উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চাকে ক্ষুণ্ণ করে, ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদদের মর্যাদার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করে।” মহম্মদ ইউনূস সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখেছেন, “একুশে বইমেলা এ দেশের লেখক ও পাঠকদের প্রাণের মেলা। এ দেশের সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, চিন্তক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষের মিলনস্থল।” ঘটনাটির তদন্ত করে দোষীদের যথাযথ বিচারের নির্দেশও দিয়েছেন ইউনূস।
আরও পড়ুন- একাত্তর আঁকড়েই এগোবে চব্বিশ: নাহিদ ইসলাম
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি কমেন্টে লেখেন, "আগের দিন ঘোষণা দিয়ে একজন প্রকাশকের স্টলে গিয়ে জড়ো হওয়ার ও পুলিশিং করার কোনও অধিকার কারও নেই। প্রকাশক যদি প্রতিক্রিয়া দেখান, সেজন্য যারা প্রথমে পুলিশিং করতে গেছেন তাঁরাও দায়ী। প্রকাশক শারীরিক হামলা করলে আক্রান্তরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন কিন্তু কোনওমতেই ফার্স্ট প্লেসে বই নিয়ে পুলিশিং করার অধিকার তাঁদের নাই"।
মাহফুজের বক্তব্য, গত ৬ মাস তাঁরা যোগাযোগ ও সহযোগিতার পথ নিয়েছিলেন। অগাস্টের গণ অভ্যুত্থানে যথার্থ ভূমিকার ফলে সারা বাংলাদেশে তৌহিদী জনতার গ্রহণযোগ্যতার সম্ভাবনা ও ন্যয্যতা তৈরি হয়েছিল। মাহফুজ বলছেন, "সেটা তাঁরা নিজেরাই তাঁদের প্রাজ্ঞতা ও দূরদর্শীতার অভাবে নষ্ট করছেন। সবাই বিরুদ্ধে গেলেও, দীর্ঘমেয়াদে এ জনপদের মানুষের জন্য যেটা ফলপ্রসূ হবে, বাঙালি মুসলমান ও সাধারণ নাগরিকদের নিপীড়নের ক্ষেত্র ও যৌক্তিকতা যেভাবে তৈরি হবে না- সে পথই আমি অনুসরণ করব। আমাদের বিরোধিতা স্পষ্ট। উগ্রপন্থা ও ইসলামফোবিয়া- এ দুইটাই আমরা আর দেখতে চাই না। আলেম ও ইসলামপ্রিয় জনতা হোমো স্যাকার হয়ে উঠবেন কিনা, সেটা তাদের প্রাজ্ঞতা ও দূরদর্শীতার উপরই নির্ভর করে।"