যুক্তরাজ্যে ৩৬০টি, দুবাইয়ে ২৫০টি বাড়ি! যেভাবে সাম্রাজ্য গড়েছেন প্রাক্তন এই আওয়ামী মন্ত্রী

Saifuzzaman Chowdhury Property: সাইফুজ্জামান চৌধুরী লন্ডনে যে বাড়িতে থাকেন তার মূল্য ১ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। সাইফুজ্জামান সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে ২৫০টির বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মালিক।

গতবছর, অগাস্ট মাসে যখন বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে, তার পর থেকেই একাধিক প্রতিবেদনে উঠে আসতে থাকে কীভাবে হাসিনা, তাঁর স্বজনরা এবং আওয়ামী লীগের সামনের সারির নেতারা চরম দুর্নীতি করে, দেশকে ঋণে ডুবিয়ে নিজেরা আখের গুছিয়েছেন। আল জাজিরার তদন্তমূলক এক প্রতিবেদনে তখনই জানা যায়, বাংলাদেশের প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী লন্ডন, দুবাই এবং নিউইয়র্কে বিলাসবহুল রিয়েল এস্টেটের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় করেছেন কিন্তু বাংলাদেশের আয়কর জমা দেওয়ার সময় বিদেশের এই বিপুল সম্পদের কথা বিন্দুমাত্র উল্লেখ করেননি তিনি। বাংলাদেশের সংবিধান স্পষ্টভাবে উল্লিখিত আছে যে, রাজনীতিবিদদের অবশ্যই তাদের বিদেশি সম্পদের কথা ঘোষণা করতে হবে। অথচ একজন মন্ত্রী নিজে অবলীলায় তা লুকিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ পরে সাইফুজ্জামানের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে কত মিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন, তা নিয়ে তদন্তও চলছে। উল্লেখ্য, সাইফুজ্জামান চৌধুরী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

২০১৪ সালে সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরে ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা সাইফুজ্জামানকে ভূমিমন্ত্রী করেন। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট 'ফ্রিজ' করার পরেই সেই দেশের দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করেছে যে, অবৈধভাবে কত হাজার কোটি টাকা এভাবে সাইফুজ্জামান যুক্তরাজ্যে পাচার করেছেন। আল জাজিরার তদন্তে যে সব তথ্য উঠে এসেছে তাকে ঠিক কী বিশেষণে ব্যাখ্যা করা যায় তাও অজানাই। জানা গেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৬ সাল থেকে একাই যুক্তরাজ্যে ৩৬০টি বাড়ি কিনে ফেলেছিলেন। ভাবা যায়! ৩৬০টি বাড়ি, তাও ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে! বিলাসবহুল বাড়ি, রোলস রয়েস গাড়ি, দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, নিউ ইয়র্কে মতো ধনী দেশে সম্পত্তি গড়েছেন সাইফুজ্জামান! দুবাইয়ে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় তিনি ১৯৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন, লন্ডনে ৩০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ। নিউ ইয়র্ক, সান ফ্রান্সিসকোতে ২০ মিলিয়ন স্টক রয়েছে সাইফুজ্জামানের। সব মিলিয়ে সাইফুজ্জামানের বিদেশি সম্পত্তির পরিমাণ ৬৭৫ মিলিয়ন ডলার। আর এর কোনও উল্লেখ বাংলাদেশের আয়কর বিভাগের নথিতে উল্লেখই করেননি মন্ত্রী!

আরও পড়ুন- ১৮ লক্ষ কোটি টাকার দেনা চাপিয়ে গেছেন হাসিনা? যে বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

সাইফুজ্জামান চৌধুরী লন্ডনে যে বাড়িতে থাকেন তার মূল্য ১ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে ফাঁস হওয়া একটি তথ্যে দেখা যায়, সাইফুজ্জামান সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে ২৫০টির বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মালিক। এই সম্পত্তির মূল্য ১৪ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। নথি থেকে আরও জানা যায়, সাইফুজ্জামানের স্ত্রী রুকমিলা জামান দুবাইয়ে ২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের আরও ৫০টি সম্পত্তির মালিক। বাংলাদেশের মুদ্রা আইন অনুযায়ী, দেশের কোনও নাগরিক বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি টাকা বিদেশে নিয়ে যেতে পারবেন না। তাহলে এত টাকা সাইফুজ্জামান পেলেন কীভাবে?

সাইফুজ্জামান আল-জাজিরাকে বলেছেন, বিদেশে সম্পত্তি কেনার জন্য তিনি যে অর্থ ব্যবহার করেছেন, তা বাংলাদেশের বাইরে তাঁর বৈধ ব্যবসা থেকে এসেছে। তিনি অনেক বছর ধরেই এই ব্যবসার মালিক। অর্থ তছরুপ বিরোধী আইন বলছে, উচ্চ-পদস্থ রাজনীতিবিদ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির পরিমাণও বেশি। হয় এই টাকা তাঁরা সরকারি তহবিল থেকে চুরি করে নিজের পকেটে ভরেছেন, বা সরকারি কোনও চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঘুষ হিসেবে পেয়েছেন।

 

লন্ডনের বহু উপদেষ্টাদের সাহয্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরী তাঁর সম্পত্তির সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। চার্লস ডগলাস সলিসিটরস এলএলপি, ১০০ টিরও বেশি সম্পত্তি ঋণ পুনঃঅর্থায়নে সাইফুজ্জামানের জন্য কাজ করেছিল। পরেশ রাজা নামে একজন তাঁর কোম্পানি মার্কেট ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন এবং অন্যান্য ব্যবসার মাধ্যমে বহু ঋণ করেন। সিঙ্গাপুরের ব্যাংক ডিবিএস-এর রাহুল মার্টে মন্ত্রী সাইফুজ্জামানকে বহু টাকা ঋণও দিয়েছে। চার্লস ডগলাস সলিসিটর এলএলপি, মার্কেট ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন, পরেশ রাজা, ডিবিএস ব্যাঙ্ক পরে আল জাজিরাকে জানায় যে তারা সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপ বিষয়ে খোঁজ চালিয়েছে। তারা আরও জানায় যে, এই টাকা বাংলাদেশ নয়, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বৈধ এবং দীর্ঘদিনের ব্যবসা থেকেই এসেছে।

আরও পড়ুন- ব্রিটেনের মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ! মাসি শেখ হাসিনার সঙ্গে দুর্নীতিতে যুক্ত টিউলিপ সিদ্দিকও?

আল–জাজিরা অনুসন্ধান বলছে, লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হয়ে সব সম্পদ দেখাশোনা করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। আইনকে ফাঁকি দিয়ে এত সম্পত্তি কীভাবে গড়লেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী? রিপন মাহমুদ বলেছেন, "সাইফুজ্জামানের লন্ডনে ৩০০টি বাড়ি আছে। তিনি লন্ডনে আসেন, কয়েকটি বাড়ি কেনেন, আবার চলে যান। লকডাউনের সময় যুক্তরাজ্যে নতুন বাড়ি কেনার জন্য ২০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করেন তিনি।" সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বক্তব্য, লন্ডন ও যুক্তরাজ্যের সব সম্পত্তি রিপন মাহমুদের মাধ্যমেই তিনি কিনেছেন। প্রতিবছর সাইফুজ্জামান রিপন মাহমুদের মাধ্যমে ১০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেন। সাইফুজ্জামান সিঙ্গাপুরের ব্যাঙ্ক ডিবিএস থেকে ঋণ নিয়েছেন। আলজাজিরার অনুসন্ধানী দলের সঙ্গে কথাবার্তায় সাইফুজ্জামান নিজের বিলাসবহুল, প্রাচুর্যে ঠাসা জীবনের গল্প করতে গিয়ে এক জায়গায় নিজের জুতার বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন, "এটা টেইলর-মেডের জুতা। আমি হেরডসেও কাস্টম মেড জুতা অর্ডার দিয়েছি। এটি তৈরি হতে চার মাস সময় লাগে। আমি কিনেছি প্রতিটি তিন হাজার পাউন্ডের বেশি দিয়ে।" উল্লেখ্য, উটপাখি ও কুমিরের বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি হয় এই বিশেষ জুতো। সম্পূর্ণ বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতোর দাম ছয় হাজার পাউন্ড। আর অর্ধেক কুমিরের বুকের চামড়া ও বাছুরের চামড়ার অর্ধেক দিয়ে তৈরি জুতোর দাম তিন হাজার পাউন্ড! এখানেই শেষ না, সাইফুজ্জামান বলেছেন, প্রতিবার লন্ডনে গেলে ‘সুপার ২০০’ স্যুট কেনেন তিনি। এই ধরনের স্যুটের দাম ছয় থেকে আট হাজার পাউন্ড।

More Articles