আর্টেমিসিয়া জেন্টিলেস্কি: পুরুষের চোখে নয়, মেয়েদের স্বতন্ত্র ছবি এঁকেছিলেন যে শিল্পী
Artemisia Gentileschi Paintings: আর্টেমিসিয়া জেন্টিলেস্কিকে অনেক বছর ধরে পাশ কাটানো হয়েছে। এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শুধুমাত্র ‘ধর্ষিতা নারী শিল্পী’ পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন তিনি
১৬১২ সালের গ্রীষ্ম। রোম শহরের এক আদালতকক্ষে এক কিশোরী শিল্পী দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স মাত্র সতেরো। সেই সময়ের রোমে, যেখানে নারীর ঘরের চার দেওয়ালের আড়ালেই কেবল মর্যাদা থাকে, সেখানে এই সতেরো বছরের মেয়ে গোটা রোমের সামনে মুখোশ খুলতে চলেছিল সেই যুগের এক প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীর। আদালতের করিডরে থাকা পুরুষদের চোখ যেন শত শত ছুরি!
"বলো, কী হয়েছিল সেদিন?" বিচারকের গলার আওয়াজে কাঁপছে পুরো কক্ষ। মেয়েটির গলা কাঁপছে, মনে পড়ে যাচ্ছে সেই দিনের কথা, বাবার অনুপস্থিতিতে আগোস্তিনো তাসির অত্যাচারের কথা। ঠিক তখনই আদালতের কর্মচারী এগিয়ে আসে একটি লোহার যন্ত্র নিয়ে — সর্পিল তার, যা বাঁধা হবে আঙুলে।
"সত্যি বলো, নইলে এটা তোমার আঙুলের হাড় ভেঙে দেবে।"
বলেই মেয়েটির আঙুলে যন্ত্রের তার পেঁচিয়ে বাঁক দিতে শুরু করলেন ওই কর্মচারী। প্রথম বাঁক। দ্বিতীয় বাঁক। মেয়েটির কপালে ফুটে উঠল ঘামের ফোঁটা। তৃতীয় বাঁকে, যখন ব্যথায় সমস্ত দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে আসে, তখন তাঁর গলা থেকে বেরিয়ে আসে একটাই কথা — "È vero! È vero! È vero!" ("এটা সত্যি! এটা সত্যি! এটা সত্যি!")
রোমের আদালতে দাঁড়িয়ে আগাস্তিনো তাসির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো সেই মেয়ে ছিলেন আর্টেমিসিয়া জেন্টিলেস্কি, যাঁকে সারা বিশ্ব চিনেছিল বারোক যুগের সবথেকে বিখ্যাত মহিলা চিত্রশিল্পী হিসাবে। এই বিচার, এই লাঞ্ছনা তাঁকে ভেঙে ফেলেনি, বরং তাঁর জীবন ও শিল্পের ভিত গড়ে উঠেছে সেই যন্ত্রণা ও প্রতিরোধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। ইওরোপের চিত্রকলার ইতিহাসে আর্টেমিসিয়া ছিলেন এক ব্যতিক্রমী উপস্থিতি— একজন মহিলা, যিনি পুরুষশাসিত বারোক যুগের ক্যানভাসে নিজের অভিজ্ঞতা, রাগ এবং আত্মপরিচয়কে তুলে ধরেছিলেন।
সপ্তদশ শতকের রোম। নারীদের শিল্পচর্চা সেখানে তখন সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। সেখানে ১৫৯৩ সালে জন্ম নেন আর্টেমিসিয়া জেন্টিলেস্কি। তাঁর বাবা ওরাজিও জেন্টিলেস্কি ছিলেন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী কিন্তু কন্যার শিল্পশিক্ষাকে কখনই খুব গুরুত্ব দেননি। মাত্র বারো বছর বয়সে মাকে হারিয়ে ভাইদের লালন-পালনের দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে। কিন্তু এই কঠিন সময়েও আর্টেমিসিয়ার হাতে তুলি ধরার আকাঙ্খা দমে যায়নি। বাবার স্টুডিওতে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে করতেই তিনি আঁকতে শিখেছেন, কখনও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখই হয়ে উঠেছে তাঁর প্রথম মডেল। ওরাজিও নিজে ক্যারাভাজ্জোর কাছ থেকে প্রভাবিত হয়েছিলেন। আর সেই ডার্ক টোন, নাটকীয় আলো-আঁধারি আর দৃশ্যমান মানসিক দ্বন্দ্ব আর্টেমিসিয়ার কাজেও গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
কিন্তু এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ তফাৎ ছিল— ক্যারাভাজ্জোর কাজের বিষয়বস্তু বহুলাংশে বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের পুরুষ নায়কদের ঘিরে আবর্তিত। আর্টেমিসিয়া সেই কাহিনিগুলিকেই আঁকলেন নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে। যে নারীরা ক্যারাভাজ্জোর ক্যানভাসে এতদিন ছিল নিঃশব্দ, তারা এবার হয়ে উঠল সক্রিয়, প্রতিরোধী, এমনকী প্রতিশোধপরায়ণ।
যৌনতার প্রতিবিম্ব সুসানের অন্য রূপ আঁকলেন আর্টেমিসিয়া
১৬১০ সাল। মাত্র সতেরো বছর বয়সে আর্টেমিসিয়া আঁকেন তাঁর প্রথম মাস্টারপিস 'সুসানা অ্যান্ড দি এল্ডার্স'। রোমে সেই সময় ছবির মূল বিষয়বস্তু ছিল বাইবেল। এই বাইবেলের বিভিন্ন কাহিনিকে নিয়েই ছবি আঁকতেন শিল্পীরা। বুক অফ ড্যানিয়েলের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল সুসান এবং তাকেই এক নতুন রূপ দেন আর্টেমিসিয়া। বাইবেলের এই কাহিনিতে পূর্ববর্তী সব শিল্পী সুসানাকে যৌন আকর্ষণের পাত্রী হিসেবেই এঁকেছেন কিন্তু আর্টেমিসিয়ার সুসানা একেবারে অন্যরকম। তাঁর চোখে ভয়, হাতে প্রতিরোধ, মুখের ভঙ্গিমায় অন্যের দৃষ্টি সহ্য করতে না পারার যন্ত্রণা। শিল্প ইতিহাসে সেই প্রথম কোনও নারী শিল্পী যৌন নিপীড়নের শিকার নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গল্পটি বলেন।
ধর্ষণ, বিচার এবং স্মৃতির রূপান্তর
আর্টেমিসিয়ার জীবনের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে ১৬১১ সালে। ওরাজিওর সহশিল্পী আগোস্টিনো তাসি আর্টেমিসিয়ার ওপর যৌন নিপীড়ন চালায়। মধ্যযুগীয় রোমে এই অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ছিল নারীর জন্য আরেক নির্যাতন। তাই প্রথমে বিষয়টা আদালত অবধি নিয়ে যেতে চাননি তাঁর বাবা। নিজেদের মধ্যে সবকিছু মিটিয়ে নেওয়ার জন্য আগোস্টিনোকে আর্টেমিসিয়াকে বিয়ে করতে বলেন ওরাজিও। তবে আগোস্টিনো বিয়েতে গররাজি থাকায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ওরাজিও। রোমের আদালতে আগোস্টিনোর বিরুদ্ধে মামলা করেন ওরাজিও। এই মামলা সেই সময়ের সামাজিক মানদণ্ডেও ব্যতিক্রম ছিল। দীর্ঘ সাত মাসের বিচারপর্বে আর্টেমিসিয়া সহ্য করেন শারীরিক নির্যাতন, আঙুলে যন্ত্রণা, জনসমক্ষে চরিত্রহনন। শেষমেশ তাসি দোষী সাব্যস্ত হলেও খুব দ্রুত ক্ষমা পেয়ে মুক্ত হয়ে যায়। আর্টেমিসিয়ার জন্য রয়ে যায় কেবল লাঞ্ছনার ইতিহাস। এই ঘটনা শুধু জীবনে নয়, আর্টেমিসিয়ার শিল্পচর্চাতেও গভীর ছাপ ফেলে।
জুডিথ-এর খঞ্জর হয়ে ওঠা তুলি
কোর্ট মামলার পর আর্টেমিসিয়াকে ফ্লোরেন্সে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এক সাধারণ চিত্রশিল্পী পিয়েরান্টোনিও স্টিয়াটেসির সঙ্গে বিয়ের জন্য। কিন্তু এই বিয়েই হয়ে ওঠে তাঁর স্বাধীনতার সূচনা। ফ্লোরেন্সে তিনি সৃষ্টি করেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্র 'জুডিথ বেহেডিং হোলোফার্নেস'। কারাভাজ্জো যেখানে জুডিথকে একজন ভীতসন্ত্রস্ত নারী হিসেবে এঁকেছিলেন, সেখানে আর্টেমিসিয়ার জুডিথ একদম ভিন্ন — তাঁর হাতে খঞ্জর ধরা হোলোফার্নেসের গলা কাটার দৃশ্য এতটাই বাস্তবিক যে দর্শক রক্তের গন্ধ পেতে শুরু করে। এই চিত্রকে আজ নারীবাদী শিল্পের প্রথম দলিল হিসেবে গণ্য করা হয়।
‘জুডিথ বেহেডিং হোলোফার্নেস’-এ রক্তের প্রবল বর্ণময়তা, নারীর চোখে প্রতিশোধের শাসানি— এসব ক্যারাভাজ্জোর থেকে গ্রহণ করা আলো-ছায়ার কৌশলের বাইরে এক মানসিক প্রতিবাদের প্রকাশ। অনেকে বলেন, এই হোলোফার্নেস যেন তাসির প্রতীক, আর জুডিথ আসলে আর্টেমিসিয়া নিজে।
ইউরোপজুড়ে এক নারী শিল্পীর বিজয়যাত্রা
ফ্লোরেন্সের পর আর্টেমিসিয়া ভেনিস, নেপলস এবং শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে কাজ করেন। তিনি শুধু শিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন এক দক্ষ ব্যবসায়ীও। স্পেনের রাজা চতুর্থ ফিলিপ থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের চার্লস, ইউরোপের প্রায় সব শাসকই তাঁর চিত্র সংগ্রহ করতেন। নেপলসে তিনি গড়ে তোলেন এক শিল্পী সম্প্রদায়, যেখানে নারী শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিতেন। ১৬৫৬ সালে নেপলসে প্লেগে তাঁর মৃত্যু হয় কিন্তু মৃত্যুর পর তিনশো বছর তাঁর নাম প্রায় বিস্মৃতির গর্ভেই ছিল।
আর্টেমিসিয়ার পুনরুত্থান
বিংশ শতাব্দীর নারীবাদী আন্দোলন আর্টেমিসিয়াকে পুনরাবিষ্কার করে। ১৯৭৬ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি মিউজিয়ামে তাঁর প্রথম রেট্রোস্পেক্টিভ প্রদর্শনী হয়। ২০১৮ সালে ব্রেট কাভানোর বিচারকার্যের সময় তাঁর 'জুডিথ বেহেডিং হোলোফার্নেস' চিত্রটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, হয়ে ওঠে নারী প্রতিরোধের প্রতীক। ২০২০ সালে ডিসনি প্লাস তাঁর জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করে।
নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম মুখ
আর্টেমিসিয়া কেবল যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদেই থেমে থাকেননি। তিনি বাইবেল ও পুরাণের নারী চরিত্রগুলিকে এমনভাবে পুনর্নির্মাণ করেন, যা সেই সময়ে বিরল। তার ‘মেরি ম্যাগডালিন ইন এক্সট্যাসি’ অথবা ‘ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড’ চিত্রগুলোও তাই কেবল ধর্মীয় চরিত্রচিত্রণ নয়— সেগুলো নারী অভিজ্ঞতার পরিমিত প্রকাশ। তাঁর ম্যাগডালিন কোনও লালসার শিকার নয় বরং গভীর আত্মবোধে নিমজ্জিত এক সত্তা। অন্যদিকে, ম্যাডোনা কেবল মাতৃত্বের প্রতীক নন, বরং এক বলিষ্ঠ নারী, যিনি নিজ সন্তানের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এইসব চিত্রকর্মে একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়— নারীর শরীর কখনও ভোগ্যবস্তু নয় বরং এক অভ্যন্তরীণ শক্তির আধার। এদিক দিয়ে আর্টেমিসিয়া তাঁর সময়ের পুরুষ শিল্পীদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন।
আর্টেমিসিয়া শুধু একজন শিল্পীই ছিলেন না, একজন বিপ্লবী ছিলেন তিনি। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, শিল্প কেবল সৌন্দর্য সৃষ্টির মাধ্যম নয়, সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে শিল্প। আজ যখন আমরা তাঁর 'সেলফ-পোর্ট্রেট অ্যাজ দি অ্যালিগরি অব পেইন্টিং' চিত্রে দেখি এক নারী গভীর মনোযোগে ক্যানভাসে রং মাখাচ্ছেন, তখন আমরা কোনও 'ভিকটিম'-কে দেখি না, দেখতে পাই এক বিজয়ীকে।
শিল্পশৈলী ও কারিগরি দক্ষতা
আর্টেমিসিয়ার ক্যানভাসে আলো ও ছায়ার ব্যবহারে ক্যারাভাজ্জোর প্রভাব থাকলেও তিনি নিজস্ব এক গাম্ভীর্য তৈরি করেছিলেন। তাঁর রঙচয়ন, বস্ত্রের গঠন, মুখাবয়বের অভিব্যক্তি, দৃষ্টিভঙ্গির কৌণিকতা— সবই এক পরিশীলিত শিল্পচর্চার ফল। তাঁর নারীরা কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, তারা অনুভব করে, সিদ্ধান্ত নেয় এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধ করে।
তাঁর কাজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নাটকীয় মুহূর্ত নির্বাচন। তিনি এমন মুহূর্ত আঁকতেন যেখানে নারীর সিদ্ধান্ত ও কাজ একসঙ্গে দৃশ্যমান হয়— যেখানে নারী কেবল অনুভব করে না, কাজও করে।
সমকালীন মূল্যায়ন
আর্টেমিসিয়া জেন্টিলেস্কিকে অনেক বছর ধরে পাশ কাটানো হয়েছে। এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শুধুমাত্র ‘ধর্ষিতা নারী শিল্পী’ পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন তিনি কিন্তু বিংশ শতকের শেষভাগে যখন নারীবাদী শিল্প ইতিহাস চর্চার প্রসার ঘটে, তখন তাঁর কাজ নতুনভাবে দেখা শুরু হয়। তাঁকে দেখা হয় স্বকীয় শিল্পী হিসেবে, যাঁর অভিজ্ঞতা, প্রতিভা ও দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে সময়ের থেকে বহু এগিয়ে রেখেছিল।
আজ তাঁর নাম উচ্চারিত হয় ক্যারাভাজ্জো, রুবেন্স, ভেরমিয়ারের সঙ্গে। তাঁর কাজ স্থান পায় লুভর, উফিজি, মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামের মতো জায়গায়। তাঁর ক্যানভাস কেবল চিত্রকলার নিদর্শন নয়, সময়ের এক দলিল। এক নারীর ব্যক্তিগত ইতিহাস, সামাজিক নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া এবং শিল্পের মাধ্যমে আত্মপ্রতিষ্ঠার অনন্য উদাহরণ। আর্টেমিসিয়া জেন্টিলেস্কি কেবল একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন না, ছিলেন এমন এক দৃষ্টিভঙ্গির বাহক, যা নারী অভিজ্ঞতাকে শিল্পের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসে। তাঁর কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়— শিল্প শুধু নান্দনিক নয়, তা এক গভীর আত্মপ্রত্যয়ের ভাষা।