কোটি টাকার আন্দোলন! জুনিয়র ডাক্তারদের এই বিপুল অনুদান সঠিক লক্ষ্যে ব্যবহৃত হলো?
RG Kar Junior Doctors' Grant: মোট অনুদানের পরিমাণ ৩ কোটি ৫৮ লক্ষ ২১ হাজার ১৩৫টাকা। যার মধ্যে এখনও অবধি খরচ হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৩৭ লক্ষ ৫৩ হাজার ৯৯৮ টাকা। হাতে আছে ২ কোটি ২৯ লক্ষ ৭৭ হাজার ৬৬ টাকা।
৯ অগাস্ট, ২০২৪। আরজি কর হাসপাতালের মধ্যে একজন কর্তব্যরত তরুণী চিকিৎসক ধর্ষিত হন, খুন হন। সারা কলকাতা এবং বাংলা তোলপাড় হয়ে যায় এই ঘটনায়। মূলত দু'টি অভিঘাত ছিল এই ঘটনার। এক, এই ঘটনায় সরাসরি হাসপাতালের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিরা এমন কিছু মন্তব্য ও আচরণ করছিলেন যাতে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। দুই, এই ঘটনায় রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ঘটে চলা ব্যাপক দুর্নীতির ক্রমেই পর্দাফাঁস হয়ে যাচ্ছিল। খুন হয়ে যাওয়া, অত্যাচারিত হওয়া তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে, সমস্ত মেয়েদের নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পথে নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ, এবং পথে নেমেছিলেন ডাক্তাররা। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন, বিক্ষোভ অবস্থান, অনশন, মমতা বন্দ্যোপধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক আরজি কর ধর্ষণকাণ্ডে এক নতুন বাঁকবদল ঘটায়। অনেকেই সেই সময় মনে করেছিলেন, যে আন্দোলন ছিল জনসাধারণের, তা ডাক্তারদের কুক্ষিগত হওয়াতে আন্দোলনের ব্যাপ্তিই কমে গিয়েছিল। তবে, সেই আন্দোলনপর্বে জুনিয়র ডাক্তারদের সংহতিও জানিয়েছিলেন বহু মানুষ। শুধু রাজ্য বা দেশের নয়, বিদেশের বহু মানুষ সাধ্যমতো পাশে থেকেছেন জুনিয়র ডাক্তারদের। কেউ থেকেছেন শারীরিকভাবে, কেউ আর্থিকভাবে। অনেকদিন ধরেই দবি উঠেছিল, এই আন্দোলনপর্বে সোশ্যাল মিডিয়া সহ নানা মাধ্যমে জুনিয়র ডাক্তাররা যে আর্থিক অনুদান পেয়েছেন তার হিসেব প্রকাশ করতে হবে। অবশেষে সেই হিসেব তাঁরা দিয়েছেন, যা আবারও একাংশের মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
আরজি কর হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে ডাকা এক গণকনভেনশনে অনুদান এবং খরচের হিসাব দিয়েছেন তাঁরা। জুনিয়র ডাক্তাররা বলছেন, আরজি কর আন্দোলন পর্বে সাড়ে তিন কোটি টাকারও বেশি অনুদান পেয়েছেন তাঁরা! এই বিপুল টাকার মিধ্যে মাত্র ১ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। অর্থাৎ হাতে আছে ২ কোটির বেশি টাকা। জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট (ডব্লিউবিজেডিএফ) এই হিসেব পেশ করে। কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে তাও বলেছেন তাঁরা। এখানে উল্লেখ্য, ডব্লিউবিজেডিএফ এর অধীনে আছে আরজি কর রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন (আরজিকরআরডিএ) এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন (এমসিকেআরডিএ)। অনুদান পেয়েছে সব সংগঠনই, স্বতন্ত্রভাবে।
আরও পড়ুন- “মানুষকে ভুল বোঝাতে সঞ্জয়ের ফাঁসি চাইছেন মমতা!” বিস্ফোরক তিলোত্তমার বাবা
ডব্লিউবিজেডিএফ ২০২৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পাওয়া অনুদানের হিসাব দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ডব্লিউবিজেডিএফ মোট ২ কোটি ২৬ লক্ষ ১৯ হাজার ১৩ টাকা অনুদান পেয়েছে। গত মার্চ মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৩১ লক্ষ ৮৬ হাজার ৩৩৪ টাকা। অর্থাৎ বিপুল টাকা এখনও বেঁচে আছে। ১ কোটি ৯৪ লক্ষ ৪২ হাজার ৬০৪ টাকা এখনও হাতে আছে। ডব্লিউবিজেডিএফ-এর দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, ৪,৫৯,৯২১ টাকা খরচ হয়েছে অনশনমঞ্চ তৈরিতে এবং অনশন প্রক্রিয়াতে চালিয়ে নিয়ে যেতে। তাছাড়া নানা সময়, নানা স্থানে সভা-সমাবেশে আরও আড়াই লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। ডব্লিউবিজেডিএফ নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ তৈরিতে খরচ করেছে ৪৪ হাজার টাকা। অভয়া ক্লিনিক তৈরি করতে ১ লক্ষ ৯২ হাজার টাকা এবং আদালতে আইনি লড়াই বাবদ ১৯ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি ডব্লিউবিজেডিএফ-এর।
আরজি কর রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন (আরজিকরআরডিএ) হিসেব দিয়েছে পৃথকভাবে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ঘটনার ঠিক পরদিন, অর্থাৎ ১০ অগাস্ট থেকে অনুদান পেয়েছেন তাঁরা। গত ৩১ মার্চ অবধি পাওয়া মোট অনুদানের অঙ্ক ৫৬ লক্ষ ৮৮ হাজার ৪১২ টাকা, যার মধ্যে খরচ হয়েছে ৪৮ লক্ষ ৬১ হাজার ৯১২ টাকা। বেঁচে আছে ১৭ লক্ষ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা। আরজিকরআরডিএ বলছে, আরজি কর হাসপাতালে ধর্না মঞ্চ তৈরি এবং অবস্থান চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৬ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। স্বাস্থ্যভবন আন্দোলনে খরচ হয়েছে ৫ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা। আন্দোলন চলাকালীন খাবার এবং জলের জন্য ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা খরচ করেছে আরজিকরআরডিএ। হাসপাতাল চত্বরে তিলোত্তমার মূর্তি বসাতে খরচ হয়েছে ৫১ হাজার ৩০০ টাকা। পাশাপাশি যাতায়াত, থাকার খরচ ইত্যাদি বাবদ ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা, মাইক, সাউন্ডের জন্য ১ লক্ষ ৬৯ হাজার টাকা এবং আইনি লড়াইয়ের জন্য ২৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি আরজিকরআরডিএ-র।
অন্যদিকে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন বা এমসিকেআরডিএ বলছে, গত ১২ অগাস্ট থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত অনুদান বাবদ তাঁরা পেয়েছেন ৭৫ লক্ষ ১৩ হাজার ৭১০ টাকা। মোট খরচ হয়েছে ৫৭ লক্ষ ৫ হাজার ৭৪৮ টাকা। ১৮ লক্ষ ৭ হাজার ৯৬২ টাকা হাতে আছে। এমসিকেআরডিএ-র দাবি, অভয়া ক্লিনিকের জন্য ১ লক্ষ ৬৩ হাজার টাকা, লালবাজার অভিযানের জন্য ৬৬ হাজার ৬১৬ টাকা, মিছিলের জন্য ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা, স্বাস্থ্যভবন অভিযানে ১২ লক্ষ ৭ হাজার টাকা, মহালয়ার দিনে বিশেষ মিছিলে ৭ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা এবং আইনি লড়াইয়ে ২ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
এবার, ডব্লিউবিজেডিএফ, আরজিকরআরডিএ আর এমসিকেআরডিএ — এই তিন সংগঠন মিলিয়ে মোট অনুদানের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৩ কোটি ৫৮ লক্ষ ২১ হাজার ১৩৫টাকা। যার মধ্যে এখনও অবধি খরচ হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৩৭ লক্ষ ৫৩ হাজার ৯৯৮ টাকা। হাতে আছে ২ কোটি ২৯ লক্ষ ৭৭ হাজার ৬৬ টাকা।
আরও পড়ুন- সঞ্জয়ের শাস্তিতেই মামলা শেষ নয়! আরজি কর কাণ্ডে আরও তদন্ত করবে সিবিআই?
প্রশ্ন উঠছে বেশ কয়েকটি।
এক, এই বিপুল উদ্বৃত্ত টাকার ভবিষ্যৎ কী?
দুই, আদালতে একপ্রস্থ বিচার ও সাজা ঘোষণা হয়েছে, তবে মামলা চলছে এখনও। তবে আন্দোলন স্তিমিত একেবারেই। তাহলে মার্চ অবধি অনুদান কোন খাতে এসেছে?
তিন, যখন দেখা যাচ্ছে টাকা বেশি হয়ে যাচ্ছে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে, তখন জুনিয়র ডাক্তাররা কেন অনুদান নেওয়া বন্ধ করলেন না?
চার, সত্যিই কি কোটি টাকার আন্দোলন করে কাঙ্খিত বিচার বা কোনও বদল ঘটানো সম্ভব হলো?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। জানিয়েছেন, যেহেতু এখনও মামলা চলছে, তার তার নির্দিষ্ট খরচ আছেই। দ্বিতীয়ত অভয়া ক্লিনিকেও খরচা হবে। এছাড়া টাকা নিয়ে কী করা যায় সেই নিয়ে সাধারণ মানুষের থেকেই ওয়েবসাইট মারফৎ পরামর্শ চাইবেন তাঁরা। মুর্শিদাবাদে ওয়াকফ আইন বিষয়ে যে অশান্তি হয়েছে, সেই আক্রান্ত স্থানে চিকিৎসকদের প্রতিনিধি দল যাবে। যদিও এখানে প্রশ্ন আসে, যে মানুষরা অভয়ার জন্য অনুদান দিয়েছেন, তাঁরা কি যে কোনও অন্য হিংসা বা ঘটনায় সেই অনুদান ব্যবহৃত হতে দেখতে ইচ্ছুক?
বাকি প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট নয় এখনও। ১৭ দিনের অনশন, ধর্না, গণকনভেনশন, নির্যাতিতার মূর্তি বসানোতে সত্যিই এমন বিপুল খরচ হলো কীভাবে? দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে খরচ স্বাভাবিক। তবে, সেই বিপুল খরচের পরে সত্যিই কি স্বাস্থ্যজগতে বদল এল? জুনিয়র ডাক্তাররা বলছেন, সাড়ে ৬ হাজার মানুষ ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের অর্থসাহায্য করেছেন। আন্দোলন চলাকালীন ২৫০টি সংস্থা চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এত মানুষের অনুদানে পুষ্ট আন্দোলন কি ন্যায়বিচারের পক্ষে আরও তীব্র সওয়াল করতে পারত না?