১৯৬৩ সালে জমিটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছিল
ফ্ল্যাট আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা! এড়াতে পারবেন হাসিনার আত্মীয়া টিউলিপ?
Bangladesh Tulip Siddiq: অভিযোগ, টিউলিপ সিদ্দিক কোনও টাকাপয়সা না দিয়েই ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড নামে একটি প্রপার্টি ডেভেলপার সংস্থার থেকে ওই অ্যাপার্টমেন্টটি পেয়েছেন।
একের পর এক অভিযোগ, সবটাই জড়িয়ে আছে দুর্নীতির সঙ্গে। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোনের কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে আবারও নতুন অভিযোগ। একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টকে ঘিরে বাংলাদেশে নতুন করে দুর্নীতির তদন্তের মুখোমুখি টিউলিপ। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের দাবি, এই বিলাসবহুল বাড়িটির মূল মালিক যে মূল সংস্থা, তার সঙ্গে কাজের বিনিময়ে লেবার পার্টির সাংসদ ও প্রাক্তন মন্ত্রী টিউলিপকে ঢাকার গুলশানে একটি ফ্ল্যাট 'অবৈধভাবে পুরস্কার' হিসেবে দেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক জেনারেল আখতার হোসেনের অভিযোগ, টিউলিপ সিদ্দিক কোনও টাকাপয়সা না দিয়েই ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড নামে একটি প্রপার্টি ডেভেলপার সংস্থার থেকে ওই অ্যাপার্টমেন্টটি পেয়েছেন। এই অভিযোগে ইতিমধ্যেই এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড সরকারি জমিতেই ওই অ্যাপার্টমেন্টটি তৈরি করেছে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বহু আগেই, ১৯৬৩ সালে জমিটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছিল। মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনওভাবেই এই জমি বিক্রি, উপহার বা ভাগাভাগি নিষিদ্ধ করার জন্য ৯৯-বছরের ইজারা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু টিউলিপ সিদ্দিকের মাসি শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে ২৮,৬৫৫ বর্গফুট এই জমিটি ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
আরও পড়ুন- ব্রিটেনের মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ! মাসি শেখ হাসিনার সঙ্গে দুর্নীতিতে যুক্ত টিউলিপ সিদ্দিকও?
দুর্নীতি দমন কমিশন দাবি করেছে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং টিউলিপ সিদ্দিক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজুকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ভুয়ো অনুমতিপত্র এবং জাল আইনি পথে ইজারা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ এড়াতে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করেন। যার ফলে ৩৬টি ফ্ল্যাট অননুমোদিতভাবেই স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছিল।
কমিশনের চার্জশিটে বলা হয়েছে, "রাজুক অবৈধভাবে ফ্ল্যাটগুলি ইস্টার্ন হাউজিংকে দিয়েছে, ৯৯ বছরের আগেই এই জমি পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করার বিনিময়ে টিউলিপ সিদ্দিককে অবৈধভাবে পুরস্কৃত করেছিল।" কমিশন বলছে, আনুষ্ঠানিক নথিতে দেখা যাচ্ছে, টিউলিপ সিদ্দিক এবং তাঁর মা শেখ রেহানা এই সম্পত্তির সুবিধাভোগী হিসাবে তালিকাভুক্ত। করের তথ্য এবং সংস্থার সঙ্গে একাধিক চিঠিপত্রে এই সম্পত্তির উপর দীর্ঘমেয়াদি দখলের ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু টাকা পয়সা দেওয়া সংক্রান্ত কোনও নথিই নেই।
এদিকে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের একটি চিঠিতেও স্পষ্ট জানা গেছে যে টিউলিপ সিদ্দিক বিনামূল্যে ওই ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন। দুর্নীতিবিরোধী এই কমিশনের অভিযোগ, পুরো লেনদেনটিই হয়েছিল ২০০১ সালের মে মাসে, ইজারার শর্ত লঙ্ঘন করেই এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফলেই তা করা সম্ভব হয়েছিল। কমিশনের এক আধিকারিক বলছেন, “জমিটি ৯৯ বছরের লিজে থাকায় সম্পত্তির কোনওরকম বিক্রয়, বিভাজন বা উপহার দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল, অর্থাৎ সম্পূর্ণ লেনদেনটিই এখানে বেআইনি।
টিউলিপ সিদ্দিক এবং অন্যদের বিরুদ্ধে কমিশনের অভিযোগপত্রে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে বাংলাদেশের দণ্ডবিধি ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে তিন থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড হতে পারে টিউলিপের।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে একাধিক দুর্নীতির মামলা চলছে টিউলিপের বিরুদ্ধে। জমি এবং ফ্ল্যাটের অবৈধ দখলের পাশাপাশি রাশিয়ার দ্বারা নির্মিত একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ৪ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন-কোথাও ৪০০০ কোটি, কোথাও ৫০০ কোটি! হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে
ব্রিটেনে টিউলিপ সিদ্দিক ছিলেন নগর ও দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী। আর্থিক দুর্নীতির নানা অভিযোগ ওঠায় পদত্যাগ করতে হয় টিউলিপকে। গত বছর অগাস্টে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। তারপর থেকে তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ব্রিটেনে আর্থিক পরিষেবার নীতির দায়িত্ব ছিল টিউলিপের হাতে। টাকা নয়ছয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়ভারও ছিল তাঁরই দায়িত্বে। নিজেই জানিয়েছিলেন, তাঁর অবস্থান "সরকারের কাজে বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। তাই আমি মন্ত্রীর অবস্থান থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।" বাংলাদেশের একটি আদালত টিউলিপ সিদ্দিকের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
অন্যদিকে টিউলিপের দাবি, "আমি ভুল করেছি এমন কোনও প্রমাণ নেই।" তিনি বলছেন, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার মাত্র। টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবীরা বলেছেন, “দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) গত কয়েক মাসে মিডিয়ার মাধ্যমে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ করেছে। অভিযোগগুলি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং সিদ্দিকের আইনজীবীরা লিখিতভাবেই তার মোকাবিলা করেছেন।"
আইনজীবীরা বলছেন, "পরিষ্কার বলা যায়, তিনি অবৈধ উপায়ে ঢাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট পেয়েছেন এমন কোনও অভিযোগের কোনও সত্যতা নেই। টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে করা এই বা অন্য কোনও অভিযোগের সমর্থনে দুদক কোনও প্রমাণ সরবরাহ করেনি এবং আমাদের কাছে এটা পরিষ্কার যে অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।"
যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে ২বি এক্সট্রাডিশন কান্ট্রি হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে - যার অর্থ মন্ত্রী এবং বিচারকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবার বাংলাদেশে পরিকাঠামোগত সরকারি খরচ থেকে ৩.৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করেছে দুদক। হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ববি হাজ্জাজের একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। এদিকে টিউলিপের আইনজীবীরা বলছেন, বাংলাদেশে কখনও জমি ছিল না সিদ্দিকদের এবং তিনি কখনও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বা অন্য কাউকে জমি বরাদ্দে প্রভাবিত করেননি। টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের জন্য পর্যাপ্ত নথি পেশ করতে পারবে তো বাংলাদেশ? নিছকই পরোয়ানা জারি করে, তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতার পথই প্রশস্ত হচ্ছে না তো বাংলাদেশে?