গাফিলতি নাকি ষড়যন্ত্র! কার ভুলে অলিম্পিকে এত বড় ভাগ্য বিপর্যয় বিনেশের?
Vinesh Phogat Disqualified:অলিম্পিকের একেবারে শেষ ধাপে গিয়ে খেলা থেকে বাদ পড়া যাওয়ার নেপথ্যে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেই মনে করছে বিরোধী শিবির।
একশো কোটির স্বপ্নভঙ্গ। এই অলিম্পিকে এখনও পর্যন্ত মাত্র তিনটি ব্রোঞ্জ নিজের ঝুলিতে পুরতে পেরেছে ভারত। মঙ্গলবার ভিনেশ ফোগটের দুর্দান্ত ফলাফলের পরে কার্যত ভারতের ভাগ্যে একটি রূপো নিশ্চিত হয়েই গিয়েছিল। বুধবার সোনার জন্য লড়াই করার কথা ছিল বিনেশের। অথচ সামান্য একশো গ্রাম ওজন বেশি হওয়ার কারণে ছিটকে গেলেন তিনি ফাইনাল থেকে। ফস্কে গেল তাঁর রৌপ্য পদকও। ৫০ কেজি মহিলাদের কুস্তিতে এই প্রথম ফাইনালে পৌঁছেছিল ভারত। একদিন আগেই অলিম্পিকের মঞ্চে দুর্ধর্ষ তিনটি ম্যাচ উপহার দিয়েছেন তিনি। জয় এসেছে হাসতে হাসতে। তার পরে বুধবার সকালেই চরম ভাগ্য বিপর্যয়।
এত বড় ট্র্যাজেডি অলিম্পিকে ক'টি ঘটেছে, জানা নেই। সারারাত ধরে নানা রকম কসরত করে ওজন কমানোর চেষ্টা করেছেন বিনেশ। তার আগে অত পরিশ্রমের তিন-তিনটি ম্যাচ। তার জন্য ইলেকট্রোলাইটও খেতে হয়েছিল ভারতীয় এই কুস্তিগিরকে। সে কারণেই কি ওজন বেড়ে গেল হঠাৎ করে? কেনF তাঁর পুষ্টিবিশেষজ্ঞ সে বিষয়টি খেয়ালে রাখলেন না? বুধবার প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যাওয়ার খবর সামনে আসার পরেই ভেঙে পড়েন বিনেশ। জনশূন্য হয়ে পড়ে শরীর। আপাতত সেই অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি তিনি। কিন্তু বারবার যে প্রশ্ন উঠেছে এই পরিস্থিতিতে, ঠিক কী কারণে এই ভয়ানক পরিণতি? কেন তীরে এসে তরী ডুবল বিনেশের? তাঁর কোচ বা ম্যানেজমেন্ট টিমের কী ভূমিকা এর নেপথ্যে? কুস্তিগির হিসেবে গাফিলতি রয়েছে কি ফোগটেরও? সেই প্রশ্নই এই পরিস্থিতিতে তুলে দিয়েছেন ব্যাডমিন্টন তারকা সাইনা নেওয়ালও।
আরও পড়ুন: মাত্র ১০০ গ্রাম ওজন বেশি! এক রাতেই কীভাবে অলিম্পিক বক্সিংয়ে অযোগ্য হলেন ভিনেশ?
২০২৪ প্যারিস অলিম্পিক থেকে খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে বিনেশকে। অথচ বুধবার সকাল পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে গোটা দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল তুঙ্গে। রূপো তো বাঁধা ছিলই, সব ঠিকঠাক থাকলে এ বারের অলিম্পিক থেকে একটি সোনাও ব্যাগস্থ করতে পারত ভারত। কিন্তু তেমনটা হল না। বুধবার ফাইনালের দিন সকালে ফের ওজন মাপা হয় বিনেশের। আর সেখানেই ১০০ গ্রাম ওজন বেশি আসে তাঁর। মহিলাদের ৫০ কেজির কুস্তি বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন বিনেশ। কিন্তু প্রতিযোগিতার জন্য ধার্য ওজনের থেকে ওজন বেশি আসে তাঁর। যে কারণে অলিম্পিকের নিয়মানুসারে ফাইনাল থেকে ছিটকে যান বিনেশ। শুধু ফাইনাল থেকেই নয়, কার্যত গোটা প্রতিযোগিতা থেকেই ছিটকে যান তিনি। ইতিমধ্যেই জিতে নেওয়া রূপোটুকুও হাতছাড়া হয়ে যায়। নিয়ম অনুযায়ী, সবচেয়ে কম পয়েন্টে থাকা পিছনের সারির প্রতিযোগীরও পরে চলে আসে বিনেশের নাম। অলিম্পিক কমিটি জানিয়ে দেন, এ বছর মহিলা কুস্তির ওই বিভাগে কাউকেই ওই রৌপ্যপদকটি দেওয়া হবে না। এদিন ফাইনালে আমেরিকার সারা হিলডেব্রান্টের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ছিল বিনেশের। কোনও রকম লড়াই না করেই স্বর্ণপদকটি চলে যাচ্ছে সারার কাছে।
স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনায় হতাশ গোটা দেশ। সেই হতাশাই ফুটে উঠেছে সাইনার গলাতেও। একজন স্পোর্টসম্যান হিসেবে তিনি বোঝেন, এই পরিস্থিতি বিনেশের পক্ষে কতটা যন্ত্রণাদায়ক। খেলায় হারজিত থাকেই। তবে এই ধরনের ছিটকে যাওয়া খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলেই মনে করছেন সাইনা। একই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, বিনেশ যথেষ্ট পোক্ত খেলোয়ার। এমনও নয়, তিনি এই প্রথম বার অলিম্পিকের মঞ্চে। এটি তাঁর তৃতীয় অলিম্পিক। প্রতিটি ধাপে নিজের একশো শতাংশ দিয়েছেন তিনি, তাতেও সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও এমন একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচের ফাইনালে বিনেশের তরফে এত বড় ভুল দেখে খানিকটা স্তম্ভিতও হয়েথেন তিনি।
খেলোয়ার মানে তো বিনেশ একা নন। তাঁর সঙ্গে যথেষ্ট দক্ষ কোচ রয়েছেন, রয়েছেন প্রশিক্ষক এবং ফিজিও, তাঁরাও বা অলিম্পিক ফাইনালের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ম্যাচে এত বড় গাফিলতি করবেন কী করে। সাইনার মত, অলিম্পিকের নিয়মকানুন জানার ক্ষেত্রে যদি বিনেশের কোনও গাফিলতি হয়ে থাকে, তা হলে এই দুর্ভাগ্যের দায় তাঁকেও নিতে হবে। এর আগে এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস ঘুরে এসেছেন বিনেশ, একাধিক বার চ্যাম্পিয়নও হয়েছেন। ফলে তাঁর সতর্ক থাকা উচিত ছিল যাতে তাঁর ওজন অনুমোদিক সীমার মধ্যে থাকে।
এই সমস্ত প্রশ্নের মধ্যেই উঠতে শুরু করেছে ষড়যন্ত্রের প্রশ্ন। অলিম্পিকের একেবারে শেষ ধাপে গিয়ে খেলা থেকে বাদ পড়া যাওয়ার নেপথ্যে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেই মনে করছে বিরোধী শিবির। তাঁদের বক্তব্য, একদিন আগেই যিনি লড়লেন এবং জিতলেন, তাঁর এ ভাবে বাদ পড়া কোনও মতেই সাধারণ ঘটনা হতে পারে না। এ নিয়ে বুধবার সরগরম হয়ে ওঠে সংসদও, বিক্ষোভও দেখান বিরোধী সংসদেরা। ক্রীড়ামন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন। এদিকে প্যারিসে এই মুহূর্তে রয়েছেন আইওসি প্রধান পিটি ঊষা। এদিন হাসপাতালে বিনেশকে দেখতেও যান তিনি। সূত্রের খবর, ভারতীয় দলের তরফে ভিনেশের বিষয়টি নিয়ে ফের আবেদন করা হবে।
কুস্তি ফেডারেশনের তৎকালীন মাথা ব্রিজভূষণের সঙ্গে লড়াইয়ের মুখ হয়ে উঠেছিলেন বিনেশ। সে সময় যন্তরমন্তরের সামনে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে দঙ্গলেও জড়ান তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে মুখ খোলায় বিজেপির বিরাগভাজন হয়েছিলেন বিনেশ। সে কারণেই কি ছিটকে যেতে হল অলিম্পিক থেকে, এমনও কথাবার্তা শুরু হয়েছে নানা মহলে। এদিকে ব্রিজভূষণের ছেলে তথা বিজেপি সাংসদ করণভূষণ শরণ সিংও এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন। কাইজারগঞ্জের বিজেপি সাংসদের বক্তব্য, ভিনেশের বাদ পড়াটা গোটা দেশের ক্ষতি। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, ফেডারেশন বিষয়টা নিয়ে কী করা যায় সেটা দেখছে।
এই ঘটনায় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন বিনেশের কাকা মহাবীর সিংও। তিনি জানান, ‘এই অযোগ্যতার পিছনে কিছু ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। আমি এখনও ওর (বিনেশ) সঙ্গে কথা বলিনি। এর কারণ কী ছিল, তা জানা যাবে ভিনেশের সঙ্গে কথা বলার পরেই। আমার ভাগ্নে আছে, ওর কাছ থেকে ফোন এসেছে।’ তাঁর কথায়, ‘গোটা দেশ সোনার আশা করেছিল... যাইহোক, নিয়ম আছে কিন্তু একজন কুস্তিগীর ৫০-১০০ গ্রাম বেশি ওজনের হলে খেলার অনুমতি দেওয়া হয়। আমি দেশের মানুষকে হতাশা না হতে বলব। ও নিশ্চিত ভাবে একদিন পদক আনবে... আমি ওকে পরবর্তী অলিম্পিক্সের জন্য প্রস্তুত করব।
বিনেশের এই ভয়াবহ ভাগ্যবিপর্যয়ের নেপথ্যে ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে প্রশ্ন তুলেছেন বিজেন্দ্র সিংয়ের মতো অলিম্পিক পদকজয়ীও। তাঁর কথায়, "ভারত ও ভারতীয় কুস্তিগীরদের বিরুদ্ধে এটা বিরাট এক ষড়যন্ত্র। ও যা পারফর্ম করেছে, তা প্রশংসার যোগ্য। হয়তো কেউ কেউ সুখ সহ্য করতে পারল না। আমরা এক রাতে ৫-৬ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলতে পারি, সেখানে ১০০ গ্রামটা কোনও ব্যাপারই নয়। আমার মনে হচ্ছে কারও কোনও সমস্যা ছিল আর সেই কারণেই ওকে বাতিল করা হল। আমি নিজে অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি। কোনও দিন এরকম কিছু শুনিনি।"
আরও পড়ুন: একশো কোটির স্বপ্নভঙ্গ! ট্র্যাজেডির অন্য নাম বিনেশ ফোগট
বিরোধী দলনেতা রাহুল গাঁধী এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, 'বিশ্বের সেরা কুস্তিগীরদের হারিয়ে ফাইনালে ওঠার পরেও টেকনিক্যাল কারণে ভারতের গৌরব বিনেশের বাদ পড়া দুর্ভাগ্যজনক। আমি নিশ্চিত ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থা দেশের মেয়ে যাতে ন্যায় পায় সেটা নিশ্চিত করতে এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করবে। বিনেশ মনোবল হারানোর মেয়ে নন। আমি নিশ্চিত উনি আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরবেন।' ষড়যন্ত্রের প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষও। নিজের এক্স হ্যান্ডলে তিনি লিখেছেন, 'বিনেশ ফোগত এমনিতেই বাতিল হল, নাকি ও পদক জিতলে মোদি কোম্পানির মুখ পুড়ত, তাই সর্বোচ্চ স্তরে অন্তর্ঘাত হল? রহস্য থাকছে।' ক্রীড়াপ্রেমীদের অনেকেই এই ঘটনায় বিজেপির হাত রয়েছে বলে দাবি করেছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। বলা হচ্ছে, বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ সিংহের অপসারণের জন্য আন্দোলন করার খেসারত দিতে হল বিনেশকে।
এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে বিনেশের কোচের দায়দায়িত্ব নিয়েও। কোনও ভাবে বিনেশকে অসুস্থ বা আনফিট ঘোষণা করতে পারলে অর্জিত রূপোটুকু বাঁচাতে পারতেন কুস্তিগীর। বহু ক্ষেত্রেই অলিম্পিকে তেমনটা করা হয়। কেন সেই পথে হাঁটলেন না বিনেশের কোচ বা তার ম্যানেজিং কমিটি? কেন এত পরিশ্রমের পরেও অর্জিত সাফল্যটুকুও ঘরে আনতে পারলেন না পরিশ্রমী এই ভারতীয় কুস্তিগির। সেই সব একগুচ্ছ প্রশ্নের মধ্যেই এই দিনটা আপামর ভারতবাসীর কাছেই অত্যন্ত হতাশা এবং দুঃখের, তেমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।