বাংলাদেশিদের চিকিৎসা না করার হুমকি ভারতের ডাক্তাররা দিতে পারেন?

Bangladesh Crisis: হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের এই সিদ্ধান্ত শুধু চিকিৎসা শাস্ত্রের বিচারে অনৈতিক নয়,একই সঙ্গে তা মানবতা বিরোধী।

এক ভয়ানক অন্ধকার সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। ভারত ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাকে সামনে রেখে যেভাবে দু' পারের মৌলবাদী ধর্মান্ধ শক্তি সীমান্তের দু'পারে খোলাখুলি হিংসার উস্কানি দিচ্ছে তা পরিবেশকে আরও বিষিয়ে দিচ্ছে। একথা অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই নেই যে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে মহম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর সেদেশে সংখ্যালঘুদের (ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু ও ক্রিশ্চান) উপর জামাতি শক্তির যে আগ্রাসন আমরা দেখতে পাচ্ছি তা সব অর্থে নিন্দনীয়। তবে এটা শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়। এই ঘৃণা এই মুহূর্তে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রধান সমস্যা। আমাদের দেশে ২০১৪ সালের পর থেকে সংখ্যালঘুদের উপর (ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান ও ক্রিশ্চান) অত্যাচার, নির্যাতন, গণ পিটুনির ঘটনা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপনের উদগাতারা প্রকাশ্যে সংখ্যালঘুদের নিকেশ করার হুমকি দিচ্ছেন। পদ্মাপারে হিন্দুরা যখন আক্রান্ত তখন উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে গুলি করে মারা হচ্ছে মুসলমান যুবকদের। এই ঘৃণার আগুনে ঘি ঢালছে কর্পোরেট মিডিয়া এবং নাগরিক কণ্ঠস্বরের নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় কদর্য আলাপন। পোস্ট ট্রুথের এই যুগে সত্য-মিথ্যার সীমারেখাকে অতিক্রম করে ফেক নিউজ হয়ে উঠছে একমাত্র বাস্তবতা। মানুষের যৌক্তিক চিন্তা যখন শেষ হয়ে যায় তখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসে ধর্মান্ধ মদমত্ততা। অপরের দেশের জাতীয় পতাকার অসম্মান সেই মত্ততারই অংশ। এই পর্বের শুরুটা হয়েছিল এক ভাইরাল ভিডিওর মাধ্যমে যাতে আমরা দেখতে পাই মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ বাংলাদেশে ভারতের জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করছেন। তারপর আমরা দেখলাম, আমাদের দেশে আগরতলায় বাংলাদেশের উপদূতাবাসের সামনে বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো এবং গতকাল এ রাজ্যের বারাসাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এই অবস্থায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দাবি করে যৌক্তিক বিচার, সহনশীলতা কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্য, এই ঘৃণার আগুনে রুটি সেঁকতে তৎপর হয়েছে তথাকথিত বিদ্বৎ সমাজের লোকজন। এই তালিকায় এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এ রাজ্যের মুষ্টিমেয় চিকিৎসক।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কলকাতার জে এন রায় হাসপাতালের ডিরেক্টর শুভ্রাংশু ভক্ত ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশে ভারতের জাতীয় পতাকা অবমাননার কারণে, তাঁদের হাসপাতালে বাংলাদেশি নাগরিকদের কোনও চিকিৎসা হবে না (দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৩০.১১.২০২৪)। পরবর্তীকালে সংবাদে আরও প্রকাশ, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে যুক্ত জনৈক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শেখর বন্দোপাধ্যায়, আর একজন চিকিৎসক বোলপুরের চন্দ্রনাথ অধিকারী, যিনি নাকি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত, কলকাতার একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ইন্দ্রনীল সাহা, একই কারণে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা পরামর্শ দেবেন না বলে জানিয়েছেন। এদের মধ্যে আরেকজন ডাক্তার আবার ফতোয়া দিয়েছেন, কোনও বাংলাদেশি রোগীকে চিকিৎসা করাতে হলে ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকার সময় ভারতীয় পতাকাকে প্রণাম করতে হবে (দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ১.১২.২০২৪)। বিষয়টা শুধু এ রাজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে আরও প্রকাশ যে, আইএলএস সহ ত্রিপুরার দুটো হাসপাতাল বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আরও পড়ুন-ফেলানি খাতুন থেকে স্বর্ণা দাস! যেভাবে সীমান্তে বারবার প্রাণ যায় সাধারণ বাংলাদেশিদের…

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের এই সিদ্ধান্ত শুধু চিকিৎসা শাস্ত্রের বিচারে অনৈতিক নয়,একই সঙ্গে তা মানবতা বিরোধী। এই প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের প্রেস বিজ্ঞপ্তি (রাংতা মুন্সী কর্তৃক প্রকাশিত ৩.১২.২০২৪) সঠিকভাবে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে, পেশায় যোগদানের সময় যে কোনও অবস্থায় রোগীর জীবন বাঁচানোই তাঁদের ব্রত বলে চিকিৎসকরা 'হিপোক্রেটিক' শপথ নেন। প্রথমত উক্ত চিকিৎসকরা এই মৌলিক নৈতিকতা ভঙ্গ করেছেন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেখানকার সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা না করার সিদ্ধান্ত (শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার জন্য) কেবল মানবতা বিরোধী নয়, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (crime against humanity)। বর্তমানে প্যালেস্টাইনবাসীদের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের দেওয়া (গত শতকে ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসিদের দেওয়া) সমষ্টিগত সাজার (collective punishment) এক কদর্য বহিঃপ্রকাশ ঘটল তাদের সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে।

ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ( আইএমএ) অঙ্গীকার অনুযায়ী, চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে রোগীর জাত, ধর্ম, নাগরিকত্ব, রাজনৈতিক বিশ্বাস, সামাজিক পরিচয় বিচার করবেন না কোনও চিকিৎসক। ওয়ার্ল্ড মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন গৃহীত চিকিৎসা নৈতিকতায় কোনও রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সময় রোগীর বয়স, রোগ বা প্রতিবন্ধকতা, ধর্ম বিশ্বাস, জাতিগত পরিচয়, লিঙ্গ পরিচয়, জাতীয়তা, রাজনৈতিক বিশ্বাস, সংস্কৃতি, যৌন পছন্দ, সামাজিক পরিচয় বা অন্য কোনও বিষয়ের ভিত্তিতে কোনওরকম বৈষম্য করবেন না। এই প্রেক্ষাপটে দেরিতে হলেও আইএমএ সংগঠনের ওয়েস্টবেঙ্গল চ্যাপ্টারের দুই সদস্যের মুষ্টিমেয় চিকিৎসকের এই অনৈতিক আচরণের বিরোধিতা স্বাগত। এক্ষেত্রে আরেকটি কথা সহজভাবে বলা দরকার। বাংলাদেশের রোগীরা মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে, ভারত সরকারের যথাযথ অনুমতি নিয়ে নিজেদের ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে এদেশে চিকিৎসা নিতে আসেন। কোনও দাতব্য গ্রহণ করতে নয়। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো ওদেশে গিয়ে রীতিমতো ক্যাম্প করে রোগীদের আমন্ত্রণ জানায়। এটা মেডিক্যাল ট্যুরিজম।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা জনজোয়ারের অন্যতম উপাদান ছিল হুমকি সংস্কৃতি প্রতিরোধের শপথ। আজ সেই হুমকি দিচ্ছেন রোগীদের প্রতি, কিছু চিকিৎসক। এই ব্ল্যাকমেলের সংস্কৃতির ধ্বজাধারী চিকিৎসকদের আচরণের তদন্ত হওয়া দরকার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্য যে, চিকিৎসক নামধারী কিছু মানুষের ধর্মান্ধ, অবিবেকি আচরণ এই পেশাকে কলঙ্কিত করছে। আশা করি অভয়ার বিচারের জন্য যাদের সঙ্গে আমরা পথ হাঁটছি, তারা এই চিকিৎসা নিষিদ্ধের বিরোধিতায় সরব হবেন।

আরও পড়ুন- কালীমূর্তি ভাঙার দৃশ্য বাংলাদেশের নয়, পশ্চিমবঙ্গের! জেনে নিন আসল তথ্য

এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার রাজনীতির ইতিহাস বহু প্রাচীন। ইতিহাস সাক্ষী, যখনই কোনও দুই দেশের শাসকদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে বা শাসক সংকটে পড়েছে তখনই নানা ঘটনা ঘটিয়ে দু'দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদের বীজ বপণ করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে কায়েমি স্বার্থ। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে উপমহাদেশের রাজনীতির স্থায়ী উপাদান হয়ে উঠেছে ধর্মীয় বিদ্বেষ। মসজিদ ভাঙা ও বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দাঙ্গার মধ্যে দিয়ে যে অসহিষ্ণুতা ও সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের রাজনীতি ভারতে সক্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, সেই একই সময় জুড়ে বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু বিরোধী রাজনীতির প্রবণতা বেড়েছে এবং হিন্দু সংখ্যালঘুর অভ্যন্তরেও হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক আশ্রয়ের প্রবণতা বেড়েছে। এটা যেমন সমগ্র বিশ্বের উদারবাদী অর্থনীতির রাজনৈতিক পরিণাম, ঠিক তেমনই বাংলাদেশের উপর ভারতের রাজনীতির প্রভাব।

ক্রিকেটের পিচ খুঁড়ে দেওয়া, এক দেশের সাংস্কৃতিক শিল্পীদের অন্য দেশে কাজ করতে না দেওয়া, প্রতিবেশী দেশের সিনেমার রিলিজ নিষিদ্ধ করার মতো ঘটনা ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে অহরহ ঘটছে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই কাজগুলো করতে প্রধান উদ্যোগী ভূমিকায় থাকছেন সেই ক্ষেত্রের মানুষজন। মুষ্টিমেয় চিকিৎসক সেই পঙ্কিল পথকেই বেছে নিলেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু-অধিকারের প্রশ্নটি সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসাবে উঠে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই উপমহাদেশে হিন্দুত্বের রাজনীতি এবং তাদের সুচতুর আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে ইসলামিক সামাজিক মৌলবাদ সংখ্যালঘুর অধিকারের বিষয়কে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের দিকে নিয়ে যেতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। এই অবস্থায় চিকিৎসা না করার হুমকি, জাতীয় পতাকার অসম্মান, ধর্মস্থানে ভাঙচুরের মতো ঘটনা সীমান্তের দু' পারের সংখ্যালঘুদের জীবনকে আরও বিপন্ন করে তুলবে। স্বদেশপ্রেমের স্বঘোষিত ঠিকেদারদের সেকথা বোঝাবে কে!

More Articles