রাহুলের চাপে দিশেহারা মোদির একমাত্র হাতিয়ার অম্বেদকর, এমারজেন্সি?
Modi in Parliament: মঙ্গলবার ভাষণ দিতে গিয়ে মোদি বলেন, ‘‘এটা জরুরি অবস্থার ৫০ বছর। ক্ষমতাসীন শাসকের স্বৈরাচারী মানসিকতার কারণেই জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। কংগ্রেস নির্দয়তার সব সীমা লঙ্ঘন করে গিয়েছিল সে সময়।
দশ বছর পরে গেরুয়া শিবিরকে টেক্কা দেওয়ার মতো বিরোধী শিবির পেয়েছে লোকসভা। গত এক দশকে এই প্রথমবার খালি নেই বিরোধী দলনেতার চেয়ার। অধিবেশন শুরু হতে না হতেই তা ভালো মতোই টের পেয়েছে বিজেপি। মোদির শপথগ্রহণের সময়েই কংগ্রেস সাংসদেরা মিলে মোদিকে সংবিধান দেখান। সোমবার রাহুল গান্ধি বক্তৃতা দিতে উঠে একের পর এক আক্রমণে বিদ্ধ করেন বিজেপিকে। বাদ যাননি নরেন্দ্র মোদি। বিজেপির হিন্দুত্ববাদ থেকে শুরু করে মোদির ঘৃণাভাষণ, সব কিছুকেই কটাক্ষ করেন রাহুল। বারবার প্রশ্ন তোলেন, মণিপুর নিয়ে কেন চুপ বিজেপি শিবির। শুধু রাহুলই নন, তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র থেকে শুরু করে মঙ্গলবারের অধিবেশনে মণিপুরের সাংসদ অঙ্গোমচা বিমল আকোইজম। মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে রীতিমতো তোপ দাগেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীত্বর নীরবতা নিয়ে তোলেন প্রশ্নও। তার পর মঙ্গলবারই সাংসদে জবাবি ভাষণ দিতে উঠলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। লোকসভা যে আর বিরোধীশূন্য নয়, তা মালুম পাওয়া গেল প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুরু হতেই। কার্যত মোদি বিরোধী স্লোগানে কাঁপল সংসদ। মণিপুরের নাম নিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করেন বিরোধী সাংসদেরা। কখনও শোনা যায় সুবিচারের দাবি, তো কখনও তাঁদের বলতে শোনা গেল 'তানাশাহি নেহি চলেগি'। তবে তার মধ্যেও চেনা আত্মবিশ্বাসে ফেরার চেষ্টা করলেন মোদি। চেনা ঢঙে চেষ্টা করলেন বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার।
লোকসভা ভোটের আগে একাধিক জনসভা থেকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে দেখা গিয়েছে মোদিকে। শুধু মোদিই নন, বিজেপির অন্যান্য নেতামন্ত্রীরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একাধিক বার ঘৃণাভাষণ করেছেন। মঙ্গলবার সাংসদে বলতে উঠে কংগ্রেসকে ফের নিশানা করতে দেখা গেল নরেন্দ্র মোদিকে। বিজেপির এনডিএ জোটকে হারাতে না পারলেও এই লোকসভা ভোটে তাদের ভালোমতোই টেক্কা দিয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট। এবার লোকসভায় মোদিবিরোধিতার স্বর স্বাভাবিক ভাবেই বেশ চড়া। মঙ্গলবার সকালে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তোপ দেগে বলেন, দেশে এখন ক্ষমতায় যে সরকার তা নড়বড়ে। কিন্তু তার প্রতিপক্ষ যে বিরোধী শিবির, তা যথেষ্ট শক্তিশালী। মঙ্গলবার বক্তৃতা দিতে উঠে ইন্ডিয়া জোটকে তোপ দেগে মোদিকে বলতে শোনা যায়, “বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র আমাদের তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচিত করেছে। ওদের নয়। আমরা বিকশিত ভারতের সংকল্প নিয়ে মানুষের কাছে গিয়েছিলাম। দেশের মানুষ বিবেচনা করেই আমাদের ফের ক্ষমতায় এনেছেন। অনেকে হাজার অপপ্রচার করে, মিথ্যা ছড়িয়েও পরাজিত হয়েছে।”
আরও পড়ুন: দেশ সংকটের দিকে যাচ্ছে! অরাজকতার ইঙ্গিত পাচ্ছি, কেন বললেন মোদি?
তবে ইন্ডিয়া জোটকে ছেড়ে শেষমেশ মোদির বক্তৃতা এসে থমকেছে কংগ্রেস আক্রমণেই। ২০২৪ সালের লোকসভার প্রথম অধিবেশনের আগেই মোদি যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তাতে উঠে এসেছিল ইমারজেন্সি বা জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার প্রসঙ্গ। সেদিন মোদিকে বলতে শোনা গিয়েছিল, 'ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতি যাঁরা বিশ্বাস রাখেন, তাঁদের জন্য ২৫ জুন এমন একটি দিন, যাঁ তাঁরা ভুলতে পারবেন না। আগামিকাল, ২৫ জুন ভারতের গণতন্ত্রে যে কালো দাগ লেগেছিল, তার ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ভারতের নতুন প্রজন্ম এই কথাটা কখনই ভুলবে না যে ভারতের সংবিধানকে সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘণ করা হয়েছিল, দেশকে জেলখানা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল।' সংবিধান রক্ষার সংকল্প নেওয়ার কথাও শোনা গিয়েছিল মোদির মুখে। মঙ্গলবার সংসদে ভাষণ দেওয়ার সময় ইন্দিরা গান্ধির সময়কালের সেই 'জরুরি অবস্থা'র কথা ফের তুলে ধরেন মোদি। ফের সংবিধানের কথা তুলে টেনে আনেন অম্বেদকরের প্রসঙ্গও। প্রসঙ্গত, এবার লোকসভা অধিবেশনের শুরু থেকেই বিরোধী শিবিরের অস্ত্র ছিল সংবিধান। এমনকী 'জয় শ্রী রাম' স্লোগানের প্রতিষেধক হিসেবেও 'জয় সংবিধান' স্লোগানের ব্যবহার করেছেন বিরোধীরা।
Speaking in the Lok Sabha. https://t.co/5ESs5cBMcM
— Narendra Modi (@narendramodi) July 2, 2024
মঙ্গলবার ভাষণ দিতে গিয়ে মোদি বলেন, ‘‘এটা জরুরি অবস্থার ৫০ বছর। ক্ষমতাসীন শাসকের স্বৈরাচারী মানসিকতার কারণেই জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। কংগ্রেস নির্দয়তার সব সীমা লঙ্ঘন করে গিয়েছিল সে সময়। দেশের স্থিতাবস্থা নষ্ট করার পাপ করেছিল ওরা। সরকার ফেলে দেওয়া, মিডিয়ার স্বর দমন করা, সমস্ত গণতন্ত্র বিরোধী কাজ সে সময় হয়েছিল। এখানেই থামেননি মোদি। কংগ্রেস জমানা নিয়ে আরও এক ধাপ সুর চড়িয়ে তাঁকে বলতে শোনা যায়, বাবাসাহেব অম্বেদকরকে উপেক্ষা করা হয়েছে সেসমেয়। নেহরুজি তাঁর রাজনৈতিক জীবন শেষ করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। প্রথমে তাঁকে হারানো হয়েছিল জোর করে। পরে তাঁর পরাজয়ের উদ্যাপন করা হয়। একটি চিঠিতে তা লেখা হয়েছে।’’ মোদির দাবি, "নেহরু মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখে সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছিল। ইন্দিরা গান্ধী মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট চেপে রেখেছিলেন। ... বি আর আম্বেদকার নেহেরুর ক্যাবিনেট থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন।" এখানেই শেষ নয়, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, মোদী বলেন, ‘‘জগজীবন রামকে অধিকার দেয়নি কংগ্রেস। এই নিয়ে একটি বইয়ে ইন্দিরার বক্তব্য রয়েছে। সীতারাম কেশরী, চৌধরি চরণ সিংহের সঙ্গেও পাপ হয়েছে। সেই পাপ লেগেছে কংগ্রেসের।’’
আরও পড়ুন: মোদির প্রিয় ম: মুসলিম, মাদ্রাসা, মাংস… মণিপুর কই? প্রশ্ন মহুয়ার
মঙ্গলবার বিজেপির 'অগ্নিবীর' প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রকে তোপ দেগেছেন রাহুল গান্ধি। এদিন সেই প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমাদের সেনা আধুনিক হচ্ছে। জবাব দিচ্ছে। আত্মনির্ভর ভারতে সেনাকে আত্মনির্ভর করার জন্য পদক্ষেপ করা হবে। যুবসমাজের উপর ভরসা রাখতে হবে। সেনাকে কমজোরি করেছে কংগ্রেস। নেহরুজির আমলে দুর্বল ছিল সেনা। নিজেরা কিছু করেনি। আমরা যখন চেষ্টা করেছি, ওরা ষড়যন্ত্র করেছে। ফাইটার জেট যাতে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে না পারে, তাই ষড়যন্ত্র করে। বালকবুদ্ধি দেখুন, সেনাকে ঠাট্টা করা হত। ’’ মোদির দাবি, ‘‘কংগ্রেস কার জন্য সেনাকে দুর্বল করছে? ইন্দিরাজি এক পদ এক অবসর ভাতা ব্যবস্থা বন্ধ করেছিলেন। কংগ্রেস পরে আর তা জারি করতে দেয়নি। এনডিএ এক পদ এক অবসর ভাতা চালু করেছে।’’ সবশেষে রাহুলকে নাম না করেই ফের বেঁধেন মোদি। জানান, ‘‘বালকবুদ্ধিকে সদ্বুদ্ধি দিক।’’
তবে মোদি যা-ই বলুক, বিরোধীদের একাধিক প্রশ্নের মুখে সেই চেনা জরুরি অবস্থা আর অম্বেদকর প্রশ্নেই সমস্ত সওয়ালের নিষ্পত্তি করতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে এ দিন সংসদভবনে মোদির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা বিরোধীস্বর বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রতিবারের মতো সহজ হবে না এবার লোকসভায় বিজেপির কাজ। গতবার একাধিক বিল পাশের সময় বিরোধীস্বরকে দমন করা হয়েছে লোকসভায়। কখনও বহিষ্কার করা হয়েছে সাংসদদের, কখনও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে সাংসদপদ? সেই পরিস্থিতি কি পাল্টাতে চলেছে ২০২৪-এ। আপাতত সেদিকেই নজর রাজনীতিমহলের।