উপাচার্য কে হবেন, সেই নিয়েও রাজনীতি! রাজ্যপাল-সরকারের দ্বন্দ্বে গোল্লায় যাচ্ছে উচ্চশিক্ষা
Vice Chancellor Crisis of West Bengal: এখানে একগাদা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে বটে, কিন্তু পরিকাঠামোগত উন্নয়ন কতটা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
গত কয়েক বছর ধরেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে ছেলেখেলা হয়েই চলেছে। এ রাজ্যে রাজনীতি এতই প্রাধান্য পায় যে, এই গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের মাঝেও রাজনীতি এসে পড়েছে। রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকার দুই পক্ষই রাজনীতি করছেন। প্রাথমিক শিক্ষা তো আগেই রসাতলে গেছে, এবার উচ্চশিক্ষাও যাতে জলাঞ্জলি যায়, তার ব্যবস্থা হচ্ছে। রাজ্যপাল তাঁর পদাধিকার বলে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হয়ে থাকেন। আইন করেই তাঁকে আচার্যের পদ দেওয়া হয়। এমনটাই হয়ে আসছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, দেশের বিভিন্ন রাজ্যেও একই নিয়ম।
কিন্তু রাজ্য সরকার রাজ্যপালকে আচার্য মানতেই প্রায় রাজি নয়। যখন থেকে আচার্য হিসেবে রাজ্যপাল নানা আপত্তি তুলতে শুরু করেছেন, তখন থেকেই রাজ্য সরকার রাজভবনকে এড়িয়ে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা চালানোর সব আয়োজন করতে শুরু করেছে। এই সংঘাত এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, ২০২২ সালের জুন মাসে রাজ্য সরকার বিধানসভাতে বিল পাশ করিয়েছিল যে, এবার থেকে মুখ্যমন্ত্রীই সব রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হবেন। যদিও সে বিল রাজভবনের অনুমোদন পায়নি।
আবার আচার্য হিসেবে রাজ্যপালও রাজ্য সরকারকে পাত্তা দিতে রাজি নন। রাজ্য সরকারের পদক্ষেপে কোনও গোলমাল মনে হলেই রাজ্যপাল রাজভবন থেকে সমান্তরাল প্রশাসন চালু করে দিচ্ছেন। জাঁতাকলে পড়ছে রাজ্যের শিক্ষাব্য়বস্থা।
এটাও যেমন ঠিক যে, রাজ্য সরকার নিয়ম মেনে উপাচার্য নিয়োগ করতে চাইছে না, রাজ্যপালের আপত্তি উঠলেই রাজ্য সরকার আইন বদল করতে চাইছে। সে আইন ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের (ইউজিসি) নিয়মাবলীর সঙ্গে না মিললেও, তাই জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। অন্যদিকে, নিজের ইচ্ছেমতো রাজ্য়পালও উপাচার্য নিয়োগ করে চলেছেন বিভিন্ন রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনিও নিয়ম মানছেন না। আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকরের আমল থেকেই রাজ্যে একটি সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর চেষ্টা করছে রাজভবন। নতুন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের আমলেও তার কিছুই বদলায়নি। অথচ রাজ্যপাল আসলে কেন্দ্রের প্রতিনিধি। তিনি নির্বাচিত নন। দেশের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন রাজ্যপালকে। সংবিধানে তাঁর বাঁধা কিছু ক্ষমতা রয়েছে। যদিও ভারতীয় সংবিধানের ১৬৩ নং অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রী পরিষদ রাজ্যপালকে তাঁর কর্তব্য পালনে সাহায্য করবে ও পরামর্শ দেবে কিন্তু এটাও বলা রয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী তিনি যদি কোনও কাজ করার প্রয়োজন মনে করেন তাহলে তিনি তাঁর ইচ্ছে মতো করতে পারেন।
আরও পড়ুন- পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘নিরঙ্কুশ’ জয় মানেই কি বাংলায় সব কিছু ঠিক?
এই ধরনের সাংবিধানিক পদাধিকারীদের নিয়ে তেমন কোনও সমস্যা হয় না, যদি একটি নির্বাচিত সরকার ও সেই সাংবিধানিক পদাধিকারীর মধ্যে সমন্বয় থাকে বা তিনি শাসক দলের আস্থাভাজন হোন। সাম্প্রতিক সময়ের রাষ্ট্রপতিদের দেখলেই মালুম হয় কতটা নির্বিঘ্নে তাঁরা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারেন। টেরই পাওয়া যায় না রাষ্ট্রপতি ভবনে কেউ আছেন। কাজ হয় একদম মসৃণভাবে। যদিও তিনি নির্বাচিত, আদতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার 'পরামর্শে' রাষ্ট্রপতি চলেন। কোনও বিল লোকসভা-রাজ্যসভা থেকে পাশ হয়ে এলে তাঁর হাতে সেটা আটকানোর ক্ষমতা থাকে বটে, কিন্তু শাসক দলের আস্থাভাজন হলে সে নিয়ে তাঁরা ঝামেলা করেন না।
সমস্যা রাজ্যপালদের নিয়ে। তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে নিযুক্ত হন। রাজ্যপালের নিয়োগের আগে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারেরর সঙ্গে আলোচনা করতে বাধ্য নয়। ফলে কেন্দ্রের সত্যিকারের প্রতিনিধি হিসেবেই তাঁরা থেকে যান। কেন্দ্রের শাসক দলের বিরোধী কোনও রাজনৈতিক দলের সরকার রাজ্যে থাকলে কীভাবে রাজ্যপালরা হেনস্থা করতে থাকেন সেই রাজ্য সরকারকে তার নজির অনেক রয়েছে।
কিন্তু উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সমস্যা দুই তরফেই। রাজ্য সরকার চায় নিজের পছন্দের লোককে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করতে। তাঁর পড়াশোনা, পড়ানো ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা, দেশে ও বিদেশের উচ্চশিক্ষা ব্য়বস্থা নিয়ে তাঁর পরিচয় ও জ্ঞান ইত্যাদি দ্বিতীয় সারিতে চলে যায়। অথচ একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় উপাচার্যের ভূমিকা অপরিসীম। সেখানে শুধু দলীয় আনুগত্য একমাত্র বা অন্যতম মাপকাঠি হতে পারে না। দুর্ভাগ্যের বিষয় গত কয়েক দশক ধরে অন্তত এই রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে তাই হয়ে আসছে। সৌভাগ্যের বিষয় এঁদের মধ্যেও কয়েকজন যোগ্য ও দক্ষ উপাচার্য ছিলেন।
শুধুমাত্র রাজ্য সরকারের ইচ্ছেমতো উপাচার্য নিয়োগ হয় না। তার জন্য একটি অনুসন্ধান বা সার্চ কমিটি তৈরি করতে হয়। তাতে ইউজিসির চেয়ারম্যানের মনোনীত একজন সদস্যকে রাখতে হয়। তাঁরা বিভিন্ন দিক বিচার করে তিনটি নাম দেন রাজ্যপাল বা আচার্যকে। সেই নাম থেকে আচার্য বেছে নেন উপাচার্যকে। সাধারণত তালিকার প্রথম নামটিতে শিলমোহর দেন আচার্য।
২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে এই সরকার যে পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় আইন (সংশোধনী) বিল ২০১১ এনেছিল, তাতে সার্চ কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়ছিল আচার্যের মনোনীত সদস্য এবং সেখানে সেনেটের মনোনীত সদস্যেরও স্থান ছিল। উচ্চশিক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই আচার্য তাঁর প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন বলে আইনে বলা হয়েছে। সেই ব্যক্তিকে অন্তত কোনও কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদমর্যাদার হতে হবে।
সেই আইনেই বলা রয়েছে যে, উপাচার্যের চার বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তাঁকে আরও চার বছরের জন্য সেই পদে পুনর্বহাল করা যাবে। তারপরেও তাঁর উত্তরসূরিকে বাছা না পর্যন্ত তিনি উপাচার্য পদে থাকতে পারেন, কিন্তু সেই মেয়াদও ছয় মাসের বেশি হবে না।
কিন্তু গোল বাঁধল যখন ২০২১ সালের অগাস্ট মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোনালী চক্রবর্তীকে দ্বিতীয়বারের জন্য উপাচার্য হিসেবে পুনর্নিয়োগ করল রাজ্য সরকার। রাজভবনের আপত্তি উড়িয়ে শিক্ষা দফতরের বিশেষ সচিবের সাক্ষরেই এই পুনর্নিয়োগ হল। কারণ আইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী পুনর্নিয়োগের ক্ষমতাও রাজ্যপাল বা আচার্যের হাতেই থাকার কথা। রাজ্য সরকার যে আইনই তৈরি করে থাকুক, তা ইউজিসির নিয়মাবলীর বিপক্ষে যেতে পারে না কারণ শিক্ষা রাজ্য ও কেন্দ্রের যৌথ তালিকাভুক্ত হলেও, কোনও সংঘাত হলে কেন্দ্রীয় আইনই প্রাধান্য পাবে। ইউজিসি একটি কেন্দ্রীয় আইনের মাধ্যমে তৈরি করা সংস্থা। সেই সিদ্ধান্ত হাইকোর্ট ঘুরে সুপ্রিমকোর্টেও খারিজ হয়ে গেল। ব্যাস, তারপর থেকে রাজ্যপাল বনাম সরকারের দ্বন্দ্ব আর থামছেই না।
বর্তমান রাজ্যপাল যখন তখন উপাচার্যদের ডেকে পাঠাতে থাকলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যেতে লাগলেন, এমনকী নিজের ইচ্ছেমতো রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যও নিয়োগ করে দিলেন। তার মধ্যে একজন প্রাক্তন বিচারপতিকেও উপাচার্য করে দিলেন, আইন খুলে দেখলে তাঁর উপাচার্য হওয়ার কথা নয়।
আরও পড়ুন- কোনও ধর্মের জন্য আর আলাদা বিধি নয়! অভিন্ন দেওয়ানি বিধির নামে কী চাইছেন মোদি?
সর্বশেষ যে আইনটি রাজ্য সরকার পাশ করেছে, তাতে সার্চ কমিটিতে কারা কারা থাকবেন, তা ঠিক করা হয়েছে। এবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের মনোনীত সদস্যকে সার্চ কমিটিতে রাখা হবে না। আগের আইনে যা ছিল।
এই ডামাডোলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হতে বাধ্য। একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাল ধরতে উপাচার্যের দূরদর্শিতা, পরিকল্পনা, পরিচালনার দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পড়াশোনার মান উন্নয়ন ও চাকরির বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষার যেমন দরকার, তেমনই দরকার গবেষণা। যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়েরই উচিত গবেষণার প্রতি জোর দেওয়া। উচ্চমানের গবেষণার মাধ্যমে শুধুই যে জ্ঞানভাণ্ডার ভর্তি হয় তা নয়, সঠিক পথে গেলে গবেষণার মাধ্যমে বহু সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানও সম্ভব। কারও কারও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই কাজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে হয়তো হচ্ছে, কিন্তু সামগ্রিক উদ্যোগ না নিলে, সর্বস্তরে তার ফল পাওয়া সম্ভব নয়। কাজেই রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে রাজ্যের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে রুটিন কাজই হচ্ছে, কাজের কাজ কমই হচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সামগ্রিক পরিকল্পনাই খুব গোলমেলে। এখানে একগাদা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে বটে, কিন্তু পরিকাঠামোগত উন্নয়ন কতটা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কতজন যোগ্য শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে?
এই বছরেই বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে স্পেশাল লেকচারারের পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। তাতে নেট ও পিএইচডি পাশ করা প্রার্থীদের প্রতি ক্লাস ৩০০ টাকার বিনিময়ে নেওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। তাও আবার প্রতি সপ্তাহে চারটির বেশি ক্লাস তাঁরা নিতে পারবেন না। খুব বেশি হলে তাঁরা মাসে ৪৮০০ টাকা পাবেন। এই অবস্থাতেই রাজ্যের উচ্চশিক্ষা 'অস্থায়ী' ভিত্তিতে চালানোর উদ্যোগ কার ক্ষতি করছে তা এখন বোঝা যাবে না। কিন্তু আরও কয়েক বছর পরেই কঙ্কাল বেরিয়ে আসবে। আমরা আরও পিছিয়ে পড়ব দিন দিন।
শাসক দলও চিরদিন এক থাকবে না, রাজ্যপালও এক থাকবে না। রাজ্য় থাকবে। আর রাজ্যবাসীকে অথৈ জলে ডুবিয়ে তারা বিদায় নেবে!