গারদের ফাঁক থেকেই মুক্তির স্বপ্ন দেখান নার্গিসেরা
Narges Mohammadi: দিনের পর দিন ইসলামিক আইনের বিরোধিতা করে মেয়েদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করেছেন নার্গিস। দেশদ্রোহী প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগে তাঁকে ইরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে আটক রাখা হয়েছে।
নার্গিস মহম্মদি লিখেছিলেন, জেলখানার জানলার ফাঁকটুকুই তাঁর বিশ্ব। সেখান দিয়েই তিনি তেহরানের উত্তর দিকের পাহাড়ের গাছ ও ফুল দেখেন। এই দৃশ্যটুকুই নার্গিসকে মুক্ত ইরানের কথা ভাবতে সাহায্য করে। তাঁর কথায়, ওরা আমাকে আরও শাস্তি দিক, কেড়ে নিক আমার স্বাধীনতা, আমি তাতে আরও বদ্ধপরিকর হয়ে উঠব। ইরানে গণতন্ত্র আনতেই হবে। ইরানে স্বাধীনতা চাই। ২০২২ সালে ইরানে যখন হিজাব আইনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হল, পাশ্চাত্য মিডিয়াকে একাধিক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন নার্গিস। ইরান সরকার আর তাঁকে টেলিফোনে কথা বলতে দেয় না, সাক্ষাৎকার দিতে দেয় না। কারণ নার্গিসরা সহ-নাগরিকদের জাগিয়ে দিতে চান। কথা বলেন সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা আসলে ভয় পায়, নার্গিসদের চিৎকারে যদি বাকিদের ঘুমও ভেঙে যায়।
বিশ্বব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের অধিকার দিন দিন কমছে। বাড়ছে নারীর উপর হিংসা, অত্যাচার। অপশাসন ও কর্তৃত্ব ফলানোর এই যে ভয়ঙ্কর চেষ্টা, তা-ও দিন দিন বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। যেমন আমেরিকা ও ইউরোপে বর্ণবাদ, ভারতে হিন্দু ফ্যাসিজমের পুনরুত্থান, ফিলিস্তিনিদের উপর ইজরায়েলের লাগাতার আক্রমণ এবং ইরানে আইনের নামে নারীর মানবাধিকারকে একটু একটু করে ছিনিয়ে নেওয়া, কোনওটাই এর বাইরে নয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে মেয়েদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। তখন নতুন শীর্ষ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনেই আইন করলেন, ধর্ম যাই হোক না কেন ইরানের সব নারীকেই হিজাব পরতে হবে। সে বছর ৮ই মার্চ আন্তজার্তিক নারী দিবসে হাজার হাজার নারী বিক্ষোভ করেছিলেন। ইরানে এমন কোনও আইন নেই যা তাঁদের পুরুষদের ফুটবল খেলা দেখা থেকে আটকায়। অথচ বিপ্লবের পর থেকে মেয়েদের আর স্টেডিয়ামে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কোনও ভাবে ঢুকে পড়লে বা ঢোকার চেষ্টাও করলেই তাদের আটক করা হয়। এই ইসলামি বিপ্লবের পর দেশটিতে আমূল পরিবর্তন হয়। তার আগে ১৯৩০-এর দশকে ইরানের শাহ মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করেছিলেন। উল্টে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া ছিল, যে কোনও মেয়ে হিজাব পরে থাকলে তা জোর করে খোলাতে হবে।
আরও পড়ুন: নারীর অধিকারের লড়াইয়ে বারবার জেল, সেই অদম্য নার্গিসকেই এবার শান্তির নোবেল
শীর্ষ ধর্মীয় নেতাই এখন ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনিই দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান, বিচার বিভাগের প্রধানে নিয়োগ হয় তাঁরই হাতে। নিরাপত্তা বাহিনী, রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র (টিভি, রেডিও) তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের যে কোনও ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা সেই শীর্ষনেতার হাতেই। ইরানের আইনানুসারে, হেড স্কার্ফ বা হিজাব যেহেতু বাধ্যতামূলক, অন্যদেশের নারীদেরও সেখানে গিয়ে সেই আইন মেনে চলতে হয়। ২০১৮ সালে চিনের এক সঙ্গীত শিল্পী ইরানে এক কনসার্টে গিয়েছিলেন, কনসার্ট চলাকালীনই তাঁকে হিজাব পরতে বাধ্য করা হয়। ইরানের নারীদের প্রতি বৈষম্য নিয়ে প্রথম সরব হন নার্গিস মহম্মদি। নার্গিসের লড়াইয়ের শুরু সেই নব্বই দশকে। সে সময় তিনি দেশেরই এক কলেজে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতেন। তাঁর সাহস, বক্তব্যের তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতা যেন বার বার রাগিয়ে দিয়েছে ইরান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। তার জন্য চরম শাস্তিও পেতে হয়েছে তাঁকে।
দিনের পর দিন ইসলামিক আইনের বিরোধিতা করে মেয়েদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করেছেন নার্গিস। দেশদ্রোহী প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগে তাঁকে ইরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। কারাগারেও হিজাব পরতে চাননি তিনি। তেরো বার গ্রেফতার হয়েছেন, ৫ বার দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে ৩১ বছর জেলবন্দি করা হয়েছে তাঁকে। ২০২২ সালে এভিন কারাগার থেকে তিনি একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেখানে লিখেছিলেন, সরকারবিরোধী বিক্ষোভের অভিযোগে বন্দি নারীদের উপর কীভাবে যৌন ও শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তিনি শুধু ইরানের নারীদেরই নয়, দেশের সকল নাগরিকের মানবধিকার রক্ষা এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন।
২০২৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ইরানের কারাগারে বন্দি নার্গিস। কিন্তু নরওয়েতে পুরস্কার নিতে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি তেহরান প্রশাসন। নার্গিসের যমজ সন্তান আলি এবং কিয়ানাই মায়েরা তরফ থেকে পুরস্কার নিতে গিয়েছিলেন। তাঁরাই গোটা বিশ্বকে মায়ের বার্তা পড়ে শুনিয়েছিলেন। নার্গিসের স্বামী এবং দুই সন্তান ফ্রান্সে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকেন। নোবেল কমিটি নার্গিসকে সম্মান জানাতে অনুষ্ঠানের একটি চেয়ার ফাঁকা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নোবেল কমিটি দ্রুত নার্গিসের চিকিৎসা ব্যবস্থা করার জন্য ইরান সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছিল। যদিও তার পরও কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে কোনও হেরফের হয়নি। ইরান সরকার জানিয়েছিল, যেহেতু নার্গিস কারাগারেও শরিয়তি আইন অনুযায়ী হিজাব পরতে চাননি, তাই অসুস্থতা সত্ত্বেও তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা যাবে না। ৯ সপ্তাহ অসুস্থ থাকার পর ২৮ অক্টোবর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
২০২১ সালের ১৫ অগস্ট ইরানের প্রেসিডেন্ট তথা ধর্মীয় নেতা ইব্রাহিম রাইসি নতুন ঘোষণা সামনে আনেন। বলা হয়েছিল, নারীরা কী ধরনের পোশাক পরে প্রকাশ্যে ঘুরছে, তা নজর রাখার জন্য ক্যামেরা বসানো হবে। যাঁরা আইন মানবে না, তাঁদের জরিমানা করা হবে, নয়তো কাউন্সিলিং-এর পরামর্শ দেওয়া হবে। আর যদি কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় হিজাবের বিরুদ্ধে কোনও পোস্ট করেন তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হবে। ২০২২ এবং ২০২৩ সালে ইরানের বাধ্যতামূলক হিজাব আইনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হয়। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ইরান আইনানুযায়ী পোশাকবিধি না মানার অভিযোগে রাজধানী তেহরানে মাহসা আমিনিকে আটক করে পুলিশ। থানায় নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মাহসা অজ্ঞান হয়ে যান। হেফাজতেই তাঁর মৃত্যু হয়। মাহসার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। মাথায় আঘাত ও রক্তক্ষরণ নিয়ে তিন দিন কোমাতেও ছিলেন। এই ঘটনার বিরোধিতায় ইরানের মেয়েরা আন্দোলনে নেমে হিজাব পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর পর সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে যায় এমন একাধিক পোস্টে, যেখানে মেয়েরা হেডস্কার্ফ পরতে অস্বীকার করেন। এই নারীরা একা ছিলেন না। প্রচুর পুরুষও তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ইরানে হিজাব আইন কড়াকড়ি ভাবে প্রয়োগ করতে পুলিশ রাস্তায় টহল দিত। কিন্তু মাহসার মৃত্যুর ঘটনায় দেশ জুড়ে এমন বিক্ষোভ শুরু হয় যে পুলিশের টহল স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল ইরান সরকার।
ইরানে হিজাব নিয়ে এমন ঘটনা নতুন নয়। ২০১৯ সালে সাদাফ খাদেম নামে এক মহিলা দেশের ক্রীড়া বিভাগের অনুমতি না থাকার পরেও ফ্রান্সের একটি বক্সিং প্রতিযোগিতায় যান। ২৪ বছরের ওই সাদাফ ফরাসি বক্সার এনি চৌভিনকে হারান। প্রতিযোগিতায় দেশের জাতীয় পতাকার সঙ্গে রং মিলিয়ে জামা পরেছিলেন খাদেম। একটি সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারে খাদেম বলেন, 'ফ্রান্সে আমি একটি অনুমোদিত প্রতিযোগিতাতেই অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার পরনে ছিল ছোট প্যান্ট এবং টি-শার্ট, যা কিনা পুরো বিশ্বের চোখে স্বাভাবিক হলেও আমার নিজের দেশের নিয়মকে সেটি অসন্তুষ্ট করে।' সম্প্রতি উত্তর-পশ্চিম তেহরানের ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ক্যাম্পাসে আহু দারিয়াই নামে এক তরুণী অন্তর্বাস পরে ঘুরে বেড়ান। ইসলামের শরিয়ত নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্র ঠিক করে দিয়েছে নারীর মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে, শরীর ঢেকে রাখতে হবে লম্বা লম্বা ঢিলেঢালা পোশাকে। এই সকল কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ওই তরুণী। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাবাহিনী আহু দারিয়াইকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। তার পর রটিয়ে দেওয়া হয়, সে মানসিক রোগে আক্রান্ত। পরে জানা যায়, আসলে বাসিজ নামে এক স্বেচ্ছাসেবক আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা পোশাক বিধি না মানার জন্য তাঁকে হেনস্থা করে, এরই প্রতিবাদে ওই তরুণী অন্তর্বাস পরে ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করেন। মানবধিকার রক্ষা কর্মীরা দাবি করে থাকেন, ইরান সরকার বিক্ষোভকারীদের মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দেগে দিয়ে তাদের মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। ইউরোনিউজ-এর তথ্য অনুযায়ী, আহু দারিয়াইকে গোয়েন্দা এজেন্টরা অজ্ঞাত কোনও স্থানে নিয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:অর্চনা-লতিকা কিংবা ননীবালাদের লড়াই মনে রাখে না ইতিহাস
রাষ্ট্রে যা ঘটছে তা সবাইকে জানানো জরুরি। কেবল ক্ষমতাবান ব্যক্তিরাই বুঝলে হবে না। জবাবদিহি না করা রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে খারাপ উদাহরণগুলির মধ্যে একটি। আর পৃথিবীর একের পর এক দেশজুড়ে এই প্রবণতাই বেশি দেখা যাচ্ছে আজকাল। ইরান সরকার স্বীকার করেনি যে মাহসা অমিনিকে তারাই মেরেছে। কেউ জানেন না, আহু দারিয়াই বেঁচে আছেন কিনা? কেউ জানেন না, নার্গিসরা কখনও স্বচ্ছ বিচার পাবেন কিনা? এই অহিংস বিক্ষোভের পরিণতি যদি এই হয়, মানুষের কি তবে অন্যভাবে ভাবা উচিত এবার? তাহলে তো একদিন না একদিন চরমপন্থা জেগে উঠবেই, যখন আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।