আরজি করের প্রতিবাদ আন্দোলন নকশালবাড়ি, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতোই তীব্র?

RG Kar Mass Movement: আরজি করের ঘটনাটি ঘিরে যে প্রতিবাদ হচ্ছে তা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকে কতটা আলাদা?

পশ্চিমবঙ্গ বহু আন্দোলনের পীঠস্থান। এই মুহূর্তে আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে উত্তাল বঙ্গ রাজনীতি। টানা একমাস ধরে রোজ কোথাও না কোথাও প্রতিবাদ হয়ে চলেছে। দিন-রাত জুনিয়ার ডাক্তারদের বিক্ষোভে সামিল হচ্ছেন সাধারণ মানুষও। দিকে দিকে জমায়েত হয়েছে।তুমুল বৃষ্টি, চড়া রোদ কিছুই দমাতে পারেনি তাঁদের। সাধারণ জনগণই ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন শুকনো খাবার, জল, মাথা গোঁজার ছাউনির। অভিযোগ, বিক্ষোভকারীদের মিটিং-মিছিল-সমাবেশে আক্রমণও চালিয়েছে শাসকদলের ঘনিষ্ঠরা। তবুও আন্দোলন থামেনি বরং আরও জোরালো হয়েছে। কলকাতার-সহ রাজ্যজুড়ে রাজপথ জুড়ে প্রতিবাদের গ্রাফিতি বানানো হয়েছে। চলছে নাচ, গান পথনাটক। রাস্তায় রাস্তায় লিফলেট, হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করা হচ্ছে। রাস্তায় নেমেছেন শিশু থেকে বৃদ্ধা সকলেই। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। আকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে সারারাত মেয়েদের থিয়েটার হয়েছে। সেদিন বহু শিশুও রাত জেগেছে। দর্শক আসন থেকে স্লোগান উঠেছে। শীর্ষ আদালত জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরার সময় বেঁধে দিয়েছিল। এর আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কর্মবিরতি প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন বহুবার। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তাররা দাবিতে অনড়। জুনিয়র ডাক্তাররা প্রতীকী শিরদাঁড়া হাতে লালবাজার অভিযান এবং প্রতীকী মস্তিষ্ক ও ঝাঁটা হাতে স্বাস্থ্যভবন অভিযান করেছেন। তাঁরা ৫ দফা দাবি জানিয়েছেন। সেই দাবি না মানা পর্যন্ত তাঁরা স্বাস্থ্যভবনের সামনেই অবস্থান করবেন বলে জানিয়েছেন। এই আন্দোলন বঙ্গ রাজনীতির বড় অধ্যায় হয়ে রয়ে যাবে তা বোঝাই যাচ্ছে। তবে স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলির তীব্রতার সঙ্গে কি আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদের তীব্রতা মেলানো যায়? বাংলার মানুষ কি আগে এমন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দেখেছেন? 

ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং খাদ্য আন্দোলন

ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে যে রক্তাক্ত আন্দোলন দেখেছিল বঙ্গবাসী তা ঐতিহসিক। এই আন্দোলন বামেদের জমি শক্ত করতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল। ১৯৫৩ সালের ২৫ জুন কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ১ জুলাই থেকে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া ১ পয়সা করে বাড়ানো হবে। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এতে সমর্থন জানালেও বাম দলগুলি ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ শুরু করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই প্রতিবাদ তীব্র রূপ নেয়। আন্দোলনে কাতারে কাতারে সাধারণ জনগণ, ছাত্ররা সামিল হন। ব্রিটিশ ট্রাম কোম্পানির প্রতি তীব্র ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল জনগণ। কংগ্রেস সরকারের পুলিশ আন্দোলন দমনে লেগে পড়েছিল। বাম দলগুলি গড়ে তুলেছিল 'প্রতিরোধ কমিটি'। এই কমিটির প্রধান মাথা ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা হেমন্ত বসু, সিপিআই নেতা জ্যোতি বসু।

আরও পড়ুন- ১ পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কেঁপেছিল কলকাতা, ট্রামের মতোই ম্রিয়মাণ বাম আন্দোলন?

কমিটি ঘোষণা করেছিল, ১ জুলাই যেন মানুষ পুরনো ভাড়া দিয়েই ট্রামে যাতায়াত করেন। ট্রাম পুরনো ভাড়া নিতে অস্বীকার করলে বিনা টিকিটেই যাত্রা করেন অনেকে। ট্রামের মধ্যেই চলে স্লোগান। ২ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় হুঁশিয়ারি দেন। শুরু হয় গ্রেফতারি, হরতাল, ট্রাম বয়কট। প্রথমবার কলকাতার রাস্তায় খালি ট্রাম চলছিল। ৩ জুলাই থেকে পরিস্থিতি উত্তাল হলে ট্রাম চলাচল বন্ধ করা হয়। সদ্য জামিন পাওয়া জ্যোতি বসু এবং অন্য নেতারা ট্রাম কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান শুরু করেন। ফের জ্যোতি বসু সহ কমিটির প্রধানদের গ্রেফতার করা হয়। মোট ৬০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সেদিন। সে সময় মেঘনাদ সাহা এবং হীরেন মুখোপাধ্যারা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে সমাধানে উদ্যোগী হতে আহ্বান জানান। ৫ জুলাই আসানসোলে বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ৫ জনের মৃত্যু হয়। শুরু হয় সভা সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা। ১৬ জুলাই মিলিটারি নামায় শাসকদল। সেই রাতেই প্রায় ৪,০০০ জন গ্রেফতার হন। এদিন ১৮ বছর বয়সি একজনের মৃত্যুও হয়। রাজ্য সরকার চাপে পড়ে ২ অগাস্ট জ্যোতি বসু সহ প্রায় সকলকেই মুক্তি দেয়। কমিটির সঙ্গে আলোচনা হয় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর। ৩১ জুলাই ট্রাম ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। শেষে পুরনো ভাড়াতেই কলকাতার ট্রাম পরিষেবা শুরু হয়।

এমনই উত্তাল পরিস্থিতিতে ১৯৫৯ সালের ৩১ অগাস্ট খাদ্যের দাবিতে, খাদ্যমন্ত্রীর অপসারণ এবং পুলিশ দমন পীড়নের প্রতিবাদে কলকাতায় নানা গ্রাম থেকে এসে উপস্থিত হন লক্ষ লক্ষ মানুষ। মিছিল শুরু হয় ওল্ড কোর্ট হাউজ স্ট্রিট থেকে। শিশু-কোলে বহু নারীরাও আন্দোলনে যোগ দেন। ময়দান থেকে এসপ্লানেডে মানুষের ঢল দেখা গিয়েছিল। গ্রামের মানুষরা যাতে কলকাতায় আন্দোলনে যোগ দিতে না পারেন, তাই নানাভাবে পথ আটকাতে চায় পুলিশ। তবুও মানুষ বাঁধ ভেঙে আন্দোলনে সামিল হন। সভা চলাকালীন বৃষ্টি নামলেও বিক্ষোভের তীব্রতা কমেনি। আবার মিছিল করে মহাকরণের দিকে এগোন আন্দোলনকারীরা। রাজভবনের কাছে পুলিশ মিছিল আটকে দেয়। শুরু হয় লাঠিচার্জ, গুলি, গ্রেফতারি। সরকারি হিসেবে সেদিন আহত হয়েছিলেন ১৫০ জন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলি লিখেছিল ৩০০ থেকে ৪০০ জনের আহতের কথা। জানা গিয়েছিল, বিক্ষোভকারীরা যাতে পালিয়ে না যান, তাই পুলিশে ছয়লাপ করা হয় ধর্মতলা চত্বর। মেট্রো সিনেমার গলি, চিৎপুর রোড, ডেকার্স লেনের এলাকাগুলি পুলিশবাহিনী ঘিরে নিয়েছিল। গ্রাম থেকে আসা মানুষ কলকাতার পথ-ঘাট চেনেন না। প্রাণ বাঁচাতে অলিতে গলিতে ঢুকে পড়েছিলেন।

পরদিন রাজ্য জুড়ে ছাত্র ধর্মঘট হয়, আবার বিক্ষোভে গুলি চলে। সেদিন ৮জন ছাত্রর মৃত্যু হয়। ফের ৩ সেপ্টেম্বর হরতাল হয়। গুলি লেগে মৃত্যু হয় আরও ১২ জনের। এর অনেক আগে থেকেই জেলায় জেলায় আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ৫ অগাস্ট বহরমপুরের জেলা শাসকের বাড়ি ঘেরাও করা হয়। সেখানে এত মানুষ জড়ো হয়েছিলেন যে জেলা শাসক পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।

১৯৫৭ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়। ১৯৫৮ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ শাখা খাদ্যাভাবের পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ করার জন্য আবেদন করেছিল কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস সরকার কোনও পদক্ষেপ করেনি। ১৯৫৯ সালে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়। গ্রামে গ্রামে খাদ্যের দাবিতে পথে নেমেছিলেন মানুষ, বেছে নিয়েছিলেন গণ-আন্দোলনের পথ। বামপন্থী বিভিন্ন দল এবং গণ-সংগঠনের ডাকে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। আন্দোলন শুরু হতেই সরকারি দমনপীড়ন শুরু হয়ে যায়। ৩ দিনের মধ্যে ৭ হাজারের বেশি বাম কর্মী-সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১৩ জুলাই 'জেল ভরো' আন্দোলন হয়।

আরও পড়ুন- বিপ্লব থেকে গুণ্ডামি, যে পথে এগিয়েছে বাংলার ‘জ্বালিয়ে দাও-পুড়িয়ে দাও’ আন্দোলন

নকশাল আন্দোলন

১৯৬৭ সালে, পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর বামপন্থার দু'টি ধারা, সংসদীয় পথ ও বিপ্লবী পথ তুমুল রূপ নিয়েছিল। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী সহ বাকি নেতাদের নেতৃত্বে গণসংগ্রাম জোরদার হয়। চারু মজুমদার সেই সময়ের দমনমূলক পরিস্থিতিতে অকংগ্রেসি সরকারগুলির উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রকে উচ্ছেদ করতে বিকল্প সরকারের ব্যবহার করতে হবে। আর সেই পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হয় তরাই অঞ্চলে। নকশালবাড়ি, খরিবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া এই তিনটি ব্লকে কয়েক হাজার কৃষকের উপস্থিতিতে এবং সিপিআই(এম)-এর নেতৃবৃন্দদের নিয়ে কৃষক সম্মেলন হয়। সম্মেলন শুরু হয়েছিল ১৮ মার্চ, আর তা শেষ হয়েছিল পরদিন দুপুরে। নানা বিতর্কের পর কর্মসূচিতে ঘোষিত হয়, জমিদারদের সমস্ত জমি দখল নেওয়া হবে, জোতদারদের রাইফেল কেড়ে নেওয়া হবে। অনেক জোতদার কৃষকসভার কাছে রাইফেল জমাও দেন, কিছুজন আবার গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। সিপিআই(এম)-এর মাথারা আলোচনা করে আন্দোলনে বাধা দিতে চাইলেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, কৃষকসভার রাজ্য সম্পাদক ও রাজ্যের ভূমি-রাজস্ব মন্ত্রীরা দার্জিলিং যান। কৃষকদের অস্ত্র নামিয়ে রাখার জন্য বোঝান। বিদ্রোহীরা কর্ণপাত করেননি, ফলত সমঝোতার প্রয়াস ব্যর্থই হয়।

এরপর বাকি শাসকের মতো তৎকালীন সরকারও একই পদক্ষেপ করে। জোতদার এবং কৃষকদের মধ্যে সংঘষ বাধে। দেখা যায়, পুলিশ নিরপেক্ষতার আড়ালে জোতদারদের পক্ষ নিচ্ছে। সংঘর্ষে এক পুলিশ অফিসারের মৃত্যু হয়। বদলা নিতে পরদিন আদিবাসী মহিলাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে অসম ফ্রন্টিয়ার রাইফেলসকে দিয়ে গুলি চালানো হয়। প্রাণ হারান ৮ জন শ্রমজীবী মহিলা, ২ জন শিশু, ১ জন পুরুষ। এরপর শুরু হয় ব্যাপক গ্রেফতারি, ঘেরাও। এতকিছুর পরও আন্দোলন চলছিলই। ১৯৬৯ সালে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস ফের ক্ষমতায় ফেরে। সরকার সেই সময় অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নকশাল আন্দোলন দমন করে।

নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় বলছেন, "আরজি করের আন্দোলন অত্যন্ত ইতিবাচক। নকশালবাড়ি আন্দোলন কৃষকভিত্তিক আন্দোলন ছিল। সারা সমাজকে আকৃষ্ট করেছিল এবং সারা সমাজ এতে যুক্ত হয়েছিল। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদের বৈশিষ্ট্য হলো, আমরা যাদের 'অর্ধেক আকাশ' বলি তাঁদের উদ্যোগে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে এবং সমগ্র সমাজ এই আন্দোলনে সামিল হয়েছে। আর এই আন্দোলনকে আমি সমর্থন করি।" অসীম আরও বলেন, "এই আন্দোলনে সরকার পক্ষ অত্যন্ত রক্ষণাত্মক ভূমিকা নিয়েছে। গা বাঁচানোর চেষ্টা করছে। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এতেই আন্দোলনের শক্তি বোঝা যায়।"

সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছিল ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ। এদিন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামে কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলনের বিক্ষোভকারী কৃষকদের ওপরে গুলি চালিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সরকারের পুলিশ। সরকারি হিসেব দেওয়া হয়েছিল, নারী-পুরুষ মিলে ১৪ জন মারা গিয়েছেন। তিনমাস ধরে কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলন চলছিলই। এই কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েই ক্ষমতা পান রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে সময় সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠী গাড়ির কারখানা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অন্যদিকে, পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে বৃহৎ পেট্রোরসায়ন হাবের পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। নন্দীগ্রামে সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয় পেট্রোরসায়ন হাবের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হবে। তারপরই আন্দোলনে উত্তাল হয় গ্রামবাসী। ক্ষমতাসীন সিপিআইএম দলেরই একটি অংশ সরকারের ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকে। এতে যোগদান করেছিল স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা, জামিয়াত-উলেমা-এ-হিন্দ এবং স্থানীয় কিছু বাম দল। পুলিশ প্রশাসনকে না ঢুকতে দেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু হতেই রাস্তা কেটে দেন বিক্ষোভকারীরা। ১৪ মার্চ সরকারের নির্দেশে সাংবাদিকদের গ্রামে ঢুকতে নানাভাবে বাধা দেওয়া হয়। মাত্র কয়েকজন সাংবাদিকই ঢুকতে পেরেছিলেন। যারা পরের দিন ঢুকতে পেরেছিলেন তাঁরা শুধু দেখতে পেয়েছিলেন বাড়ির দেওয়ালে, জানলায় গুলির দাগ, রক্তের দাগ।

আরও পড়ুন- মমতার ভুল না কি… সিঙ্গুর নিয়ে যা বলছেন সেই মাস্টারমশাই

আরজি করের ঘটনাটি ঘিরে যে প্রতিবাদ হচ্ছে তা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকে কতটা আলাদা? সাংবাদিক সৌরভ গুহ বলেছেন, "সবাই সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের কথা বলে কিন্তু জমি অধিগ্রহণ করার প্রক্রিয়াটা সংগঠিতভাবে শুরু হয়েছিল রাজারহাট থেকে। কিন্তু রাজারহাটের পার্টি সংগঠন এত মজবুত ছিল যে সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস কিছু করতেই পারেনি। মনে রাখতে হবে, সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণের আগে কিন্তু বিপুল সংখ্যক জমি অধিগ্রহণ হয়েছে এবং তাতে কোথাও কোথাও কিন্তু পেশি শক্তির ব্যবহারও হয়েছে। ফলে রাজারহাটের জমির পরিপ্রেক্ষিতে জমি হারাবার ভয় মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। সেটাই গ্রামের মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছিল। সিঙ্গুরে এই ঘটনার গতিবেগ আরও বাড়ে। সেটাই নন্দীগ্রামে গিয়ে কার্যত একটা ম্যাসাকারে পরিণত হয়। সিঙ্গুরের সমস্যা মিটতে না মিটতেই নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণের বিবৃতি প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল।" তাঁর কথায়, "সেখানে ইস্যুটা ছিল জমি নিয়ে। সেখানে জমির প্রশ্নে লড়াই করছিল রাজনৈতিক দল।"

সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের তীব্রতার সঙ্গে আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদের তীব্রতার কি মিল রয়েছে? সাংবাদিক সম্বিত পাল বলছেন, "সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সঙ্গে আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের আন্দোলন একটি নাগরিক আন্দোলন ছিল, তা রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলন এখনও নাগরিক আন্দোলনই রয়েছে এবং বিভিন্ন স্তর থেকে মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। অন্যদিকে, যদি সিঙ্গুর আন্দোলন দেখা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন এবং তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যানারে আন্দোলন করেছিলেন।" সম্বিতের ব্যাখ্যা, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং তার বিরোধিতা করেছেন। সেখানে প্রকাশ হয়েছিল বাম সরকারের সে সময় যে নীতি ছিল তা কী ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এর থেকেই বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মানুষদের মনে হয়েছিল, এবার তাঁদের জমিও কেড়ে নেওয়া হবে।" "নন্দীগ্রামের আন্দোলন খানিকটা নাগরিক আন্দোলন ছিল কিন্তু সেটা প্রথমে নন্দীগ্রামের মধ্যেই সীমিত ছিল। সেখানে কোনও রাজনৈতিক পতাকা ছিল না। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছিলেন জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে। তারপর তৃণমূল কংগ্রেস সেই আন্দোলনকে ধীরে ধীরে তাদের আন্দোলনে পরিণত করে।"

আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদের তীব্রতা নিয়ে সৌরভ গুহ বলছেন, "এই প্রথম আমরা একটা আন্দোলন দেখছি আরজি কর-কে কেন্দ্র করে যা সম্পূর্ণভাবে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বাধীন নয়। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানুষ বেরোচ্ছে এবং সেই অর্থে কোনও রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডার তলায় আসছে না।" তিনি আরও বলেন, "একমাস ধরে নাগরিকদের ব্যাপক বিক্ষোভ প্রতিদিন ঘটে চলেছে, এই ঘটনা বিরল। এমন কিন্তু এর আগে কখনও হয়নি। এর আগের গণ আন্দোলনগুলি কোনও সংগঠন বা কোনও পার্টির নির্মিত মঞ্চ দ্বারাই পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু ১৪ অগাস্টের রাতদখল, তারপর ৪ সেপ্টেম্বর এবং ৯ সেপ্টেম্বর, এই তিনদিনই যা হয়েছে তা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই হয়েছে। পার্কস্ট্রিটে আমরা দেখলাম, একটা দামী রেস্তোরাঁ যার আন্দোলনের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই, সেখানে ৯ মিনিট ধরে কোনও খাবার পরিবেশন করা হলো না, কফি হাউজ নিষ্প্রদীপ করে রেখে মোমবাতি জ্বালানো হলো, রাত্রিবেলা মানুষ এসে উপস্থিত হলো। যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড এমন নিঃস্তব্ধ যে একটা পিন পড়লেও বোধহয় শব্দ পাওয়া যাবে। যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ডকে চেনা যাচ্ছিল না। এই মানুষরাই কিন্তু নতুন গণ-আন্দোলন রচনা করছেন। এই প্রথম এখানে কোনও দল নেই, কোনও ঝাণ্ডা নেই।''

পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক সমীকরণ বোঝাতে গিয়ে সৌরভ বলছেন, "সম্প্রতি যে নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে, সেই নির্বাচনকে কাটাছেঁড়া করে দেখলে তৃণমূল কংগ্রেস ২৯টা আসন পেয়েছে অবশ্যই কিন্তু সেই নির্বাচনী ফলাফলের গভীরে কী লুকিয়ে আছে? তৃণমূল কংগ্রেসের কলকাতা শহরের ৪৮টা পুর ওয়ার্ডে হেরে যাওয়া এবং ৭৪টা পুর এলাকায় হেরে যাওয়া। এটা কী অর্থ তুলে ধরে? কলকাতা শহর এবং মফসসলের শিক্ষিত মানুষের একটা অংশ শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের থেকে মুখ ফিরিয়েছে, নানা কারণেই ফিরিয়েছে। মুখ ফেরানো মানুষরাই আরজি করের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লাভা উদগীরণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। যা অতীতের কোনও গণ-আন্দোলনের সঙ্গে মেলানো যায় না।"

আরও পড়ুন- মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন মমতা

সৌরভ বলছেন, "জাগ্রত জনতা পথে নেমেছে। গানে, কবিতায় আমরা জাগ্রত জনতার কথা বলি। প্রকৃত অর্থে আমাদের প্রজন্মের প্রথম জাগ্রত জনতা দেখলাম। এই জাগ্রত জনতার কাছে তথ্য আছে, পার্সোনাল মিডিয়া আছে। সামাজিক গণ-মাধ্যমে মতামত রাখার জায়গা আছে। সেখানে স্বাধীন মতের বিস্ফোরণ আমরা দেখতে পারছি। এটার একটা নেতিবাচক দিক আছে। কোনও একটি রাজনৈতিক ঘটনার পরিবর্তন ঘটাতে গেলে রাজনৈতিক অভিমুখের প্রয়োজন। এই গণ-আন্দোলনের নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক অভিমুখ আমরা পাচ্ছি না। তার জন্য বিরাট কোনও বাঁক বদল নাও ঘটতে পারে কিন্তু যেভাবে একমাস ধরে সমস্ত পেশার মানুষ, ধনী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বাড়ির পরিচারিকা একসঙ্গে বলছেন 'We Want Justice'- এটা সাংঘাতিক। এবং এই শহর আমাকে আশ্বস্ত করে বাঁচবার জন্য। আমি গর্বিত আমি এই শহরের একজন বাসিন্দা।"

সাংবাদিক সম্বিত পালের কথায়, "আরজি করের ঘটনাকে ঘিরে যে আন্দোলন হচ্ছে তাতে কোনও বিরোধী দল ফায়দা তুলতে পারেনি।" সাংবাদিক সৌরভ গুহও বলেছেন, সিপিএম এবং বিজেপির মিছিলগুলিতে তাঁদেরই লোক, নতুন মানুষ প্রায় নেই। তিনি বলেন, "বিরোধী দলগুলি নাগরিকদের ক্ষোভকে ধারণ করবার মতো অবস্থায় এখনও পর্যন্ত নেই। সিপিএম এবং বিজেপি কেউই লিডিং ভূমিকায় নেই। এই নতুন ট্রেন্ড কিন্তু আমাদের ভাবাচ্ছে, তাহলে কি নতুন রাজনীতির সন্ধান করছেন মানুষ?"

অপশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পথ মানুষ নিজেই খুঁজে নিয়েছে। খাদ্য আন্দোলন, ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলনের পর অনেকগুলি দশক কেটে গিয়েছে। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের এক দশক পেরিয়েছে। এখন ফের আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ রাজ্য। এতগুলি বছর পেরিয়েও খাদ্য আন্দোলন, ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক হয়নি। এই আন্দোলনগুলি স্মরণ করেই আরও এক গণ-আন্দোলন দেখছে রাজ্যবাসী। সাধারণ মানুষ নিজের ইতিহাসের শিকড় এবং সংস্কৃতির মূলকে ভুলতে পারেনি। তবে বিশেষজ্ঞরা পাশাপাশি এও বলছেন, আরজি করের ঘটনাকে ঘিরে যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে তার তীব্রতা বাকি আন্দোলনের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না। শাসকদলের মদতে প্রতিদিন কিছু না কিছু ঘটছে, তা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণকেই যে আরেকটু বেশি করে দায়িত্ব নিতে হবে, সেই সাহস তৈরি করে দিচ্ছে এই আন্দোলন। মানুষ অন্তত বুঝতে পেরেছে, সিস্টেমকে প্রশ্ন না করলে যে কোনওদিন সিস্টেমই তাঁদের প্রিয়জনকে গিলে খাবে।

More Articles