কলকাতার সেরা ক্রিসমাস কেক, কোথায় পাবেন?
Christmas Cakes: বড়দিনের কেক যেন সবের থেকে আলাদা। তার গায়ে লেগে থাকে পুরনো শহরের গন্ধ। প্রাচীন সব বেকারির মায়া। সারা বছর ধরে যে ক্রিম কেক-প্যাস্ট্রি বাজার গরম করে রাখে, বড়দিনের কেক তাদের থেকে ভিন্ন।
বলগা হরিণে টানা স্লেজগাড়ি বরফের চাদর কেটে কেটে টেনে নিয়ে আসছে সেই কবেকার এক বৃদ্ধকে, পরনে যার লাল জোব্বা আর হাতে উপহারে ঠাসা ব্যাগ। সাদা দাড়িতে লেগে থাকছে বরফের কুচো। প্রতিবছর শীতের রাত্তিরে যার গাড়ি এসে থামে কলকাতার দোরগোরায়। বড়দিন জুড়ে সান্টাক্লজ-ছাপ এই সব দৃশ্যকল্প ফুরিয়ে আসে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তখন ক্রিসমাস জুড়ে পড়ে থাকে সুগন্ধি কেকের কার্নিভাল। কলকাতা এমনিতেই মিষ্টির শহর। শুরু হোক শেষ, পাতে মিষ্টিকে একটু বেশিই গুরুত্ব দেয় বাঙালি। ফলে কলকাতায় শীতকাল আর ক্রিসমাস মানেই যে কেকের রমরমা, তা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। এ কলকাতার বুকের ভিতর রয়েছে এক কেকের কলকাতা। প্রাচীন সব বেকারির জন্য বিখ্যাত হয়ে রয়েছে যেসব পাড়া। ময়দা, চিনির নরম যুগলবন্দি আর ভালোবাসা সহযোগে বছরের পর বছর ধরে কেক-ম্যাজিক তৈরি করে আসছেন যারা, যাদের কেকের সুঘ্রাণ ক্রিসমাসকে করে তোলে কলকাতার বড়দিন, আসুন চিনে নেওয়া যাক তাদের। কোথায় মেলে বড়দিনের বড়িয়া কেক, যা একবার খেলে মুখে লেগে থাকে আজীবন।
কলকাতার ভিতরে রয়েছে এক বেকারির কলকাতা। আজকাল অবশ্য কেক বানানোকে অনেকেই নেশা ও বানিয়ে ফেলেছেন। নানা জায়গা থেকে কেক বানানো শিখে অনেকেই বাড়িতে বানিয়ে ফেলছেন দারুণ দারুণ সব কেক। সেসব সোশ্যাল মিডিয়ায় সৌজন্যে পৌঁছে যাচ্ছে সকলের ঘরে ঘরে। সেই সব কেক প্রশংসা পাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বাজার। তবে বড়দিনের কেক যেন এইসবের থেকে আলাদা। তার গায়ে লেগে থাকে পুরনো শহরের গন্ধ। প্রাচীন সব বেকারির মায়া। সারা বছর ধরে যে ক্রিম কেক-প্যাস্ট্রি বাজার গরম করে রাখে, বড়দিনের কেক তাদের থেকে আলাদা। বড়দিন আসলেই নরম সুস্বাদু ফ্রুট কেক বা প্লাম কেকের সন্ধান পড়ে। কারণ এই সব বেকারির সনাতন কেকই তো ক্রিসমাসকে বড়দিন করে তোলে বাঙালির কাছে। যখন পার্কস্ট্রিট জুড়ে ক্রিসমাস কার্নিভাল ছিল না, আলো-হুল্লোড়ে ঢাকা শহর ছিল না, তখন বড়দিনের রাত রঙিন করে তুলত এইসব কেকেরাই। কলকাতার কোথায় মেলে এই সব ক্রিসমাস কেক, কোথায় গেলে স্বাদ পাবেন সেরা বড়দিনের? রইল সুলুক সন্ধান।
আরও পড়ুন: বড়দিনের মিষ্টিমুখ, ৯০ পেরিয়ে আজও নবীন সালদানহা, রইল তিন নারীর অসাধ্যসাধনের গল্প
ফ্লুরিজ
কলকাতা মানে যদি ভিক্টোরিয়া বা ট্রামলাইন কিংবা হলুদ ট্যাক্সি হয়, তাহলে কলকাতা মানে ফ্লুরিজও। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে এই শতাব্দী প্রাচীন বেকারির আবেদন আজও একই জায়গায় রয়ে গিয়েছে। সকালের ইংলিশ ব্রেকফাস্ট হোক বা সুগন্ধী কেক, ফ্লুরিজ আছে ফ্লুরিজেই। দুর্দান্ত প্রাতঃরাশ, ধোঁয়া ওঠা সুগন্ধি দার্জিলিং চা আর দুর্দান্ত সব কেক, ১৯২৭ থেকে বাঙালির বুকে ফ্লুরিজ। ফলে ক্রিসমাস জুড়ে ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় ফ্লুরিজ কর্তৃপক্ষ। এখন অবশ্য বিভিন্ন জায়গায় ফ্লুরিজের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে গিয়েছে। তবে আসলি স্বাদ পেতে যেতে হবে পার্ক স্ট্রিটের মোড়ের প্রাচীন ফ্লুরিজেই।
নাহৌম অ্যান্ড সন্স
ক্রিসমাসের কলকাতা বললেই যে নামটি সবার আগে মাথায় আসে, তা নাহৌমস। কলকাতার কিংবদন্তি বেকারিগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। নাহুম ইজরায়েল মরদেকাই নামে এক ইহুদির হাতে ১৯০২ সালে তৈরি হয়েছিল এই কেকের দোকান। সেই থেকে নিউ মার্কেট জুড়ে আজও কেকের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে আসছে নাহৌম অ্যান্ড সনস। ক্রিম-কেক প্যাস্ট্রির ভিড়ে আজও যে এক ফোঁটাও দর কমেনি ফ্রুট কেক, প্লাম কেকদের, তা বলে দেয় প্রতিবছর শীত পড়তে না পড়তে ক্রেতাদের লম্বা লাইন।
কুকি জার
কলকাতার লাউডন স্ট্রিটের কুকি জার বেকারিটিও কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের জায়গা ধরে রেখেছে। ১৯৮৫ সালে কলকাতার বুকে গড়ে উঠেছিল বেকারিটি। নিজেদের খাবারদাবারের মানের সঙ্গে কোনওদিনও সমঝোতা করেনি বেকারিটি। ফলে দামও হয়তো অন্যান্য দোকানের চাইতে একটু চড়া। কিন্তু একবার মুখে দিলে সে স্বাদ যে মুখে লেগে থাকবেই, তার গ্যারান্টি দিচ্ছে দোকানটি। ক্রিসমাস উপলক্ষে প্রতিবছর নানা ধরনের কেকের সম্ভারে নিজেদের সাজিয়ে তোলে কুকি জার।
জে ডব্লিউ বেকারি
মিষ্টিপ্রিয় আমবাঙালির কিন্তু একবার ঘুরে আসতেই হবে জে ডব্লিউ বেকারি থেকে। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন জে ডব্লিউ ম্যারিয়ট নামক পাঁচ তারা রেস্তোরাঁ চেনটির বেকারি শাখা এটি। দক্ষ শেফ দিয়ে পরিচালিত এই বেকারি সবসময়ই নতুন নতুন মিষ্টি, ডেজার্ট আইটেম তৈরিতে সদা সচেষ্ট। ক্রিসমাসের আগে এটিও কিন্তু হতে পারে আপনার এক বিকেলের আস্তানা।
সালদানহা বেকারি
কলকাতার প্রাচীন ও গোপন বেকারিগুলির মধ্যে অন্যতম এটি। সালদানহা বেকারির নাম তেমন করে অনেকেই শোনেননি। প্রায় একশো বছরের পুরোনো এই বেকারিটির ঠিকানা রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডে। দুর্দান্ত সব প্রাচীন কেক পেস্ট্রি, ব্রাউনির সাম্রাজ্যে ঢু মারতে চাইলে সালদানহা বেকারি কিন্তু আপনার অবশ্য গন্তব্য। তার সঙ্গে মেলে দুর্দান্ত স্যান্ডউইচও। ক্রেতাদের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের প্রতিদিন আরও ভালো করে তোলার চেষ্টা করছে বেকারি কর্তৃপক্ষ। কাস্টমাইজড কেকের পাশাপাশি বড়দিন উপলক্ষে তাদের কাছে রয়েছে অন্যান্য কেকের সম্ভারও।
কোকোয়া বেকারি
বালিগঞ্জের কোকোয়া বেকারির আবেদনও কিন্তু বাড়ছে দিনে দিনে। বহু রকম মিষ্টি খাবারের জন্য সেরা ঠিকানা এটি। নানা রকম প্যাস্ট্রি, ক্রোসোঁ এবং বিভিন্ন ধরনের ব্রেড, তার সঙ্গে দুর্দান্ত পরিবেশ। ফলে এই বড়দিনে ঘুরে আসতেই পারেন কোকোয়া বেকারি থেকে।
এইটথ ডে ক্যাফে অ্যান্ড বেকারি
গড়িয়াহাট হিন্দুস্থান পার্কের কাছের এই বেকারিটি ক্রমে জায়গা করে নিয়েছে জেন মিলেনিয়ালসদের মধ্যে। কলকাতার সেরা বেকারিগুলোর মধ্যে কিন্তু নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে এই এইটথ ডে ক্যাফে অ্যান্ড বেকারি। দুর্দান্ত মেনু, দারুণ আবহ এবং স্পেশাল ডিশ, এই ক্রিসমাসে আপনার মন মজাবেই।
মিসেস ম্যাগপাই
আপনার জিভ যদি মিষ্টিভক্ত হয়, তাহলে আপনাকে মোহিত করবেই সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের এই আধুনিক বেকারি অ্যান্ড ক্যাফেটি। সমস্ত অনুষ্ঠান পার্বণের জন্য় সদাপ্রস্তুত মিসেস ম্যাগপাই। ফলে আপনার স্বাদকোরককে উজ্জীবিত করতে এই শীতে আপনার ঠিকানা হতেই পারে দুর্দান্ত এই বেকারি ক্যাফেটি।
দ্যা ফ্রেঞ্চ লোফ
ক্রমে কলকাতায় জনপ্রিয়তা ফরাসি এই কেক চেনটি। কলকাতার অন্যতম এই বেকারিটি কিন্তু রয়েছে অনেক জায়গাতেই। ব্রেডস, ক্রোসোঁ, প্যাস্ট্রিস ও চিজকেক ছাড়াও মিলবে ডিজার্টের বিরাট সম্ভার। আর এই শীতে বড়দিনের কেকের সেরা ঠিকানা হয়ে উঠতেই পারে দ্য ফ্রেঞ্চ লোফ-র কোনও একটি শাখা।
আরও পড়ুন: বঙ্গভঙ্গ থেকে নকশাল আন্দোলন, ১২০ পেরিয়েও কলকাতার সেরা কেক ঠিকানা নাহুমস
কলকাতা মানেই স্বাদের শহর। অনুষ্ঠান যাই হোক না কেন, সব কিছুরই আলাদা আলাদা স্বাদ, আলাদা আলাদা ঘ্রাণ রয়েছে এই শহরে। কলকাতা ভালোবেসে সব স্বাদকে গ্রহণ করেছে। মিষ্টি হোক বা ঝাল, অনুষ্ঠান অনুযায়ী কলকাতাবাসীর কাছে পাল্টে পাল্টে গিয়েছে স্বাদের আবেদন। আর সেই স্বাদের ক্যালেন্ডার মেনেই ক্রিসমানেই আজও কলকাতা চেনে কেক। আর কেক মানেই একগুচ্ছ সেরা বেকারি। যা রয়েছে এই কলকাতার বুকেই। যা শুধু হেঁটে দেখার ও চেখে দেখার পালা। আর সেই স্বাদের জোড়েই আজও শহরের বুকে নেমে আসে বুড়ো সান্টার স্লেজ। লাল নীল রাঙতায় মোড়া উপহার বাক্সে ভরে সেই স্বাদ পৌঁছে যায় এ শহরের অলিতে গলিতে ছড়ানো দারুণ সব কেক আর প্যাস্ট্রির দোকানে। যার হদিস রাখে এই ক্রিসমাসের শহর আর তার মানুষ।