দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ১০০ দিন: জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন ট্রাম্প?
Donald Trump Government: প্রথম ১০০ দিনে তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো যেন ঘোষণা করে — আমেরিকা এখন একা চলবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতিত্বের প্রথম ১০০ দিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চেতনার ওপর এক গভীর ভূমিকম্পের মতো আঘাত হেনেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারির শীতের সকালে শপথ গ্রহণের পর থেকেই তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এই মেয়াদে তাঁর উদ্দেশ্য কেবল রাষ্ট্র পরিচালনা করা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় মৌলিক কাঠামোকে একনায়কতন্ত্রের ছাঁচে পুনর্গঠন করা। তাঁর অভিযাত্রা শুরু হয়েছে হোয়াইট হাউসের অন্দরসজ্জা পরিবর্তন দিয়ে; যেখানে ইতিহাসের মহান ব্যক্তিত্বদের জায়গায় তাঁর নিজের রক্তাক্ত মুখাবয়বের বিশাল প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে, যা তাঁর 'অপরাজেয়তা'-র দাবি বহন করে। বাইরের দুনিয়ায়, তিনি এমন এক দৃশ্যপট তৈরি করেছেন, যেখানে সংবিধানিক সীমাবদ্ধতা এবং ন্যায়বিচার শব্দ দু'টি প্রায় নিষিদ্ধ। তাঁর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের নির্মম পদধ্বনি বাইরের দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে।
ট্রাম্পের এই রূপান্তরের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অঙ্গচ্ছেদ দিয়ে। মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে তিনি লক্ষাধিক সরকারি কর্মচারীকে অপসারণ করেছেন, স্বতন্ত্র কমিশন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ভেঙে দিয়েছেন এবং তাদের জায়গায় সম্পূর্ণরূপে তাঁর প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগ করেছেন। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে নিরপেক্ষতার স্থান দখল করেছে রাজনৈতিক আনুগত্য। বিচার বিভাগের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তিনি বিরোধীদের বিরুদ্ধে তদন্তের ঝড় তুলেছেন, যেখানে অপরাধের কোনও প্রমাণ থাকুক বা না থাকুক, শাস্তি নিশ্চিত। আইনের শাসন পরিণত হয়েছে ইচ্ছার শাসনে। নিম্ন আদালত বা সুপ্রিম কোর্টের রায়, সংবিধানের বিধি, এমনকী রাজনৈতিক শিষ্টাচার—সব কিছুই এখন ট্রাম্পের খেয়ালের কাছে তুচ্ছ। যখন একটি আদালত তাঁকে অবৈধ কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়, তিনি তা ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। বিচারপতি জে. হার্ভি উইলকিনসন, রেগান আমলের বিখ্যাত রক্ষণশীল বিচারক, "এই প্রশাসনের আচরণ আইনের শাসনকে বিশৃঙ্খলায় পরিণত করার" চরম হুমকি বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ হোয়াইট হাউসে, ট্রাম্পের অনুগতরা বিজয়ের উল্লাসে মত্ত। হোয়াইট হাউসের চিফ অফ স্টাফ সুজি ওয়াইলস নির্লজ্জভাবে ঘোষণা করেছেন, "তিনি কোনও কিছুতেই ছাড় দেননি, সবকিছু নিজের ইচ্ছামতো করছেন।"
আরও পড়ুন-অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে বাণিজ্য যুদ্ধের ডাক ট্রাম্পের? কতটা বিপদের মুখে ভারত?
অভিবাসন ইস্যুতে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। প্রচুর সংখ্যক অভিবাসীকে কোনও বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়াই গ্রেফতার করে বিভিন্ন দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জন্ম নেওয়া শিশুদেরও তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এমনকী অভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবা (আইআরএস) এবং ডাক বিভাগকেও এই অভিযানে যুক্ত করা হয়েছে, যেন সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র একটি ভয়ের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তাঁর প্রশাসন পর্যন্ত স্বীকার করেছে, আঠারো শতকের যুদ্ধকালীন আইনি ধারার অপব্যবহার করে নির্বাসন চালানো হয়েছে। বিচারবিহীন নির্বাসন, অবৈধ অভিযান, আঠারো শতকের জরুরি আইন ব্যবহার করে গণহারে মানুষ বহিষ্কার— সবই এখন নতুন স্বাভাবিকতা। শিক্ষার্থী, শ্রমিক, এমনকী স্থায়ী বাসিন্দারাও আতঙ্কের ছায়ায় জীবনযাপন করছে। এক রাষ্ট্রযন্ত্র, যা একসময় বৈধতার রক্ষক ছিল, এখন ভীতির রক্ষী কুকুরে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতির ময়দানেও ট্রাম্পের ঝড় থামেনি। দেশিয় শিল্পকে রক্ষা করার অজুহাতে তিনি এমনভাবে শুল্ক আরোপ করেছেন যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ভেঙে পড়েছে। বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার পথে হাঁটছে। ভোক্তা আস্থা কমে গেছে, বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি আবারও ভয়ঙ্কর উচ্চতায় পৌঁছেছে, আর নতুন মন্দার ছায়া প্রতিটি পরিবারে ভীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিল্প খাতে বিপুল পরিবর্তন ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, যার মূল কারণ বাণিজ্যিক যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ নীতি। প্রযুক্তি শিল্পে ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ বিশেষত চিনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলেছে। অ্যাপল, গুগল, অ্যামাজনের মতো কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন চিন থেকে অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমে গেছে এবং ২০২৫ সালের শুরুতে চাকরি হারানোর হার ৭% এ পৌঁছেছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৩% বেশি। কৃষি শিল্পের জন্য ট্রাম্পের নীতির প্রভাব অত্যন্ত গভীর। চিন এবং ইওরোপের সঙ্গে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে কৃষকদের ওপর সবচেয়ে বড় চাপ এসেছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি রফতানি ১৭% কমে ১৭০.৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। চিন, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করায় কৃষি রফতানি প্রায় ২৫% কমে গেছে। মধ্যপশ্চিমাঞ্চলীয় কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ইলিনয়, আইওয়া, ওহাইও রাজ্যে কৃষকদের লোকসান প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে।
গাড়ি শিল্পে মেক্সিকো এবং কানাডাতে উৎপাদন স্থানান্তরের ফলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি শিল্পে ৩০% আমদানি শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করায় ফোর্ড ও জেনারেল মোটরসের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তন করেছে। গাড়ি নির্মাতারা শুল্কের প্রভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খরচ ১০-১৫% বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন, যার ফলে গাড়ির দাম বেড়েছে। এর ফলস্বরূপ, ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ যুক্তরাষ্ট্রে অটোমোবাইল বিক্রয়ে ২% হ্রাস পেয়েছে, যা গত ছয় মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো বার্ষিক পতন। অথচ ট্রাম্পের দাবি, "আমি পৃথিবীর যত সমস্যার সমাধান করেছি, কেউই তা স্বীকার করতে চায় না।" 'ফরেন অ্যাফেয়ার্স' (এপ্রিল ২০২৫) বিশ্লেষণে লিখেছে, "ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ হচ্ছে বিশ শতকের স্মুট-হাওলি ট্যারিফ অ্যাক্টের আধুনিক রূপ—যেখানে নিজেকে রক্ষার প্রচেষ্টায় গোটা বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার ক্ষতি হচ্ছে।"
বিশ্বমঞ্চেও ট্রাম্প আমেরিকাকে একাকী করে ফেলেছেন। দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আত্মমুখিতা, স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতা এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বের সংকোচনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছেন। প্রথম ১০০ দিনে তাঁর নীতি, ভাষা ও সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করে দেয়— ট্রাম্পের আমেরিকা আর 'বিশ্বের বাতিঘর' নয়, বরং নিজের চারপাশে এক কঠিন প্রাচীর তুলে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা এক অভিমানী সাম্রাজ্য।
হোয়াইট হাউসে প্রবেশের পরই ইউক্রেন সংকটে আমেরিকার ভূমিকা সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেন ট্রাম্প। ইওরোপের মিত্ররা যখন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় মার্কিন নেতৃত্ব প্রত্যাশা করছিল, ট্রাম্প তখন খোলাখুলি বলেন, যারা নিজেদের প্রতিরক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যয় করতে প্রস্তুত নয়, তাদের জন্য আমেরিকার রক্ত ঝরবে না। ইওরোপ যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছে। বিদায়ী জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস মন্তব্য করেন, "আমরা আর আগের মতো আমেরিকান নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করতে পারি না।" ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ মন্তব্য করেন, "আজকের বিশ্বে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য ইওরোপিয়দের ওপর নির্ভর করতে হবে।" (সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, ফেব্রুয়ারি ২০২৫)। বিশ্লেষক টমাস ফ্রিডম্যান নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছেন, "ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রথম ১০০ দিনেই যা করেছেন, তা হলো— আমেরিকাকে তার মূল্যবান মিত্রদের চোখে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন।"
এরপর ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ২০৩০ সালের জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা যখন বিশ্বের অস্তিত্বের লড়াই হয়ে উঠেছে, তখন ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি যেন প্রমিথিউসের আগুন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া এক অদ্ভুত আত্মকেন্দ্রিকতার প্রতিচ্ছবি। ইওরোপিয় নেতারা এই সিদ্ধান্তকে শুধু পরিবেশের প্রতি নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিও বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করেন। 'দ্য ইকোনমিস্ট' (মার্চ ২০২৫) লিখেছে, "বিশ্ব যখন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার সন্ধান করছে, তখন আমেরিকা নিজের স্বার্থকে একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে বেছে নিয়েছে।"
মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের অবস্থান আরও বেশি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ওঠে। ইজরায়েল সরকারের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন এবং ফিলিস্তিনকে দেওয়া মানবিক সহায়তার বাজেট হ্রাস করে তিনি আরব বিশ্বে ক্রমবর্ধমান হতাশা সৃষ্টি করেন। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও এখন আরও কৌশলগত দূরত্ব বজায় রাখছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ফান্ডিং হ্রাস করার সিদ্ধান্ত ট্রাম্প প্রশাসনের মানবিক সহযোগিতার ধারণাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মন্তব্য করেন, "এটি শুধু অর্থের প্রশ্ন নয়; এটি মূল্যবোধের প্রশ্ন— আমরা কি বিশ্ব মানবতার প্রতি আমাদের দায়িত্ব অস্বীকার করব?" (সূত্র: জাতিসংঘ প্রেস বিজ্ঞপ্তি, এপ্রিল ২০২৫)।
এই সব সিদ্ধান্তের সমষ্টি একটি বৃহত্তর চিত্র প্রকাশ করে— বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত সঙ্কুচিত উপস্থিতি। নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, "ট্রাম্প আমেরিকাকে একটি দুর্গে পরিণত করেছেন— শক্তিশালী হলেও বিচ্ছিন্ন।" এই বিচ্ছিন্নতার ফলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোতে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, শরণার্থী সমস্যা এবং বাণিজ্য কাঠামোয়, আমেরিকার প্রভাব দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। 'ফরেন পলিসি' ম্যাগাজিনে মন্তব্য করা হয়েছে, "যখন আমেরিকা পিছিয়ে যায়, শূন্যস্থান দ্রুতই প্রতিযোগীরা পূরণ করে। ইতিহাস এই সত্য বারবার প্রমাণ করেছে।"
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের নীতিগুলির তাৎক্ষণিক লক্ষ্য হয়তো ছিল আমেরিকান ভোটারদের সন্তুষ্ট করা কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন। দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ১০০ দিনে এই বাস্তবতাই স্পষ্ট হয়েছে — বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র আর আগের সেই অবিসংবাদিত নেতা নয়। বরং মিত্রদের অনিশ্চয়তা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের উত্থান এবং বিশ্বনেতৃত্বের শূন্যতা এই সময়ের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের স্টিয়ারিং হুইলে বসে শুধু গতি পরিবর্তন করেননি, তিনি দিকও পাল্টেছেন। প্রথম ১০০ দিনে তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো যেন ঘোষণা করে — আমেরিকা এখন একা চলবে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় শাসনামলের শুরু তাই এক চুপচাপ বাজতে থাকা অ্যালার্ম বেলের মতো — অদূর ভবিষ্যতের আরও বড় অস্থিরতার পূর্বাভাস। প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন একতরফা প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তখন চিন পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য বদলে দিতে শুরু করে। অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করে বলেন, "এটি শুধু বাণিজ্য যুদ্ধ নয়, এটি একবিংশ শতাব্দীর নেতৃত্বের জন্য এক উত্তপ্ত সংঘর্ষ।" প্রথম ১০০ দিনের শেষে ট্রাম্পের আমেরিকার এই দৃশ্যপট যেন ১৯১৯ সালের সেই প্রাচীন মুহূর্তের ছায়া ফেলে, যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লিগ অব নেশনস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, আর ফলাফল হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনিবার্য বিস্ফোরণ।
আরও পড়ুন-ট্রাম্প থেকে মমতা: ইচ্ছাকৃভাবেই নেতারা উদ্ভট কথা বলেন, নাটুকেপনা করেন?
সবচেয়ে ভয়ানক পরিবর্তন ঘটেছে মনস্তত্ত্বের স্তরে। আমেরিকার নাগরিকরা আজ আর সরকারকে নিজেদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখে না; বরং ভয় করে। ট্রাম্পের "শক এবং আতঙ্ক" কৌশল সফল হয়েছে। ক্ষমতার এমন মনুষ্যত্বহীন কেন্দ্রীকরণ, যা প্রথম ১০০ দিনে এতদূর পৌঁছেছে, তা যদি অব্যাহত থাকে, তবে আমেরিকা আর কোনওদিনই পুরোপুরি আগের মতো ফিরতে পারবে না।
তবু, সব আশা শেষ হয়ে যায়নি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মতো কিছু প্রগতিশীল বিশ্ববিদ্যালয়, কিছু সক্রিয় সম্প্রদায়, কিছু সাহসি ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখনও প্রতিবাদের পতাকা উঁচিয়ে ধরেছে। নির্যাতিত অভিবাসী সম্প্রদায়, চিন্তাশীল ছাত্ররা এবং নির্ভীক সাংবাদিকরা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সমীক্ষা বলছে—জনগণের একটি বড় অংশ এখন গভীর আতঙ্ক এবং হতাশা বোধ করছে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ১০০ দিনে তার জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা দেশিয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়েছে। পিউ রিসার্চ সেন্টার ওয়াশিংটন, ডিসি- তে অবস্থিত একটি অলাভজনক মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। এটি সামাজিক সমস্যা, জনমত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের জনসংখ্যার প্রবণতা সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে পিউ রিসার্চের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ট্রাম্পের সামগ্রিক অনুমোদনের হার ৪০%, যা ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় ৭ শতাংশ কম। বিশেষ করে তার শুল্ক বৃদ্ধির নীতি (৫৯% বিরোধিতা) এবং ফেডারেল সংস্থাগুলোর বাজেট কাটছাঁট (৫৫% বিরোধিতা) ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। যদিও রিপাবলিকান সমর্থকদের মধ্যে এখনও তার উচ্চ অনুমোদন রয়েছে (৭৫%), তবে স্বাধীন ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২৪ সালের একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় ৩৪টি দেশে ট্রাম্পের প্রতি আস্থা মাত্র ২৮%। অন্যদিকে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি আস্থা ছিল ৪৩%। এই তথ্যগুলি ইঙ্গিত করে যে, বিশ্বব্যাপী ট্রাম্পের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা কমে গেছে।
তবে বাস্তবতা হলো, আজকের যুক্তরাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে এক সংকটের মোড়ে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় ইনিংস আমাদের এটাই শিখিয়েছে, গণতন্ত্র কাগজের নথিতে নয়, মানুষ ও তাদের বিবেকের গভীরে রোপিত হয়। যখন ভয় মননকে জয় করে, তখন সংবিধানও নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। এখন প্রশ্ন একটাই— আমেরিকা কি আবার উঠে দাঁড়াতে পারবে, না কি নিজ হাতে নিজের পতনের বীজ বপন করবে? সময়ই তার উত্তর দেবে।
মতামত লেখকের নিজস্ব। মতামতের দায় ইনস্ক্রিপ্টের নয়