না থাকলে বাংলাহীন হতো ডিজিটাল বিশ্ব! যেভাবে শুরু অভ্র-র যাত্রা

Mehdi Hasan Khan Avro: ওমিক্রনল্যাব থেকে অভ্র প্রকাশ হয় ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে অভ্র ব্যবহার করে।

মাতৃভাষায় নিজের ভাবপ্রকাশ আর রোমান হরফে তা লিখে স্বতস্ফূর্ত ভাবপ্রকাশ দুইয়ের মধ্যে ফারাক বোঝাতে বোধকরি জমিন-আসমান শব্দগুলিও মানানসই নয়। অথচ ডিজিটাল বিশ্বের গোড়ার দিকে এই প্রায় অসম্ভব কাজটিই করতে হয়েছে অজস্র নাগরিককে, অজস্র ভাষাভাষীর মানুষদের যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়। মোবাইলের কিপ্যাডে ইংরেজি বর্ণ সাজিয়েই লিখতে হয়েছে বাংলা বাক্য। যা করতে গিয়ে 'মুরাদ টাকলা'-র মতো বিচিত্র 'ভাষা'-র জন্মও হয়েছে। তারপর ডিজিটাল বিশ্বে মাতৃভাষায় লেখার দুয়ার খুলে গেল। বাংলায় এই দরজা খুলে দিল প্রথম, অভ্র কিবোর্ড। অন্তর্জালে বাংলা ভাষায় লেখালিখির স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটল। মাঝেমাঝেই কিছু ফেসবুক পোস্টে অভ্রর নেপথ্যে থাকা মানুষটির কথা উঠে আসে। মেহদী হাসান খান। এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন তিনিই। ইউনিকোডে বাংলা হরফ সম্ভবই হতো না তিনি না থাকলে। এবার বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন মেহদী হাসান খান। তবে তিনি একা ওই পুরস্কার গ্রহণ করতেই চাননি।

সাম্প্রতিক এক ফেসবুক পোস্টে মেহদী হাসান খান তাঁর অভ্রর সফরের কথ জানিয়েছেন। ২০০৩ সালে অভ্রর কাজ শুরু করেন তিনি। তখন অভ্র বা মেহেদি হাসান কেউই পরিচিত নন। মেহদী হাসান খান সেই সময় একটা ফোরাম তৈরি করেন টেকনিক্যাল কিছু সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে। ইউনিকোডের ব্যবহার তখন বেশ নতুন। ফলে কাজ করতে গিয়ে ক্ষণে ক্ষণে হাজার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ধীরে ধীরে মানুষ এই অনলাইন ফোরামে বিভিন্ন সমস্যার কথা নিয়ে আসতে থাকেন। সেই সবের সমাধান বের করার চেষ্টা করতেন মেহদী। ধীরে ধীরে তিনি দেখেন কিছু মানুষও যুক্ত হচ্ছেন যারা কেবল সমস্যা নিয়ে আসছেন না। বাকিদের সমস্যা সমাধানে মেহদীকে সাহায্যও করছেন। তখন এরা কিন্তু কেউই কাউকেই সামনাসামনি চেনেন না। অনলাইন যোগাযোগের পর একসময় অনলাইন ফোরামের বাইরে এদের সকলের সঙ্গে দেখা করেন মেহদী। তখন সবাই ছাত্র। মেহদী দেখেন, অভ্র তৈরির কাজে এই মানুষগুলির স্বতস্ফূর্ত বিশ্বাস আছে, কাজটায় ভরসাও আছে।

আরও পড়ুন- একাত্তর আঁকড়েই এগোবে চব্বিশ: নাহিদ ইসলাম

তখন সেই অনলাইন ফোরাম থেকেই শুরু হয়ে বাংলা ফন্ট তৈরি, সফটওয়্যার তৈরি। শুরুর দিকে অনেকে থাকলেও শেষ পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকজনই এই কাজটায় লেগে থাকেন। বছর দশকের উপর কাজ চলতে থাকে অভ্র নিয়ে। নতুন বাংলাদেশে মেহদী হাসানকে 'একুশে পদক' পুরস্কার প্রদানের কথা ঘোষণা করা হয়। ওই ফেসবুক পোস্টে মেহদী লিখেছেন, "অ্যাডভাইজার ফারুকী ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হলো। ওনাকে ব্যাপারটা বোঝাতে খুব বেশি চেষ্টা করতে হয় নাই, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। ২০০৩ সাল থেকে অনেকে অভ্র কাজে সাহায্য করেছেন, এদের সবার অবদান আছে। কিন্তু শুরু থেকে একদম শেষ পর্যন্ত আমরা যারা একসাথে কাজ করেছি- রিফাত, সিয়াম, শাবাব, এদের ছাড়া আমি অভ্রর নামে একুশে পদক গ্রহণ করতে পারবো না। উনি মেনে নিয়েছেন, বাকিদেরও রাজি করিয়েছেন।"

মেহদী বারবার স্বীকার করেছেন, অভ্র তাঁর একক মস্তিষ্কপ্রসূত হলেও, এই কাজে তিনি নিরন্তর সাহায্য পেয়ে গেছেন কয়েকজনের। মেহেদি বলছেন, "পরের প্রজন্মের জন্য অভ্রর মিশনটা যদি রেখে যেতে হয়, সঙ্গে আমাদের টিমওয়ার্কটাও উদাহরণ হিসেবে থাকুক। একা একা তো বেশিদূর যাওয়া যায় না। " অভ্রর তৈরির সঙ্গে যুক্ত এই চার বন্ধুই, রিফাত নবী, তানবিন ইসলাম সিয়াম ও শাবাব মুস্তাফা পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশে আসছেন পুরস্কার গ্রহণ করতে।

মেহদী হাসান খানের জন্ম ১৯৮৬ সালে। মেহদী আসলে একজন চিকিৎসক। পাশাপাশি তিনি কম্পিউটার প্রোগ্রামারও। ২০০১ সালে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং ২০০৩ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তারপর তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম ২০০৩ সালের ১৪ জুন অভ্রকে স্বীকৃতি দেয়। এর মাঝে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ওমিক্রনল্যাব প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। অভ্র কিবোর্ড প্রথম প্রকাশ হয় ২০০৩ সালে ২৬ মার্চ। ওমিক্রনল্যাব থেকে অভ্র প্রকাশ হয় ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে অভ্র ব্যবহার করে।

More Articles