এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি! ভোটের মুখে যেভাবে মহারাষ্ট্র রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে ধারাভি
Dharavi Slums in Maharashtra Politics: সামনেই মহারাষ্ট্রে বিধানসভা ভোট। এর মধ্যে ধারাভি সংস্কার নিয়ে নতুন করে রাজনীতি শুরু হয়েছে মহারাষ্ট্রে।
বাণিজ্যনগরী মুম্বই, আরব সাগরের তীরবর্তী যে শহরে পা রাখলেই গতির ছোঁয়া দিব্যি টের পাওয়া যায়। সেই শহর যেমন রূপকথার মায়ালোক গড়ে দেয় চোখের সামনে, সেভাবেই চোখের সামনে তুলে ধরে এক অন্য ভারতের ছবি। যে ভারত অস্বাস্থ্যকর, পুতিগন্ধময়, দারিদ্রের কুয়াশায় ঘেরা। কারণ এই শহরেই রয়েছে ভারতের বৃহত্তম বস্তি, যার নাম ধারাভি। শুধু ভারতেরই নয়, বিশ্বের বৃহত্তম বস্তি এই ধারাভি। ২০০৮ সালে এই বস্তির এক কিশোর-কিশোরীর হেরে যাওয়া-জিতে নেওয়ার গল্পের সাক্ষী হয়েছিল গোটা দুনিয়া, যে 'স্লামডগ মিলিনিয়র'-এর দৌলতে ভারতের কাছে এসেছিল অস্কারের ঘ্রাণ, সেই বস্তিই আজ নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে মহারাষ্ট্র রাজনীতির। আগামী ২০ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোট। তার আগে এই ধারাভি বস্তিকে ঘিরে জোর চর্চা শুরু হয়েছে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ব্যবসায়ী আদানির ঘনিষ্ঠতার কথা কারওরই অজানা নয়। যে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরবর্তী সময়ে উঠে এসেছে একাধিক অভিযোগ। ২০২২ সালে এশিয়ার বৃহত্তম সেই বস্তি ধারাভির উন্নয়নের ভার দেওয়া হয়েছিল আদানি গোষ্ঠীকে। প্রায় ৫ হাজার ৬৯ কোটি টাকার বরাত পায় এই শিল্পগোষ্ঠী।
আরও পড়ুন: টুকরে টুকরে গ্যাং’-এ ভেঙে মহারাষ্ট্রের রাজনীতি! ভোটে তার কতটা ফায়দা তুলতে পারবে বিজেপি
ভারত তখন শাসন ও শোষণ করছে ব্রিটিশরা। ১৯৮৪ সাল নাগাদ মহারাষ্ট্রের ২.৩৯ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছিল এই ধারাভি বস্তি। ব্রিটিশ সরকারের হাত ধরে মূল শহর থেকে বিতাড়িত হওয়া মানুষজনেদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল সে সময় এই বস্তি। তার পর সেখানে মানুষের ভিড় শুধু বেড়েইছে। এই ধারাভির আবার রয়েছে নিজস্ব একটি অর্থনীতি প্রবাহ। যা নিয়ন্ত্রণ করত চামড়া, বস্ত্র ও মাটির কাজের মতো শিল্পগুলি। জানা যায়, ১৮ শতকে এই ধারাভি ছিল আদতে একটি দ্বীপ, যা ম্যানগ্রোভ জলাভূমি দ্বারা পরিপূ্র্ণ ছিল। উনিশ শতকের শেষের দিকে সেটা হয়ে ওঠে ছোটখাটো একটি গ্রাম, যেখানে বসবাস ছিল কলি-জেলে সম্প্রদায়ের। সেই গ্রামকে তখন বলা হত কলিওয়াড়া গ্রাম। ১৮৫০-র দশকে যখন ব্রিটিশ শাসনে এসে ঝড়ের গতিতে নগরবৃদ্ধির ফলে শহরের জনসংখ্যা অর্ধ মিলিয়নে পৌঁছে যায়। সে সময় দূষিত শিল্পগুলোর অন্যতম ছিল ট্যানারি, ১৮৮৭ সালে একাধিক ট্যানারিকে স্থানান্তরিত করা হয় ধারাভিতে। ফলে আরও ভিড় বাড়তে লাগত মহারাষ্ট্রের বস্তিতে।
সেই ধারাভিতে আজ ২০ মিলিয়নের বেশি মানুষ থাকেন। বিভিন্ন গ্রাম থেকে নানা রঙের স্বপ্ন নিয়ে বাণিজ্যনগরীতে এসে আটকা পড়ে যান এই বস্তির গোলকধাঁধায়। ধারাভির মধ্যে গড়ে উঠেছে যেন সমান্তরাল এক অর্থনীতি। কতশত ব্যবসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, বেড়ে উঠেছে এই বস্তিকে কেন্দ্র করে, তা বলে শেষ করা কঠিন। কেক, বিস্কুটের বেকারি থেকে টেক্সটাইল এমব্রয়ডারিং, মাটির জিনিসপত্র তৈরি, চামড়া ট্যানিংয়ের কারখানা। শুধু কি তাই, ধারাভি সারা বিশ্বের বর্জ্য পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য রয়েছে। প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ, গাড়ির ব্যাটারি, তার, তেলের ড্রামের মতো অজস্র ফেলে দেওয়া জিনিস পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার প্রক্রিয়া চলে এই বস্তিতে। গোটা শহর থেকে বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবসা চলে এই ধারাভিতে। বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন সামাজিক এলাকা থেকে আসা মানুষ বিভিন্ন সময়ে জড়ো হয়েছেন এই বস্তিতে। তাঁদের পরিচয় একটাই, কোনও মতে বস্তিতে মাথা গুঁজে খেটে বেঁচে থাকতে চাওয়া মানুষ। বহু সময়েই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শরীরে হানা দেয় ভয়ঙ্কর সমস্ত ব্যধি। সেসব নিয়েই বেঁচে থাকেন বস্তির মানুষ। পুতিগন্ধময়, বিপজ্জনক, তবু এই বস্তি সেখানকার বাসিন্দাদের নিজেদের ঘামরক্তে গড়ে নেওয়া।
১৯৯৭ সাল থেকে ধারাভিকেও হংকংয়ের সাবেক বস্তি তাই হ্যাংয়র মতো পুনর্বিকাশ করার চেষ্টা চলছে। সাম্প্রতিক কালে ফের ধারাভি বস্তি সংস্কারের কাজে উঠেপড়ে লাগে প্রশাসন। ২০২২ সালে আদানি গোষ্ঠীর হাতে ধারাভির উন্নয়নের ভার দেওয়া হয়। ধারাভি পুনরুন্নয়ন প্রকল্পে ৬ লক্ষেরও বেশি বস্তিতে বসবাসকারীর জন্য নতুন ফ্ল্যাট তৈরি, ছোট কারখানা তৈরি করে তাঁদের পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করার কথা বলা হয়েছে। ঠিক হয়েছে, ওই এলাকায় মহারাষ্ট্র সরকার ও আদানি গোষ্ঠী আবাসন ও বাণিজ্যিক প্রকল্প গড়ে তুলবে। এদিকে ধারাভি বস্তির মানুষজন, তাঁরা এই বস্তির নিজস্বতাকেই গৌরব হিসেবে ধরে নিয়েছেন এতদিন ধরে। বিদেশ থেকে বহু মানুষ ভারতে এসে এই বস্তি চাক্ষুষ করতে আসেন। বিদেশ থেকে মানুষ আসা মানেই স্থানীয়দের পকেট ভরে ওঠা। ফলে বাসিন্দাদের অনেকেই মনে করেন, বাসিন্দাদের একাংশের ধারণা এর ফলে ধারাভির নিজস্বতা ধ্বংস হয়ে যাবে। ভারতে বেড়াতে আসা বিদেশিরা আর তাঁদের বস্তিতে আসবেন না। সবচেয়ে বড় কথা, আর্থিক ক্ষতি হবে তাঁদের, রুজিরুটি হারাবেন তাঁরা। আসলে ধারাভির একটি নিযস্ব অর্থনীতি রয়েছে। স্থানীয়রা বিভিন্ন ধরনের ছোট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। মূলত চামড়া, বস্ত্র এবং মৃৎশিল্পের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা। এখানে উৎপাদিত দ্রব্য দেশে-বিদেশে বিক্রি হয়। বাসিন্দাদের ধারণা, উন্নয়নের নামে তাঁদের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেওয়া হবে। এমনকী তাঁদের ভিটেছাড়াও করা হতে পারে।
সামনেই মহারাষ্ট্রে বিধানসভা ভোট। এর মধ্যে ধারাভি সংস্কার নিয়ে নতুন করে রাজনীতি শুরু হয়েছে মহারাষ্ট্রে। আদানির সঙ্গে মোদির ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রায়শই তোপ দাগতে দেখা যায় কংগ্রেস-সহ একাধিক বিরোধী নেতাকে। আদানি-অম্বানির মতো মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পপতির হাতে বিজেপি একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার তুলে দিচ্ছেন বলেও বহু দিন ধরেই সরব কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি। কার্যত এই একচেটিয়া কারবারিদের সঙ্গে ব্রিটিশদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তুলনাও টেনেছিলেন তিনি। মনে করা হচ্ছে, রাহুলের সেই ভাবনার প্রতিফলনও এবার দেখা গিয়েছে উদ্ধবের শিবসেনা ও মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসের মহাজোট বিকাশ আঘাড়ীর মধ্যে। উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে ঘোষণা করেছে, তাঁরা ক্ষমতায় এলে আদানি গোষ্ঠীর হাত থেকে ধারাভি পুনরুন্নয়ন প্রকল্পের বরাত কেড়ে নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে তিনি রাজ্যের সমস্ত ছাত্রদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম স্থিতিশীল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, বেশিরভাগ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মহা বিকাশ অঘাড়ির (এমভিএ) সামগ্রিক আশ্বাসের অংশ, তবে কিছু বিষয় রয়েছে যাতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। শিব সেনা (উদ্ধব)-র ইস্তাহারে সেগুলিকেই তুলে ধরা হয়েছে। একসময় বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও দল ভেঙে যাওয়ার পর থেকে বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে উদ্ধব গোষ্ঠীর। শিন্ডের শিবসেনার সঙ্গে যত ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে বিজেপির, শিবসেনা ততই বিরোধিতার সুর চড়া করেছে। আপাতত শিবসেনার হাতে ফলে অন্যতম ইস্যু ধারাভি বস্তির সংস্কার। কার্যত ভোটের মুখে ধারাভির বাসিন্দাদের উদ্বেগকে উস্কে দিয়েছে উদ্ধবের এই ঘোষণা।
রাহুল গান্ধী কিছুদিন আগেই ক্ষোভ উগরে দিয়ে জানিয়েছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশরা ভারতের মুখ বন্ধ করেছিল। মহারাজা, নবাবদের ভয় দেখিয়ে, ঘুষ দিয়ে তাঁদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। এখন কিছু নতুন একচেটিয়া কারবারি সেই জায়গা নিয়েছেন। রাহুলের অভিযোগের পরে রাজঘরানা থেকে আসা বিজেপির জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, দিব্যা কুমারীরা রাহুলকে নিশানা করেন। কংগ্রেসের পাল্টা অভিযোগ, কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল শিল্পপতিদের মোদী সরকারের প্রশংসা করতে বলছেন। ইতিমধ্যে ঝাড়খণ্ডে প্রচারে গিয়ে রাহুল ফের সেই ইস্যুকেই আঁকড়ে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিজেপি চায়, দু’তিন জন দেশটাকে চালাক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, অম্বানী, আদানি। তাঁরা গোটা দেশের সম্পদ ১০-১৫ জন কোটিপতির হাতে তুলে দিতে চান। সেই কারণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কখনও কৃষক, দলিত, আদিবাসীদের ঋণ মকুব করেন না। কিন্তু ২৫ জন কোটিপতির ১৬ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করে দেন।’’
আরও পড়ুন: মহারাষ্ট্রের স্টিয়ারিং অটোচালকের হাতে, বিজেপির তুরুপের তাস একনাথ?
আদানি-মোদির ঘনিষ্ঠতা এবং মোদির সহায়তায় আদানি গোষ্ঠীর ক্রমাগত ফুলেফেঁপে ওঠার ঘটনা নিয়ে বহুদিন ধরেই চর্চা চলছে জাতীয় রাজনীতিতে। ধারাভি মহারাষ্ট্রের তো বটেই, গোটা দেশেরই অন্যতম গরিব লোকের ঠিকানা। সেই কবে থেকে বস্তি, ভারতের দারিদ্রকে শিল্পে, সিনেমায় তুলে ধরার প্রবণতা দেখা গিয়েছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে। বিদেশের লোকজন সেই দৈন্যের ভারতকে দেখতে পছন্দ করেছে। এবং একটা সময়ে পৌঁছে সেটাই হয়ে উঠেছে এইসব বস্তিগুলির আয়ের পথও। তাকেই ক্রমশ পুঁজি বানিয়ে নিয়েছেন বাসিন্দারা। বাইরে থেকে ধারাভি বস্তি দেখতে আসা পর্যটককে তাই নিজেদের সেই অবস্থাটা শিল্পের মতো করেই তুলে ধরতে শিখেছেন এখানকার মানুষ। তাতে যদি দু-পয়সা আয় হয়, রাতের পাতে দুটো ভাত বেশি জোটে, ক্ষতিই বা কী! ধারাভি বস্তির মানুষের অবস্থাটা কি আদৌ পাল্টানো সম্ভব আদানির মতো শিল্পপতির হাত ধরে? গোটা বিশ্ব জুড়ে যেভাবে আদানির একের পর এক প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে, তা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের, তাতে প্রশ্ন ওঠে বইকি। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ভারতসফরে এলেন, তখন আমরা দেখেছি কীভাবে রাতারাতি গুজরাটের বস্তি পাঁচিল দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল গুজরাটের বিজেপি সরকার। আসলে সংস্কারের নামে তেমন কিছু করা হবে না তো ধারাভির সঙ্গেও? আদানি-মোদির সংস্কারের প্রতিশ্রুতিতে কান দিয়ে মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুও হারাবেন না তো বাসিন্দারা, উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না সেই আশঙ্কাও।