ধনঞ্জয়-সঞ্জয় একই মুদ্রার দুই পিঠ? ৩৪ বছর আগের ঘটনা কেন এত প্রাসঙ্গিক?

Dhananjoy Chatterjee Sanjoy Roy: অনেকেই এখনও মনে করেন, ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় গরিব পরিবারের মানুষ বলেই তাঁকে ফাঁসানো সহজ হয়েছিল। মামলা লড়ার মতো ভালো আইনজীবীও দিতে পারেনি তাঁর পরিবার।

হেতাল পারেখ ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯০ সালে। এই ঘটনায় ২০০৪ সালে ফাঁসি হয়েছিল ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের। ঘটনার ৩৪ বছর পর আবার একটি ধর্ষণ ও ফাঁসির সম্ভাবনায় তোলপাড় বাংলা। আরজি কর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে আদালত মূল অভিযুক্ত হিসেবে একজনকেই দোষী সাব্যস্ত করেছে। সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। কিন্তু এই রায়ের পর নাগরিকদের একাংশ মনে হচ্ছে, বলির পাঁঠা হয়েছেন সঞ্জয়। বড় কাউকে আড়াল করতেই তাঁকে সামনে আনা হয়েছে, দোষী প্রমাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। ধনঞ্জয়ের ফাঁসির পরেও উঠেছিল একই অভিযোগ। শোনা গেছিল, পারিবারিক 'অনার কিলিং' ঢাকতে দরিদ্র ধনঞ্জয়কে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আরজি কর-কাণ্ডের আবহে ধনঞ্জয়ের মামলায় পুনর্বিচারের দাবিও উঠেছিল। ১৯৯০ সালের ৫ মার্চ হেতাল পারেখ হত্যাকাণ্ড নিয়ে তোলপাড় হয় রাজ্য। কলকাতায় নিজের আবাসনেই নৃশংসভাবে খুন হন হেতাল। তদন্তে একমাত্র অভিযুক্ত হিসাবে আবাসনের নিরাপত্তারক্ষ ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের নামই উঠে এসেছিল। দীর্ঘ ১৪ বছর কারাবাসের পর আদালতের নির্দেশে ২০০৪ সালের ১৪ অগাস্ট ধনঞ্জয়কে ফাঁসি দেওয়া হয়। ধনঞ্জয়ের বাড়ি ছিল ছাতনার কুলুডিহি গ্রামে। আরজি কর-কাণ্ডের পর, ৩৪ বছর আগে ঘটে যাওয়া হেতাল পারেখ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়। ধনঞ্জয়ের গ্রামের বাসিন্দাদের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় মামলা পুনর্বিচার মঞ্চ’। পুনর্বিচারের দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানও হয়।

আরও পড়ুন- আরজি কর ধর্ষণ কাণ্ডে চূড়ান্ত রায়ে একমাত্র দোষী সঞ্জয় রায়! কী সাজা?

অনেকেই এখনও মনে করেন, ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় গরিব পরিবারের মানুষ বলেই তাঁকে ফাঁসানো সহজ হয়েছিল। মামলা লড়ার মতো ভালো আইনজীবীও দিতে পারেনি তাঁর পরিবার। প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম। ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ভাই বিকাশ চট্টোপাধ্যায়ও সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, “আমরা গরিব। টাকাপয়সা ছিল না। যাদের টাকাপয়সা আছে, আইন তাদের জন্য। দেশের বিচারব্যবস্থা হল প্রভাবশালীদের জন্য।” তাঁর অভিযোগ, হেতাল পারেখের পরিবার টাকা দিয়ে 'কিনে নিয়েছিল' ধনঞ্জয়ের আইনজীবীকে। তাই তাঁদের হয়ে কোনও সওয়ালই করেননি তিনি। ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে মা-বাবা শেষ চেষ্টাও করেছিলেন। আইনি লড়াই লড়তে জমিজমা সব বিক্রি করে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন ধনঞ্জয়ের বাবা বংশীধর। ধনঞ্জয়ের ফাঁসির পর তাঁর স্ত্রী ফিরে যান বাপের বাড়ি। অঙ্গনওয়াড়ির কাজ করতেন তিনি।

হেতালের ধর্ষণের ঘটনাতে একাধিক অসঙ্গতি ছিল। সেই সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে জানা যায়, হেতালের মৃতদেহ আবিষ্কার হয় সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিটে অথচ পুলিশকে জানানো হয় ৯টা ১৫ মিনিটে। হেতাল পারেখের মা প্রথম মৃতদেহ দেখেছিলেন মেয়ের। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় জানা যায়, হেতালের মৃতদেহ আবিষ্কারের সময় হেতালের মায়ের আচরণ ছিল অদ্ভুত৷ তিনি বাইরে মন্দির থেকে ফিরে এসে চাকরদের তড়িঘড়ি দরজা ভাঙার নির্দেশ দেন৷ মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা, বাথরুমে গেছে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করেননি বলেই অভিযোগ ওঠে৷ দরজা ভেঙে হেতালের মৃতদেহ আবিষ্কার করার পরই তিনি নাকি একা হাতে মৃতদেহ তুলে নিয়ে একতলায় লিফটের মধ্যেই এক ঘণ্টা বসে থাকেন, ছেলে না ফেরা পর্যন্ত৷

পোস্ট মর্টেম ও ফরেনসিক পরীক্ষায় দেখা গেছিল হেতালের যোনিতে বীর্য পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায় মৃতের যৌনকেশে, অন্তর্বাসে ও স্কার্টে। অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছিলেন, অন্তর্বাসে বীর্য পাওয়ার স্বাভাবিক ব্যাখ্যা হচ্ছে সঙ্গমের পর তা পরা হয়েছিল, অর্থাৎ ঐচ্ছিক যৌন সম্পর্ক হয়েছে। অন্য কোনও গোপনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। হেতালের মা পুলিশকে বলেছিলেন, দেহ আবিষ্কারের সময় তা নগ্ন ছিল ছিল। অথচ ময়নাতদন্তের সময় মৃতদেহের শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গেও পোশাক অক্ষত দেখা গেছিল। এমনকী পোস্টমর্টেম রিপোর্টে শুধু লেখা হয়েছিল, যৌনসংসর্গ হয়েছে। তা ঐচ্ছিক কিনা উল্লেখ ছিল না। রিপোর্টে ‘ধর্ষণ’ শব্দের উল্লেখ ছিল না।

৩৪ বছর আগের সেই ঘটনা সঞ্জয় রায়ের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সূত্রে কেন উঠে আসছে আবার?

আরও পড়ুন- ৫৮ দিন পর আরজি কর কাণ্ডে প্রথম চার্জশিট সিবিআইয়ের! কী রয়েছে ২১৩ পাতার সেই চার্জশিটে?

আরজি কর হাসপাতালের সেমিনার হল থেকে তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয় ২০২৪ সালের ৯ অগাস্ট। ঠিক এর পরের দিনই সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। সঞ্জয়ের গ্রেফতারির পর খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "একটাই শাস্তি। ফাঁসি দিয়ে দাও, যাতে এক জনকে ফাঁসি দিলে অন্যেরা কিছু করার আগে ভয় পায়। কিন্তু এটা আমি নিশ্চয়ই বলব, প্রকৃত দোষী যেন শাস্তি পায়। নিরাপরাধী যেন (শাস্তি) না পায়। কারণ, এখন ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের কেসটা প্রতি দিন লেখা হচ্ছে।" এরপর সিবিআইয়ের হাতে চলে যায় মামলার তদন্তভার। সিবিআই যে চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে, তাতে সঞ্জয়কেই একমাত্র অভিযুক্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। পুলিশ ও সিবিআই জানিয়েছে, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের দিন হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজে সঞ্জয় রায়কে দেখা গিয়েছিল। তবে, অগাস্ট মাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে অপরাধের স্থলে তথ্য প্রমাণ লোপাটের একাধিক অভিযোগ উঠেছে। সেমিনার রুম লাগোয়া এলাকায় মেরামতির কাজও শুরু করে দেওয়া হয়েছিল। ঘটনার দিন ওখানে আরও অনেকের থাকার কথা উঠে এসেছিল। তবে সিবিআইয়ের চার্জশিটে সেসবের বিশদ তথ্য নেই। একক দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সিভিক ভলান্টিয়ারকেই। ১৮ জানুয়ারি, শনিবার শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস সঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করেন।

কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিটের বাসিন্দা সঞ্জয় রায়ের প্রতিবেশীদের একাংশ আগেই বলেছিলেন, সঞ্জয় 'ভালো ছেলে' এমন দাবি তারা করেন না। কোন পরিস্থিতিতে সঞ্জয় এমন ঘটনা করে থাকতে পারে তা কেবল সঞ্জয়ই জানেন। তবে একা সঞ্জয়ই দোষী তা মানতে এখনও অসুবিধাই হচ্ছে প্রতিবেশীদেরও। ওই ঘটনার পরে যেভাবে অধ্যক্ষ এবং খোদ পুলিশের মদতে তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে ফেলা হয়েছে, যেভাবে শুরু থেকেই ধর্ষণ বিষয়টিকে আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে তাতে নাগরিকদের একাংশ বিশ্বাস করছেন না সঞ্জয়ই কেবল ঘটনায় যুক্ত। অধিকাংশ মানুষই বলছেন, খুন-ধর্ষণের ঘটনায় আরও অনেকে জড়িত। কিন্তু তাঁরা প্রভাবশালী। সঞ্জয়কে গ্রেফতার করা ছিল সবচেয়ে সোজা কাজ। তাই-ই হয়েছে এক্ষেত্রে। তাই স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠছে, সঞ্জয় আর ধনঞ্জয় একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ নয় তো?

More Articles