দেশদ্রোহিতার আইন বহাল, কেন সেকেলে ড্রামাটিক পারফর্ম্যান্স অ্যাক্ট নিয়ে সরব মোদি?

Modi on Dramatic Performances Act: এই আইনে কী বলা আছে? এই আইন অনুযায়ী সরকার 'কলঙ্কজনক, মানহানিকর, রাষ্ট্রদ্রোহী বা অশ্লীল নাটকের প্রকাশ্যে অভিনয় নিষিদ্ধ" করতে পারে।

ড্রামাটিক পারফর্ম্যান্স অ্যাক্ট, ১৮৭৬। নাম শুনে দু'টি বিষয় স্পষ্ট। এক, এই আইন ব্রিটিশদের আমলের। দুই, এই আইন অবশ্যই পথনাটক, নাটক, সঙ্গীত, নাচ, মূকাভিনয়, ছবি আঁকা সহ অন্যান্য শিল্প উপস্থাপনা বিষয়ে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিন কয়েক আগেই প্রশ্ন তুলেছেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও কেন এমন এক ঔপনিবেশিক আইন ভারতে বহাল ছিল? প্রাচীন এবং অপ্রচলিত আইন বাতিল করতে বিজেপি সরকার কতখানি মরিয়া সে প্রচেষ্টার কথা বলতে গিয়েই প্রধানমন্ত্রী মোদি এই ড্রামাটিক পারফর্ম্যান্স অ্যাক্ট, ১৮৭৬-এর উল্লেখ করেন। এই আইনে কী বলা আছে? এই আইন অনুযায়ী সরকার 'কলঙ্কজনক, মানহানিকর, রাষ্ট্রদ্রোহী বা অশ্লীল নাটকের প্রকাশ্যে অভিনয় নিষিদ্ধ" করতে পারে।

১৮৭৫ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৭৬ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রিন্স অফ ওয়েলস, অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড ভারত সফরে আসেন। এই সময়কালে উদীয়মান ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আবেগের উত্থানকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ শাসক যে সমস্ত আইন প্রণীত করে, তারই অন্যতম হচ্ছে এই আইনটি। এই সময়কালেই অন্যান্য আরও কিছু কঠোর আইন প্রণীত করে ব্রিটিশ শাসকরা, যেমন ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট, ১৮৭৮ এবং রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, ১৮৭০।

ড্রামাটিক পারফর্ম্যান্স অ্যাক্ট, ১৮৭৬ কী বলছে?

ড্রামাটিক পারফর্ম্যান্স অ্যাক্টের অধীনে, "যে কোনও নাটক, মূকাভিনয় বা অন্য কোনও নাটক যে প্রকাশ্যে পরিবেশিত হতে চলেছে, তা নিষিদ্ধ করা যেতে পারে যদি সরকার মনে করে যে নাটকটি কলঙ্কজনক বা মানহানিকর, আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি অসন্তোষের অনুভূতি জাগাতে পারে বা কোনও অনুষ্ঠানকে ভণ্ডুল করতে পারে এমন প্রদর্শনী সরকার এই আইনে নিষিদ্ধ করতে পারে।"

এই আইন অনুযায়ী, আইনের অধীনে নিষিদ্ধ যে কোনও কাজ বা অনুশীলনের জন্য যে বাড়ি-ঘর বা স্থান ব্যবহার করা হয় বা ব্যবহার হতে চলেছে এমন স্থানের তল্লাশি ও বাজেয়াপ্ত করার পরোয়ানা দিতে পারেন যে কোন ম্যাজিস্ট্রেটই। এই আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে তিন মাস পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা বা দুই-ই হতে পারে।

আরও পড়ুন- শুধুই তথ্যের মারপ্যাঁচ মোদি সরকারের! বাস্তবে কতখানি উপকৃত দেশের চাষিরা?

স্বাধীন ভারতে ড্রামাটিক পারফর্ম্যান্স অ্যাক্ট

নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসাআর পরে অপ্রচলিত আইনগুলিকে বাদ দেওয়ার কর্মসূচির অংশ হিসাবে ২০১৮ সালে এই আইনটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করা হয়। তবে ১৯৫৬ সাল থেকেই ড্রামাটিক পারফর্ম্যান্স অ্যাক্ট বৈধ আইন ছিল না। ১৯৫৬ সালের ১০ মে, রাজ্য বনাম বাবু লাল শীর্ষক একটি মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয় যে আইনটি ভারতের সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।

ড্রামাটিক পারফর্ম্যান্স অ্যাক্ট মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, দিল্লি এবং তামিলনাড়ু সহ রাজ্য স্তরেও আনা হয়েছিল। আইনটি পরে দিল্লি সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বাতিল করা হয়। মাদ্রাজ হাইকোর্ট ২০১৩ সালে তামিলনাড়ু ড্রামাটিক পারফরম্যান্স অ্যাক্ট, ১৯৫৪ বাতিল করে।

১৯৫৩ সালের জুন মাসে, ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন বা আইপিটিএ-র লখনউ শাখা মুন্সি প্রেমচাঁদের ছোট গল্প 'ইদগাহ'-এর উপর ভিত্তি করে একটি নাটক মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করেছিল। আইন অনুযায়ীই অনুমতির জন্য আবেদন করেছিল আইপিটিএ এবং প্রাথমিকভাবে অনুমতি দেওয়াও হয়েছিল। তবে কোনও এক অজানা কারণে, লখনউয়ের ম্যাজিস্ট্রেট অনুমতি বাতিল করে নাটকটি নিষিদ্ধ করে দেন। নাটক চলাকালীনই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এবং আইপিটিএ-র সদস্যরা তা না মেনেই নাটক উপস্থাপন করে চলেন।

এলাহাবাদ হাইকোর্ট এই আইনের সাংবিধানিকতা খতিয়ে দেখে। এলাহাবাদ হাইকোর্ট কয়েকটি রায়ের উল্লেখ করে যেখানে দেখা গিয়েছে, যে সব ঔপনিবেশিক বিধি নতুন সংবিধানে নিশ্চিত করা মৌলিক অধিকারগুলির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল তা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বা সংশোধন করা হয়েছে। আদালত তার রায়ে জানায়, "আমাদের মতে, ড্রামাটিক পারফর্ম্যান্স অ্যাক্ট ভারতের সংবিধানের বিরোধী কারণ এটি বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে যা আমাদের সংবিধান অনুযায়ী করা যায় না।" রায়ে আদালত এও উল্লেখ করেছিল যে, এই আইনে ক্ষমতায় থাকা শাসকের আদর্শের বিরোধী বা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষরা এর শিকার হতে পারেন।

মজার বিষয় হচ্ছে, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার সময় কার্যকর থাকা আইনগুলি কার্যকরী থাকবে। মোদি সরকার সহ নানা সরকারই প্রাচীন ঔপনিবেশিক আইনের বিরোধিতার কথা বললেও বেশ কয়েকটি ঔপনিবেশিক আইনকে রক্ষাও করেছে। অতীতে, কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন সরকার প্রতিরোধমূলক আটক আইন এবং বেআইনি সংগঠন আইনকে রক্ষা করেছে।

মোদি সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ আইনকে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় নাম পরিবর্তন করে বহাল রেখেছে। বৈবাহিক ধর্ষণের ব্যতিক্রমকেও রক্ষা করেছে বিজেপি সরকার। এটিও একটি ঔপনিবেশিক আইন, যা বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। তাহলে বিজেপি সরকার ড্রামাটিক পারর্ফম্যান্স আইন বাতিল করল কীভাবে? ২০১৪ সাল থেকে, মোদি সরকার এই ধরনের ২,০০০ টিরও বেশি আইন বাতিল করেছে৷ ড্রামাটিক পারর্ফম্যান্স অ্যাক্ট, ১৮৭৬-কে আদালত অসাংবিধানিক ঘোষণা করে এবং বাতিল ও সংশোধন (দ্বিতীয়) আইন, ২০১৭-র মাধ্যমে সংসদে এই আইন চিরতরে বাতিল করা হয়। তাহলে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নিয়ে কেন এত রক্ষণশীল মোদি সরকার?

আরও পড়ুন-মোদির নিজ রাজ্য এত উন্নত হলে কেন আমেরিকায় পালাচ্ছেন গুজরাতিরা?

মোদি বলেছেন, "জনসমক্ষে ১০ জনকে নাচতে দেখা গেলে গ্রেফতারের বিধান রয়েছে আইনে। এর মানে হলো যদি বিয়ের সময় বরযাত্রীতে ১০ জন লোক নাচতে থাকে, পুলিশ বরসহ তাদের গ্রেফতার করতে পারে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও এই আইন ছিল। আমাদের (এনডিএ) সরকার সেই আইনটি বাতিল করেছে।” মোদি স্বাভাবিকভাবেই কংগ্রেসকে আক্রমণ করেছেন, বলেছেন, “তৎকালীন সরকারের কাছে আমার কিছু বলার নেই। আমি আরও আশ্চর্য হলাম কেন জামাত এবং ‘খান মার্কেট গ্যাং’ ৭৫ বছর ধরে এ ধরনের আইন নিয়ে নীরব। যারা প্রতিনিয়ত আদালতে যান এবং যারা পিআইএল-এর ‘ঠিকাদার’ তারা নীরব কেন? স্বাধীনতার কথা তখন তাদের মাথায় আসেনি?”

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে কংগ্রেস রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিলের প্রস্তাব আনার জন্য সমালোচিত হয়েছিল। অরুণ জেটলি তখন বলেছিলেন, কংগ্রেস দলটি নকশাল এবং জিহাদি-তে ভরে গেছে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিল করার পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি ভোটও কংগ্রেসের প্রাপ্য হওয়া উচিত নয়। তৎকালীন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ঘোষণা করেছিলেন, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিল হলে তা সন্ত্রাসবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মুখে হাসি ফোটাবে এবং সশস্ত্র বাহিনীর মনোবল কমিয়ে দেবে।

এরপরেই অবশ্য প্রধানমন্ত্রী মোদি 'নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার' কথা বলেন, বলেন "এই দেশে সেকেলে ঔপনিবেশিক আইনের কোনও স্থান নেই"। অথচ দেখা যায়, কৃষক আন্দোলনের সময় ছয়টি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়েছিল, ২৫টি মামলা হয় সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভের সময়, ২২টি হাতরাস গণধর্ষণের পরে এবং ২৭টি পুলওয়ামা হামলার পরে।

More Articles