ইন্দিরার জরুরি অবস্থার বিরোধিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন RSS পরিচালক
50 Years of Emergency: এই চিঠি এখনও দেখতে পাওয়া যায় মধুকর দেওরাসের নিজের লেখা, ‘হিন্দু সংগঠন অউর সত্তাবাদী রাজনীতি’ বইটির পরিশিষ্ট অংশে।
ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে ‘জরুরি অবস্থা’ শব্দবন্ধটি এখনও দুঃস্বপ্ন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ঘোষিত হওয়া এবং ২১ মাস ধরে চলা
সময়কাল আজও ভারতের গণতান্ত্রিক মানুষজনের কাছে এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়। যারা সেই জরুরি সময় প্রত্যক্ষ করেছেন, তারা আজও ভুলতে পারেন না মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কীভাবে খর্ব হয়েছিল সেদিন। কীভাবে বিরোধী নেতাদের কারাবন্দি করা হয়েছিল, বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। আজকের শাসক বিজেপি অনবরত সেই জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করে চলেছে। বিজেপি জানে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির মতো জরুরি অবস্থা জারি করলে শুধু দেশে নয়, বিদেশের মাটিতেও তারা নিন্দিত হবে। তাই এখন বিজেপি একই ধরনের কাজ করে অর্থাৎ দেশের সাংবাদিক এবং গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বরদের জেলে বন্দি করে রাখে, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, অন্যান্য দমন পীড়ন সবটাই করে, জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করে। এই বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় সেই সময়ের এক বিশিষ্ট সাংবাদিক কুমি কাপুর, যিনি নিজে জরুরি অবস্থা দেখেছিলেন, লিখেছেন আজকের শাসক বিজেপির আচরণের সঙ্গে সেই ১৯৭৫ সালের শাসক ইন্দিরার সময়ের প্রচুর সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্ক জন্মায়, আবার ওই কালো দিন ফিরে আসবে না তো
আগামী বছর ঘোষিত ‘জরুরি অবস্থা’-র পঞ্চাশ বছর হবে। শাসক বিজেপি তাই অষ্টাদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশন থেকেই খুব সচেতনভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ঘোষিত, ‘জরুরি অবস্থা’-কে অন্ধকার দিন বলে বর্ণনা করেছে। তাঁদের এই প্রক্রিয়াও খুব অভিনব। বিজেপি সরকার প্রাথমিকভাবে লোকসভার স্পিকারকে দিয়ে এই কথাগুলো বলিয়েছে এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর
ভাষণেও তা যুক্ত করেছে। লোকসভার স্পিকার বা রাষ্ট্রপতির ভাষণে যদি কোনও বিষয়ের উল্লেখ থাকে, তাহলে তা সংসদের কার্যবিবরণীতে নথিবদ্ধ করা হয়। বিজেপি এখন যেভাবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী নেতা, মুখ্যমন্ত্রী এবং গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে, তা জরুরি অবস্থারই নামান্তর। বিজেপির আজকের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কংগ্রেসের জরুরি অবস্থার একটাই তফাত। কংগ্রেস ঘোষণা করে জরুরি অবস্থা জারি করেছিল, তা চলেছিল প্রায় ২১ মাস। বিজেপি ঘোষণা না করেই গত দশ বছর ধরেই এই অবস্থা জারি রেখেছে। তবে, এবারের লোকসভায় কেন এই প্রসঙ্গ আবার সামনে নিয়ে আসা হলো?
আরও পড়ুন- মোদির প্রিয় ম: মুসলিম, মাদ্রাসা, মাংস… মণিপুর কই? প্রশ্ন মহুয়ার
বিজেপি বলে থাকে, তাদের বহু নেতা কংগ্রেসের জরুরি অবস্থার শিকার হয়েছিলেন। ঘটনা কিছুটা হলেও সত্য। সেই জন্যই কি তারা এই প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসতে চাইছেন এখন? নাকি, আসলে বিজেপি জানে যদি কংগ্রেসের খারাপ সিদ্ধান্তগুলোর এখন সমালোচনা করা যায়, তাহলে আজকের কংগ্রেসের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে! রাহুল গান্ধি যে মানুষের সঙ্গে মিশছেন, মানুষের সমস্যা শোনার জন্য কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর, মণিপুর থেকে গুজরাত ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ করে মানুষের সহানুভূতি পাচ্ছেন, তা এভাবে কিছুটা হলেও খর্ব করা যাবে। এই রাজনীতি বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের শাসকদল করে চলেছে, যাকে ইংরেজিতে বলে পলিটিক্স অফ হোয়াটঅ্যাবাউটারি। অর্থাৎ, যদি মেনেও নেওয়া হয় তাঁরা ভুল করছেন এখন, কংগ্রেস যে একই দোষে দুষ্ট, তা প্রমাণ করতে পারলে নিজেদের দোষ কিছুটা হলেও কম দেখায়! আরও একটা বিষয় বিজেপি জানে, যদি ইতিহাসের ওই কালো দিনগুলো নিয়ে আলোচনা করা যায়, তাহলে বিরোধী দলগুলোর মধ্যেও বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে এবং বিরোধী দলগুলোর যে ঐক্য সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি হয়েছে, তা ভেঙে যেতে পারে। এর লাভের গুড় নিজের ঘরে তুলবে শাসকদলের জোট। এবারের নির্বাচনে মানুষ খুব সচেতনভাবেই ভোট দিয়েছে। যারা বিজেপিকে পরাজিত করতে পারবে, সেই দলকেই মানুষ ভোট দিয়েছে। বিরোধী জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপির 'আব কি বার চারশো পার'-এর দম্ভকে কিছুটা হলেও কমাতে পেরেছে। যদিও সংসদের অধিবেশন দেখলে মনে হচ্ছে না, মোদির দম্ভ এবং অহংকার এতটুকুও কমেছে।
রাজস্থানের কোটা কেন্দ্রের বিজেপি সাংসদ ওম বিড়লা গতবার যে পদ্ধতিতে লোকসভা চালিয়েছেন, সেই একই পদ্ধতিতে ১৮ তম লোকসভা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিগত বছরে, লোকসভা চলাকালীন প্রায় ১৫০ জন বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কার করেছিলেন তিনি। এবারে বিরোধী দলের বেশ কিছু সাংসদ ওম বিড়লাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে স্পিকার কিন্তু শাসকদলের প্রতিনিধি নন, তিনি পুরো সংসদের স্পিকার। সুতরাং তাঁরই দায়িত্ব সাংসদদের সঠিক সময় নির্ধারণ করে তাঁদের বলার সুযোগ করে দেওয়া। রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে নিট দুর্নীতির কথা তুলেছেন। সেই প্রসঙ্গে যখন বিরোধী দলনেতা বলতে শুরু করেছেন, স্পিকার ওম বিড়লা তাঁর মাইককে বন্ধ করে দিয়ে বলেন, বলতে হলে রাষ্ট্রপতির ভাষণের সবটুকু নিয়ে কথা বলতে হবে, শুধু নিট পরীক্ষা এবং সেই সমস্যা নিয়ে বললেই হবে না। অর্থাৎ স্পিকারও চান, প্রধান বিরোধী দল শুধু নিট পরীক্ষার সুবিধা অসুবিধা না তুলে ধরে, সেই অন্ধকারময় জরুরি অবস্থা নিয়ে বিতর্ক করুক, যাতে শাসকদলের
পক্ষ থেকে তাঁদের কৃতকার্যের জন্য সমালোচনা করতে সুবিধা হয়। তাতে ঢাকা পড়ে যায়, বিজেপির নিটদুর্নীতির খবর।
বিজেপির একটা রাজনৈতিক কৌশল হলো, মানুষকে হয় অতীত নিয়ে, নয় ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত রাখা, যাতে বর্তমানে কী ঘটছে তা নিয়ে আলোচনা না হয়। সেই জন্যই কখনও বাবরি, কখনও জ্ঞানবাপী আবার কখনও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমান শাসকেরা ধ্বংস করেছিল কিনা তাই নিয়ে আলোচনা উস্কে দেওয়া হয়। সেই জন্যই আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে কাঠগড়ায় তুলতে চাওয়া। বিজেপি স্বপ্ন দেখায়, ভারত ভবিষ্যতে একদিন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ হবে, ২০৪৭ সালে সবাই কাজ পাবে। একদিন সত্যিই ‘আচ্ছে দিন’ আসবে। আর আজকের বেকারত্ব, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে দেশজোড়া ক্ষোভ থাকলেও আলোচনা হবে না তা নিয়ে। কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হলো কিনা, তা নিয়ে কথা হবে না। মানুষ ব্যস্ত থাকবে অতীত নিয়ে, মোদি বিশ্বগুরু হয়ে উঠে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণার খোয়াব দেখবেন।
আরও পড়ুন- হিন্দু মানেই বিজেপি নয়, অযোধ্যা শিক্ষা দিয়েছে, লোকসভায় রাহুল
কংগ্রেসের যদি সমালোচনা করতেই হয় তাহলে পাশাপাশি আরএসএসের কী ভূমিকা ছিল, সেই কথাও জনসমক্ষে বলতে হবে। বিজেপি সেকথা চেপে যেতে চায়। সেই সময়ে যিনি আরএসএসের সঙ্ঘ পরিচালক ছিলেন, সেই মধুকর দেওরাস ইন্দিরাকে চিঠি লিখে জানান,
আরএসএস জরুরি অবস্থার সাময়িক বিরোধিতা করলেও, আর বিরোধিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাঁকে যাতে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় সেই আর্জিও জানানো হয় চিঠিতে। এই চিঠি এখনও দেখতে পাওয়া যায় মধুকর দেওরাসের নিজের লেখা, ‘হিন্দু সংগঠন অউর সত্তাবাদী রাজনীতি’ বইটির পরিশিষ্ট অংশে। সমাজকর্মী যোগেন্দ্র যাদব কয়েক বছর আগে তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে এই বিষয়টির উল্লেখ করেছিলেন।
শুধু এই আত্মসমর্পণের চিঠি নয়, গত দশ বছরে, বিজেপি যেভাবে গণতন্ত্রকে রোজ হত্যা করেছে, কখনও সংসদের ভিতরে, কখনও বাইরে, কখনও আইনিভাবে আবার কখনও বুলডোজার দিয়ে সংখ্যালঘু মানুষের ঘর ভেঙে, তাতে কি তাদের নৈতিক অধিকার আছে
ঘোষিত ‘জরুরি অবস্থা’-র বিরোধিতা করার? গত লোকসভা চলাকালীন যেভাবে বিরোধী সাংসদদের বহিষ্কার করে একের পর এক
বিল পাস করা হয়েছে তা নিজেই এক অন্ধকার অধ্যায়। কংগ্রেসের জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করা কি বিজেপির সাজে? বিরোধীরা যদি বলার সুযোগ পান, তাহলে এই বিষয়গুলি সামনে নিয়ে আসা উচিত বিরোধীদের। অবশ্য বলতে গেলে ‘নিরপেক্ষ’ স্পিকার বিরোধীদের মাইক্রোফোন চালু রাখেন কিনা, সেটাও দেখার।