INDIA-র মুখ কে? আদর্শ দিয়ে কতটা লড়াই সম্ভব মোদির বিরুদ্ধে?
INDIA vs NDA: পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম কোনওভাবেই মমতার সঙ্গে বা কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআইএম সমঝোতায় যেতে পারবে না।
বিরোধী ২৬টি দলের বৈঠকের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে আগাম কোনও বাণী এখনই শুনিয়ে দেওয়া খানিকটা বালখিল্যতা হবে। পথ অনেকটা বাকি। সাম্প্রতিক অতীতের অভিজ্ঞতা খুব একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয় না। আবার এটিও ঠিক যে, রাজনীতি একটি পদ্ধতি এবং তা নতুন নতুন সমীকরণের জন্ম দিতে থাকে। কাজেই ভবিষ্যতের আলোচনা ছেড়ে, বর্তমানকেই দেখি। বর্তমান এটাই বলছে যে, বিরোধী দলগুলি নিজেদের জোটের নামকরণে 'ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স'-এর আদ্যাক্ষর দিয়ে 'ইন্ডিয়া' শব্দবন্ধটি এনে বিজেপির রাজনৈতিক আলেখ্যকে খানিকটা গুলিয়ে দিয়েছে। বিপাকে ফেলেছে নরেন্দ্র মোদিকে।
প্রধানমন্ত্রীর অস্বস্তির কারণ স্বাভাবিক। এর আগে এই কলামের একটি লেখায় আমি উল্লেখ করেছিলাম, মূলত যে কয়েকটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে বাজিমাত করে, তার অন্যতম হলো ব্যক্তিত্বের লড়াই। আরেকটি হল জাতীয়তাবাদ।
জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে বিরোধীদের উত্তর 'ইন্ডিয়া' (এই প্রচার আরও ধারালো করতে হবে যদিও)। কিন্ত ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো সারা দেশের সব প্রান্তে স্বীকৃত কোনও একজন নেতা এখনও বিরোধী শিবিরে নেই। রাহুল গান্ধি গত দু'টি নির্বাচনে কী করেছেন, তা সবাই দেখেছে। নিজের ইমেজ পাল্টানোর চেষ্টা করে রাহুল, অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর দৌড়ে থাকলেও, তাঁরা সারা দেশে জনপ্রিয়তার বিচারে মোদির থেকে শত যোজন দূরে।
এই লড়াইয়ে বিজেপি এবং মোদি যে প্রশ্নটি বারবার করে থাকেন, তা হলো 'মোদি বনাম কে?' গত দু'টি লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি বনাম রাহুল গান্ধির লড়াইয়ের পরিণাম সবাই দেখেছে। কাজেই ব্যক্তিত্বের লড়াইয়ে বিরোধীরা মোদির সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবেন না। আর ইতিমধ্যেই তিনি নিজেকে বিশ্বনেতার স্তরে যেভাবে বসিয়েছেন এবং ভারতীয় রাজনীতির নিরিখেও তাঁকে যেভাবে সব কিছুর উপরে রাখা হয়, তাতে ভক্তকুল মোদিকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে আরও একবার দেখতে ফের আকুল হয়ে পড়বেন এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই ব্য়ক্তিত্বের লড়াইকে পাশে সরিয়ে রেখে আদর্শের লড়াইয়ের একটি রাস্তা খুলে দিয়েছে বিরোধী জোটের 'ইন্ডিয়া' নামকরণ।
আরও পড়ুন- এনডিএ বনাম ইন্ডিয়া, দেশের নামে বিজেপির আসন টলাতে পারবে কি বিরোধী মহাজোট?
রাহুল গান্ধিকে আমরা খুব একটা গুরুত্ব দিই না। কিন্তু তিনিই বোধহয় ভারতের একমাত্র বিরোধী শীর্ষ নেতা যিনি বারবার বিচারধারার বা আদর্শের লড়াইয়ের কথা বলে আসছেন। আরএসএস-বিজেপির আদর্শের মোকাবিলার কথা বলছেন বারবার। তাঁর ভারত জোড়ো যাত্রার মূলও তাই ছিল। ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে ভালবাসার পসরা সাজানোর কথা।
এই প্রথমবার বিরোধী দলগুলি 'মোদি হঠাও'-এর স্লোগান থেকে সরে এসে এই আদর্শের লড়াইয়ের একটি ভিত্তি তৈরি করার চেষ্টা করছে। বিরোধী জোটের বৈঠকের শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে যে সব নেতারা বক্তব্য রাখলেন, তাঁরা এক দু'বারের বেশি নরেন্দ্র মোদির নামই নেননি। কারণ ইন্ডিয়া জোটের লড়াই খুব বেশি হলে এনডিএ-র সঙ্গে এটাই বলতে চেয়েছেন তাঁরা।
সেই কাজ খানিকটা সহজ করে দিয়েছিল বিজেপিই। বেঙ্গালুরুতে যখন ২৬টি বিরোধী দলের বৈঠক হচ্ছে, তখন হঠাৎ করে বছর চারেক বাদে দিল্লিতে বিজেপির তরফে এনডিএ জোটের পুনরুজ্জীবনের প্রয়াসই বলে দেয়, কেন্দ্রের প্রধান শাসক দল একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। বিজেপি সভাপতি তাই ৩৮টি দলকে নিয়ে মহড়া দিতে উদ্যত হলেন। যাদের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের খাতায় নাম রয়েছে কিন্তু স্বীকৃতি নেই এমন রাজনৈতিক দলের সংখ্যাই বেশি।
২৬ দলের মোকাবিলা একা মোদিকে দিয়ে না করিয়ে বিরোধীদের খানিকটা অ্যাডভান্টেজ দিয়েছিল বিজেপিই। আর 'মোদি বনাম কে?'- এর উত্তর যখন 'মোদি বনাম ইন্ডিয়া' হয়, তখন অস্বস্তি তো হবেই। সেই অস্বস্তির প্রথম চিহ্ন দেখা যায় অসমের মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম প্রতিক্রিয়ায়। 'কংগ্রেস ইন্ডিয়ার জন্য, আর মোদিজি ভারতের জন্য' বলে টুইট করেও তা মুছে দিতে বাধ্য হন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। ভারত ও ইন্ডিয়া সব গুলিয়ে যায় প্রথম ধাক্কায়।
অনেক মোদি ভক্তই 'ভারত বনাম ইন্ডিয়ার' লড়াইয়ের কথা বলতে শুরু করেন। কিন্তু তাতে স্পষ্টতা ছিল না যে তাঁরা ঠিক কিসের বিরোধিতা করছেন। জাতীয়তাবাদের ইস্যুতে ভারত নামটিতে একটু দেশি ভাব থাকলেও ইন্ডিয়া খুব একটা পিছিয়ে থাকে না। তবে ইন্ডিয়া নামকরণের প্রথম সাফল্য এটাই যে, মোদি বনাম রাহুল গান্ধি থেকে সরে এসে ভারত বা ইন্ডিয়া শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে হচ্ছে শাসক দলকে বা তাদের সমর্থকদের।
ইন্ডিয়া শব্দবন্ধটি যে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না, আবার এটিতে কালিও লাগাতে হবে, আবার সেটা করতে গিয়ে নিজের দেশকেই গালাগাল করে জাতীয়তাবাদের ইস্যুতে পিছনে যাওয়া যাবে না- ব্যাপারটি বেশ জটিল বুঝেই ক্যামেরার আড়ালে বিজেপির সংসদীয় দলের বৈঠকে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার মতো নিষিদ্ধ সংগঠনে কীভাবে 'ইন্ডিয়া' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে বা সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা এই শব্দটি ব্যবহার করে কীভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বানিয়ে ভারত শাসন করেছে তা নিয়ে সরব হতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। তবে ইন্ডিয়া জোটের নামকরণকে বদনাম করা যে খুব সহজ হবে না এবং সেই চেষ্টার প্রতিক্রিয়া যে উল্টো হতে পারে, তা মোদি নিশ্চয়ই বুঝেছেন। তাই নিজে সরাসরি না বলে তাঁর কথা দলের মুখপাত্রদের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমে প্রচার করিয়েছেন।
যথাযথ কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা কংগ্রেস নেতারা কটাক্ষ করে বলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রীর ইন্ডিয়া নামটি বেশ পছন্দ হয়েছে।' ইন্ডিয়া নামটিকে আক্রমণ করা সহজ নয় কারণ, দেশের সংবিধানেই 'ইন্ডিয়া' শব্দের স্বীকৃতি রয়েছে! আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের প্রতিনিধিদের 'ইন্ডিয়া'র প্রতিনিধি হিসেবেই গণ্য করা হয়। তাই শাসক শিবিরে বিস্তর অস্বস্তি! ঠিক এই অস্বস্তির কারণেই উত্তরাখণ্ড থেকে নির্বাচিত বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ নরেশ বনশলকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, দেশের সংবিধান থেকে 'ইন্ডিয়া' শব্দটি তুলে দেওয়া হোক। কারণ এটি ইংরেজদের ঔপনিবেশিকতার ও দাসত্বের চিহ্ন বহন করে। অথচ ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ তৈরির অনেক আগে থেকেই ইন্ডিয়া শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন, ইয়ান জে ব্যারোর গবেষণাপত্র 'ফ্রম হিন্দুস্তান টু ইন্ডিয়া নেমিং চেঞ্জ ইন চেঞ্জিং নেমস'-এ বিস্তারিত ভাবে দেখানো হয়েছে, কীভাবে সিন্ধু নদীর নাম ভাষাতত্ত্বের এদিক ওদিকে ইন্ডাস হয়েছে আর তা থেকে কীভাবে ইন্ডাস নদীর পূর্ব পারের নাম গ্রিক-রোমানদের লেখায় ইন্ডিয়া হয়েছে। তারপরে কীভাবে ব্রিটিশরা অষ্টাদশ শতক থেকে এই নামের ব্যবহার করছেন তাও দেখানো হয়েছে।
সংবিধান লেখার সময়েও এ নিয়ে বিশদ আলোচনা ও বিতর্ক হয়। ঠিক হয় যে সংবিধানের প্রথমেই লিখে দেওয়া হবে 'ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত'। অর্থাৎ যা ইন্ডিয়া তাই ভারত। এ দেশের বহু ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতেই দু'টি নামকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। যাই হোক না কেন, বিজেপির তরফে এ সবই হলো জল মাপার খেলা। মূল কথা হল বিতর্ক যদি ভারত ও ইন্ডিয়া নিয়ে হয়, তাহলে সেটাও 'মোদি বনাম কে?'- এই আলেখ্য থেকে সরে এসেই করতে হবে বা মোদিকে ভারত ইত্যাদি শব্দবন্ধের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
গত ন'বছরে এই প্রথম বিরোধীরা প্রথমেই একটি এজেন্ডা সামনে রেখেছে। একটা বিকল্প আলেখ্য তৈরির কাজে নেমেছে। আর তাতে প্রতিক্রিয়া জানাতে হচ্ছে বিজেপিকে। ২০২৪-এর আগে পালে হাওয়া টানতে নতুন আলেখ্য তৈরি করতে হবে বিজেপিকে। খুব তাড়াতাড়ি। বিরোধীদেরও এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। মমতা বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে ইন্ডিয়া জোটের নামকে লোকের মুখে মুখে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শুধু নামেই সবটা হবে না। এই 'ইন্ডিয়া বনাম এনডিএ' বা 'ইন্ডিয়া বনাম মোদি'র লড়াইয়ে কোন আদর্শকে সামনে রাখবেন বিরোধীরা তা স্পষ্ট করতে হবে। শুধুই মোদি-বিরোধিতা থেকে খানিকটা হলেও তাঁরা সরে আসতে পেরেছেন।
আরও পড়ুন- পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘নিরঙ্কুশ’ জয় মানেই কি বাংলায় সব কিছু ঠিক?
কিন্তু এই জোটে হিন্দুত্বের রাজনীতি করে উঠে আসা শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে বা বিজেপির সঙ্গে ঘর করে আসা নীতিশ কুমার বা কোনও নির্দিষ্ট আদর্শে অবিচল না থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা নরম-হিন্দুত্বের পূজারি অরবিন্দ কেজরিওয়াল ঠিক কীভাবে নিজেদের লড়াইকে খাপ খাওয়াবেন ইন্ডিয়া জোটের আদর্শের লড়াইয়ে তা দেখতে হবে।
মুম্বইতে বিরোধী জোটের পরবর্তী বৈঠকে একটি স্টিয়ারিং কমিটি ও তার আহ্বায়ক এবং প্রচার সংক্রান্ত সাব-কমিটি ইত্যাদি তৈরি হওয়ার কথা। ঠিক যেভাবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর এনডিএ জোটের আহ্বায়ক করা হয়েছিল জর্জ ফার্নান্ডেজ বা পরে চন্দ্রবাবু নাইডুকে, ঠিক সেভাবেই এমন কোনও একজন নেতাকে ইন্ডিয়া জোটের আহ্বায়ক করতে হবে যাঁর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির কোনও ব্যক্তিত্বের লড়াই হতে পারে না। মমতা-রাহুল-নীতিশরা একসঙ্গে প্রচারের মুখ হতে পারেন কিন্তু জোটের মুখ কোনও একজন হলেই বিপদ।
তবে বিরোধী জোটের সবচেয়ে বড় কাঁটা সম্ভবত আসন সমঝোতা। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম কোনওভাবেই মমতার সঙ্গে বা কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআইএম সমঝোতায় যেতে পারবে না। অরবিন্দ কেজরিওয়ালও কংগ্রেসকে দিল্লি বা পঞ্জাবে আসন ছেড়ে দেবে এটাও অকল্পনীয়। সেই আলোচনা বিভিন্ন স্তরে হতে থাকবে। তবে এখন সব কিছু ছেড়ে বিরোধীদের আদর্শের লড়াই ও জনগণের মনের ইস্যুগুলিকে সামনে আনতে হবে। 'মোদি' থেকে ফোকাস সরাতে হবে 'ইস্যুতে'। এই কঠিন কাজ বিরোধীরা কেমন ভাবে করেন বা আদৌ করতে পারেন কিনা সেটাই আগামী মাস দশেক দেখতে হবে। কারণ আলেখ্য ঘোরানোর খেলায় নরেন্দ্র মোদি বা বিজেপি বা আরএসএস-ও বসে থাকবে না। এই খেলায় তারা দড়।