পনেরো-তেই ক্লান্ত মন: কেন বাড়ছে কিশোরীদের অবসাদ ও উদ্বেগ?
Mental health crisis in adolescents: প্রশ্ন টা হলো, ১০-১৯ বছর বয়সিরা, এই কম বয়সে কিশোরীরা এতটা মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে কেন? এবং মেয়েরাই কেন এই সমস্যায় বেশি ভুগছে?
শৈলীর বাবা-মা ভীষণ চিন্তিত, কারণ, মেয়ে কেমন যেন গুম মেরে আছে। মেয়ের বয়স মাত্র ১৫, এখনও তো কঠোর বাস্তবের মুখোমুখিই হয়নি, এতটা মানসিক চাপ নেওয়ার পর্যায়ে তো এখনও আসেইনি। আর আগে ত তো এরকম ছিল না। শৈলী ভীষণ প্রাণচঞ্চল ছিল। সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে, আনন্দ করতে পছন্দ করত, এক কথায় ছিল, 'people's person'। কিন্তু, এখন সকলের থেকে দূরে থাকতেই যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে। তাই, তার বাবা-মা তাই দেখা করেন একজন মনোবিদের সঙ্গে। সেখানেই জানতে পারেন, এই সমস্যা একা শৈলীর নয়, তার বয়সি বহু মেয়ের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে এবং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হতে থাকে, তা আমরা সকলেই জানি। বিশেষত আজকের দিনে, যখন মানসিক চাপ, উদ্বেগ, ভয়, আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা নিত্যদিন সকলে পকেটে পুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো এই সমস্যা কেবল বড়দের নয়। কিশোর-কিশোরীদেরও। ভারতে ১০-১৯ বছর বয়সি মেয়েদের মধ্যে এই সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সি অর্থাৎ শিশুদের মধ্যে একটু কম, কিন্তু কিশোরীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা উদ্বেগজনক ভাবে বেড়েই চলেছে।
২০১৫-১৬ সালের NMHS (National Mental Health Survey) অনুসারে, ১৩-১৭ বছর বয়সিদের মধ্যে ৭.৩ শতাংশই মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে। যার মধ্যে রয়েছে অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেশন, এবং অন্যান্য বিভিন্ন সমস্যা। ২০২৩-২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫-৪০ শতাংশে। বিশেষত শহরাঞ্চলে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যেই এইধরনের সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে।
আরও পড়ুন- জলপানেই কমবে মানসিক চাপ! নতুন গবেষণায় উঠে এল চমকে দেওয়া তথ্য
ভারতে উভয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৫.৯ শতাংশ অবসাদ এবং ১৩.৭ শতাংশ অ্যাংজাইটি। এবং ৩৫.৩ শতাংশ অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে ভুগছে, জার মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। ৪৮.৮ শতাংশ কিশোরীরা মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে।
GBD (Global Burden of Disease)-এর তথ্য বলছে, মানসিক সমস্যাগুলি Disability Adjusted Life Years (DALYs)-এর একটি প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। অর্থাৎ, অকাল মৃত্যু, জীবনের একটি বা কয়েকটি বছর নষ্ট হয়ে যাওয়া, শক্তিহীন হয়ে জীবনের কয়েকটি বছর কাটানো— এখন নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের।
সংখ্যার হিসেবে বলতে গেলে, ১০-১৯ বছর বয়সি ২৫.৩ কোটি কিশোর এবং কিশোরী রয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ১২ কোটি কিশোরী (Unicef-এর রিপোর্ট অনুসারে)। NMHS-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, (৭.১%) বলা যেতে পারে ৮৫ লাখ কিশোরী চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ২-৫ কোটি গভীর মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু, প্রশ্ন টা হলো, ১০-১৯ বছর বয়সিরা, এই কম বয়সে কিশোরীরা এতটা মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে কেন? এবং মেয়েরাই কেন এই সমস্যায় বেশি ভুগছে?
উত্তর একটি নয়, একাধিক,
বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা, পরীক্ষার সীমাহীন চাপ এবং বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রত্যাশা না পূরণ করতে পারার ভয় আঁকড়ে ধরে এই বয়সের মেয়েদের। ভালো ফলাফল করতে হবে, নাহলে..., এই নাহলের আর শেষ থাকে। তাই, সকলেই পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। আর তার অমানসিক মানসিক চাপ গ্রাস করতে থাকে তাদের। এবং শুধুমাত্র পড়াশুনোতেই ভালো হলে চলবে না। গান, আঁকা, নাচ, আবৃত্তি এবং আরও যা যা গুণ থাকতে পারে একজন মানুষের মধ্যে, তাকে সবকিছুতে সেরা হতে হবে। আর এই অসহ্য মানসিক চাপ অজান্তেই তাদের উপর চেপে বসে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা বেশি দেখা দেয়।
আরও পড়ুন- সব কিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করেন? কেন বেড়ে ওঠে ‘ভিকটিম’ মানসিকতা?
এই সময় মেয়েরা বড় হয়ে ওঠে। বুঝতে শেখে পারিপার্শ্বিক অবস্থা। বেশিরভাগ মেয়েরাই বাড়িতে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হয় এবং এই বৈষম্য বোঝার বয়স এটিই। সমাজের তাদের প্রতি চিন্তাধারা বোঝার বয়স এটিই। বয়ঃসন্ধির সময় এটি। তাই হরমোনের পরিবর্তন হয় এবং হরমোনের প্রভাবে মানসিক সমস্যাও বেশি দেখা দিতে শুরু করে। ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন হতে থাকে। ঋতুচক্র শুরু হয় এই বয়সসীমার মধ্যেই। শরীরের গঠন সম্পূর্ণ হওয়ার বয়সও এটিই। ফলে, নিজের শরীরের আকার, আয়তন, চেহারা নিয়ে সমালোচিত হতে হয় এইসময়।
এই বয়সসীমায় সকলেই বাবা-মায়ের হাত ছেড়ে একটু স্বাধীনভাবে নিজেদের মতো করে জীবন উপভোগ করতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, ছেলেরা সেই ছাড় পায়, কিন্তু মেয়েদের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়। নিজের বাড়ির সমস্যাও এইসময় বুঝতে পারা যায়। তাই, বাড়ির অন্যান্য বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক সমস্যাও বুঝতে পারে তারা।
বাড়িতে অনবরত মেয়ে হওয়ার 'সাইড ইফেক্ট' হিসেবে বাড়ির সব কাজ শেখা বাধ্যতামূলক, এটা তারা এই বয়স সীমাতেই শুনতে পায়। যেসকল মেয়েরা নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অংশ, তাদের ক্ষেত্রে লড়াইটা আরও কঠিন। তারা স্কুলে যায়, পড়াশোনা শেখে, বড় হতে চায়, নিজের পরিচিতি তৈরি করতে চায় কিন্তু পরিবারের সদস্যরা চায় তাদের বিয়ে দিতে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এমনকি অনেকেই বাল্যবিবাহেরও শিকার হয়।
আর এই সমস্ত কারণেই বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণি, অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হলেও, সমস্যারও কারণ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সমস্যার কারণ থাকলেও, ভুগতে হয় এই বয়সসীমার মেয়েরা তাদের না বেশি মানসিক চাপ, অবসাদ, অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার দেখা দেয়। উল্টোদিকে, ছেলেদের ক্ষেত্রে আচরণগত সমস্যা বেশি দেখা দেয়।

Whatsapp
