রেখে যাচ্ছি যে ছাই: কেন পশ্চিমবঙ্গকে তামাকের বিষাক্ত পথ থেকে সরে আসতেই হবে?

World No-Tobacco Day: একটিমাত্র সিগারেট তৈরি করতে লাগে ৩.৭ লিটার জল। গোটা বিশ্বে প্রতিবছর তামাক শিল্প ২২০০ কোটি টন জল ব্যবহার করে যা কিনা ২২টি ডাল লেকের সমান।

আমার ছোটবেলা কেটেছে পুরুলিয়ার এক অখ্যাত গ্রামে। যদিও তাকে ঠিক প্রত্যন্ত বলা যাবে না কারণ বড় রাস্তার উপরেই সেই গ্রাম। স্কুল, কলেজ ও পাবলিক লাইব্রেরি রয়েছে। আর রয়েছে ২ কিমির মধ্যে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তবুও বৈশাখের প্রথম বৃষ্টিতে যে সোঁদা মাটির গন্ধ বা শরতে শিউলি ফুলের সুবাস তার স্মৃতি চির অমলিন। আমার পিতামহ পুরুলিয়া জেলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর কাছে শুনেছি, তিনি একটা সময় প্রচুর সিগারেট খেতেন, পরে ছেড়ে দেন এবং ছেড়ে দেওয়ার পর কেউ বিড়ি বা সিগারেট খেলে তার গন্ধে তিনি বিরক্ত হতেন। যেহেতু তাঁর সঙ্গেই আমার ছোটবেলা কেটেছে, ফলে তামাকের গন্ধ যে খারাপ, তামাক ব্যবহার যে ক্ষতিকারক তা আমার মনে সেই বয়স থেকেই বসে গিয়েছিল। কাজেই আজকাল যখন গ্রামে যাই, সিগারেটের ফিল্টার বা প্যাকেট, বিড়ির অবশিষ্টাংশ, অধূমায়ী তামাকের প্লাস্টিক প্যাকেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখি, তখন কেবলই মনে হয় যে, তামাক শুধুমাত্র শরীরেরই ক্ষতি করে না, তা পরিবেশের জন্যও এক ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর পদার্থ। তামাক মুখে দেওয়ার অনেক আগেই এই শিল্প নানাভাবে পরিবেশের ক্ষতি করে থাকে — গাছ কাটা হয়, নদী-সমুদ্র দূষিত করে, বাতাস বিষিয়ে তোলে। মনে রাখতে হবে, সিগারেটের ফিল্টার হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ফেলে দেওয়া বর্জ্য পদার্থ।

তামাক বর্জ্য পরিবেশের নীরব খুনি

২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ১২৫টি তামাক উৎপাদনকারী নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলির মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি দেশ প্রতিবছর গড়ে ২ লক্ষ ১১ হাজার হেক্টর বনাঞ্চল হারিয়ে ফেলেছিল। সেই রিপোর্ট দেখিয়েছিল যে, ভারতে ১৯৬২ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে ৬৮ হাজার হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে তামাক ব্যবহারের কারণে অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে ১৭০০ হেক্টর বন কাটা হয়েছে— যা আয়তনে প্রায় কলকাতা শহরের সমান। যদিও আমরা বরাবর তামাককে ব্যক্তিগত অভ্যাস, কিংবা স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবেই দেখি কিন্তু এর প্রকৃতি ধ্বংসের দিকটি প্রায়ই অনালোচিত থাকে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাক শিল্প প্রতিবছর ৮ কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত করে যা প্রায় ৩০ লক্ষ ট্রান্স আটলান্টিক বিমানের যাতায়াতের সমান।

আরও পড়ুন-তামাকের বিজ্ঞাপনের জন‍্য বন্ধ টুর্নামেন্ট! টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট শুরুর ইতিহাস চমকে দেবে

একটিমাত্র সিগারেট তৈরি করতে লাগে ৩.৭ লিটার জল। গোটা বিশ্বে প্রতিবছর তামাক শিল্প ২২০০ কোটি টন জল ব্যবহার করে যা কিনা ২২টি ডাল লেকের সমান। এক্ষেত্রে আরেকটি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি সিগারেটের ফিল্টার প্রায় ৫০০ লিটার অবধি জল দূষিত করতে পারে, যার প্রভাব আমরা মাছের উপরে দেখতে পাচ্ছি। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যেরও প্রবল ক্ষতি হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, সামুদ্রিক পরিবেশগত ব্যবস্থা (Marine Eco-System) জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সিগারেট ফিল্টার সেলুলোজ আসিটেট নামের এক ধরনের প্লাস্টিক যা জৈবপচনশীল নয় (Biodegradable)। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি সিগারেটের ফিল্টার পড়ছে রাস্তায়, নদীতে বা সমুদ্রে। সেক্ষেত্রে সহজেই অনুমেয়, এতে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে আমাদের।

পশ্চিমবঙ্গের হাল

২০২২ সালে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সস, যোধপুরের নেতৃত্বে একটি রিপোর্ট, তামাক ব্যবহারের ফলে সারা ভারতবর্ষে পরিবেশের কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে তার একটা হিসেব দিয়েছিল। সেই রিপোর্ট তৈরিতে আমরাও জড়িত ছিলাম। সেই রিপোর্ট বলছে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবছর তামাকজাত পণ্যের কারণে উৎপন্ন প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ হলো— সিগারেট থেকে ২০৭ টন, বিড়ি থেকে ১০৮৪ টন, ধূমহীন তামাক থেকে ৪৬৯০ টন। অর্থাৎ সব ধরনের তামাকজাত পণ্যের মোট প্লাস্টিক বর্জ্য হলো ৫৯৮২ টন। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক যে পরিবেশকে কতখানি দূষিত করছে, তা বলার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই।

পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবছর সিগারেট সেবনের ফলে প্রায় ৬১৭ টন অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল বর্জ্য হিসেবে মাটিতে পড়ে — যা দিয়ে ৩টি বোয়িং বিমান বানানো সম্ভব। এই অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল-বর্জ্য পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কারণ এটি সহজে পচনশীল নয় এবং মাটির উর্বরতা ও জলজ পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

আরও পড়ুন- সিগারেট যারা কখনই খান না, তারাই বেশি আক্রান্ত ফুসফুসের ক্যান্সারে! কেন?

পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর ফিল্টার (বিড়ির অবশিষ্টাংশ সমেত বার্ষিক বর্জ্যের পরিমাণ হলো সিগারেটের থেকে ১৩৩ টন, বিড়ি থেকে প্রায় ৬ টন) যা উৎপন্ন হয় তা দিয়ে প্রায় ৯ লক্ষেরও বেশি টি-শার্ট বানানো যাবে।

পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবছর তামাকজাত পণ্যের কারণে মোট বর্জ্যের পরিমাণ (কাগজ + প্লাস্টিক + ফয়েল + ফিল্টার) পরিমাণ ১৪ হাজার ৬৩৬ টন (সিগারেট থেকে ৪ হাজার ১৪৯, বিড়ি থেকে ২১১২, ধূমহীন তামাক থেকে ৮ হাজার ৪৭৫ টন)। প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজারের মতো গাছ কাটা হয় তামাক দ্রব্যের পেপার প্যাকেজিংয়ের কারণে। তা দিয়ে ৬৩ লক্ষের মতো নোটবুক তৈরি করা সম্ভব হতো।

পশ্চিমবঙ্গের শুধুমাত্র সিগারেট খাওয়ার জন্য একটি রক্ষণশীল হিসেবে অনুযায়ী প্রায় ৩ কোটির কাছাকাছি গাছ কাটা পড়ে এবং ৩৫০০ কোটি লিটার জল খরচ হয়, যা দিয়ে ১৪০০ অলিম্পিক সুইমিং পুল (২৫ লক্ষ লিটার লাগে এক একটির জন্য) বানানো সম্ভব। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হিসেব কষে দেখিয়েছে যে প্রতি ৩০০ সিগারেটে একটি গাছ কাটা পড়ে, আর আগেই বলেছি প্রতি সিগারেটে ৩.৭ লিটার জল লাগে।

একটি প্রতিজ্ঞা: আমার, আপনার, আমাদের বাংলার জন্য

এই বাংলা একদিন নীলচাষের বিরুদ্ধে, জমিদারদের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। সেই বাংলাকেই আরেকবার নেতৃত্ব দিতে হবে তামাকের বিরুদ্ধে, পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে, আর অবশ্যই সুস্থ জীবনের পক্ষে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার যে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তাকে সর্বতোভাবে সমর্থন করা জরুরি। স্বাস্থ্য দফতরের তামাক বিরোধী কার্যকলাপের সাফল্যমণ্ডিত হওয়াও সর্বতোভাবে কাম্য। আমাদের শিশুরা যেন শ্বাস নিতে পারে বিশুদ্ধ বাতাসে। আমাদের নদী যেন বইতে পারে অবাধ ধারায়। আমাদের সমুদ্র হোক দূষণহীন। আমাদের পরিবেশ যেন তামাকের ছাইয়ের নীচে চাপা না পড়ে যায়। তামাক ছাড়া আবশ্যিক কারণ আমরা কেবল নিজের বাঁচি না, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাতাস, জল, জমি, জঙ্গল আর ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা আমাদেরই কর্তব্য।

 

লেখক ডঃ নির্মাল্য মুখোপাধ্যায় টোব্যাকো ফ্রি জেনারেশন প্রকল্পের মুখ্য অধিকর্তা

More Articles