দুই বাংলাকে আজও জুড়ে রাখে যে অদৃশ্য সেতু, সেই মায়া-জাদুকরের নাম হুমায়ূন আহমেদ

Humayun Ahmed: কর্কট রোগ সময়ের আগেই শব্দ-পাঠক-সাহিত্য থেকে দূরে নিয়ে চলে গিয়েছে হুমায়ূনকে। তিনি বেঁচে থাকলে কী হত বলা কঠিন, কিন্তু হুমায়ূনহীন ভুবনেও তিনি বড্ড স্পষ্ট, বড্ড প্রকট যেন।

পঞ্চাশের দশকে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, "ওপারে যে বাংলাদেশ/এপারেও সেই বাংলা"। সদ্য দেশভাগের ক্ষত, মানতে না পারা মানচিত্র ভাগের ক্ষেত্রে তখন যে পঙক্তি হয়ে উঠেছিল ধ্রুব, তা পরবর্তী কালে নানা আঘাত-টানাপড়েনে পাল্টেছে। পূব বাংলা আর পশ্চিম বাংলার মধ্যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক দূরত্ব ক্রমশই বেড়েছে, বলাই বাহুল্য। গত কয়েক বছরে নানা বিষয়ে দুই দেশের মতানৈক্য চোখে পড়েছে কটূভাবেই। তবু কোথাও যেন দুই বাংলাকে জুড়ে রেখেছিল ভাষা। আর সেই ভাষাগত ঘনিষ্ঠতার সুযোগেই সাহিত্যে হয়ে উঠেছিল তার ভরসাযোগ্য সেতু। একটা সময় ছিল, যে সময় বাংলাদেশ ছিল ভারতীয় সাহিত্যের মুখাপেক্ষী। রবীন্দ্র-নজরুল তো ছিলই, বিভূতি-তারাশঙ্কর থেকে শুরু করে সুনীল-সমরেশেই আত্মার আরাম খুঁজে পেত বাংলাদেশী পাঠক। বাংলাদেশের সাহিত্যদুনিয়ার সেই দৈন্য কাটাতে উঠে এসেছিলেন এর রসায়নের অধ্যাপক, যাঁকে অচিরেই বিশ্ব চিনবে হুমায়ূন আহমেদ নামে। তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশের তরুণ সম্প্রদায় খুঁজে পাবে হিমুর হলুদ পাঞ্জাবি, মিসির আলির রহস্যময় দুনিয়াকে, খুঁজে পাবে হুমায়ূন নামক এক অনন্ত-বিশ্বের চাবিকাঠি। কিন্তু শুধু বাংলাদেশ? একদিন যে সুনীল-সমরেশের স্বাদ পূববাংলার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিল পশ্চিম, হুমায়ূন-স্বাদে বঞ্চিত থাকবে কি তাঁরা? মোটেও প্রানা, আজও এ পার বাংলার বইমেলাগুলোতে হটকেকের মতো বিক্রি হয়ে যায় হুমায়ূনের বই। প্রায় এক দশকেরও বেশি হয়ে গেল, হুমায়ূন নেই। অথচ তাঁর সাহিত্যভুবনের চাবি পাঠক আজও নেড়েচেড়ে দেখেন, ডুবে যান সেই অতলে। সাম্প্রতিক কালে এই যে দুই বাংলার কূটনৈতিক সম্পর্কের অবক্ষয়, রাজনৈতিক দূরত্ব, তার মধ্যেও কি আসলে সেতুর মতোন জেগে নেই হুমায়ূন?

১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্ম হুমায়ূন আহমেদের। আজ তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হত ৭৭। কেবলই কথাসাহিত্যিক ছিলেন না হুমায়ূন। একাধারে তিনি ছিলেন কবি, নাট্যকার, গীতিকার, চলচ্চিত্রকার।   ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিলাভের পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। পরে নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়নে পিএইচডি শেষ করে ফিরে আসেন দেশে। সেখানেই শুরু হয় অধ্যাপনা। জীবনের যেটুকু সঞ্চয়, সবটুকুই তিনি ব্যয় করেছেন তাঁর শব্দভুবনে। তার পরেও এক অক্ষয় অনিকেতবোধ তাড়া করে ফিরেছে তাঁকে অনবরত, যেমনটা করে থাকে যে কোনও মহৎ সৃষ্টিশীলকে। তিনি তাঁর 'গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না' কবিতায় লিখছেন,


আমি সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার জন্য বসে আছি।
যে জ্যোৎস্না দেখামাত্র গৃহের সমস্ত দরজা খুলে যাবে-
ঘরের ভেতরে ঢুকে পরবে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব-
পূর্নিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে।
চারদিক থেকে বিবিধ কন্ঠ ডাকবে- আয় আয় আয়।  

গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না/ হুমায়ূন আহমেদ   


আরও পড়ুন: নাটকের চরিত্রের ফাঁসির বিরোধিতায় রাস্তায় মানুষ! কেন আজও পড়তেই হয় হুমায়ূন আহমেদ

তাঁর প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৭২ সালে।  শোনা যায়, ছোটগল্প হতে হতে শেষপর্যন্ত উপন্যাসের সফর শেষ করেছিল হুমায়ূনের এই উপন্যাসটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ চলছে সে সময়। সে সময় অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হুমায়ূন। দ্বিতীয় উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার। গোটা জীবনে দুশোরও বেশি উপন্যাস লিখেছেন তিনি।  ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘দেয়াল’, ‘বাদশাহ নামদার’, ‘কবি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘লীলাবতী’, ‘গৌরীপুর জংশন’, ‘নৃপতি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘নক্ষত্রের রাত’ দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে পাঠক মহলে। তার মধ্যে রয়েছে তাঁর জনপ্রিয়তম চরিত্র হিমু ও মিসির আলি। হিমুর সব মিলিয়ে মোট ২১টি উপন্যাস ও মিসির আলির অন্তত ১৯টি উপন্যাস ও ১১টি ছোটগল্প রয়েছে।  লিখেছেন কবিতা ও নাটক।  আমার ছেলেবেলা , বলপয়েন্ট , ফাউন্টেন পেন , হিজি-বিজি , হোটেল গ্রেভার ইন , মে ফ্লাওয়ার , কাঠ পেন্সিল , লীলাবতীর মৃত্যুর মতো লেখাগুলিতে ধরা পড়েছে নিজের জীবনের ছায়া। হুমায়ূনের প্রথম টেলিভিশন নাটক ছিল নওয়াজিশ আলী খান পরিচালিত 'প্রথম প্রহর'।  তাঁর একাধিক উপন্যাস পরবর্তী কালে নাটকে রূপান্তরিত হয়েছে। রয়েছে তাঁর লেখা স্বাধীন নাটকও। নিজের গল্পের উপর ভিত্তি করে ১৯৯৪ সালে প্রথম ছবি পরিচালনা করেন হুমায়ূন, 'আগুনের পরশমনি'। সেরা চলচ্চিত্র এবং সেরা পরিচালকের পুরস্কার-সহ মোট আটটি বিভাগে ১৯তম বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেয় সেই ছবি। শ্যামল ছায়া এবং ঘেটুপুত্র কমলা নামে হুমায়ূন পরিচালিত দুটি ছবি ২০০৬ ও ২০১২ সালে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের জন্য একাডেমি পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশী এন্ট্রি হিসাবে নির্বাচিত হয়। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক 'একুশে পদক' পান হুমায়ূন। এছাড়া পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮)।

কিন্তু এসব তো সব খাতায়-কলমের স্বীকৃতি। এর বাইরে মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছেন হুমায়ূন, তা এক কথায় বলার বাইরে। এ কথা বললে ভুল হবে না, তাঁর জাদুশব্দমালার হাত ধরেই নিজের দেশের সাহিত্যের উপরে ভরসা ফিরে পেয়েছিল বাংলাদেশি পাঠক। তার আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প ছিল এ পার বাংলার সাহিত্যিকদের লেখালিখিতে ঠাসা। সেখান থেকে বাংলাদেশকে নতুন ভুবনে তুলে এনেছিল হুমায়ূন আহমেদের লেখালিখি। শোনা যায়,  কোনও একবার বাংলাদেশের বইমেলায় প্রায় ৩০ কোটি বই বিক্রি হয়, যার অর্ধেক অংশ জুড়েই ছিল হুমায়ূনের বই। প্রতি বছর একুশের বইমেলায় হুমায়ূনের বই কিনতে উপচে পড়ত ভিড়, যা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হত কর্তৃপক্ষকে। অবস্থা এমন দাঁড়াত নাকি, কোনও কোনও বার বইমেলা কর্তৃপক্ষ হুমায়ূনকে মেলার মাঠে আসতে বারণ পর্যন্ত করে দিয়েছেন। কিন্তু এ তো বাংলাদেশের কথা, এপার বাংলার বইমেলাতেও কি আজও দারুণ জনপ্রিয় নন হুমায়ূন। আজও একটু খবর নিলেই দেখা যাবে, বইমেলার মাঠে কীভাবে আজও মুহূর্তে ফুরিয়ে যায় হুমায়ূনের সাহিত্য সম্ভার। ভারতের পাঠক বিশেষত পশ্চিমবাংলাতে হুমায়ূনমনষ্ক পাঠকের কমতি নেই আজও। হলুদ পাঞ্জাবির ছটা এই বাংলাতেও হিমুদের ফিরিয়ে আনে বারংবার। 

হুমায়ূনের ব্যক্তিগত জীবন ছিল সিনেমার মতোই রংচঙে। নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন বারবার। প্রথম স্ত্রী ও পরিবারকে ছেড়ে কন্যাসমা  মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া এবং দ্বিতীয় বিয়েকে ভালো চোখে নেননি অনেকেই। হুমায়ূন চলে গিয়েছেন প্রায় ১২ বছর হয়ে গেল, সে নিয়ে বিতর্ক এখনও জারি রয়েছে দুই বাংলায়। এমনকী হুমায়ূনের মৃত্যু, তাঁর শেষকৃত্য সবকিছুই বিতর্কের আলোয় ঘেরা। তা সত্ত্বেও তিনি হুমায়ূন। যার একেকটা বাক্য বুনে দেয় মোহনীয় পাঠক মনঃস্তত্ত্বের জাল। আলাদা দর্শনের আলোয় এক অদ্ভূত জায়গায় নিয়ে চলে যেতে পারেন তিনি পাঠককে। 

"পৃথিবীতে আসার সময় প্রতিটি মানুষই একটি করে আলাদিনের প্রদীপ নিয়ে আসে…কিন্তু খুব কম মানুষই সেই প্রদীপ থেকে ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগাতে পারে।"

— এমন অমোঘ লাইন আর ক'জনই বা লিখতে পেরেছেন বাংলা সাহিত্যে? পাঠক তাই হুমায়ূনে মজেছেন বারবার, মজেন আজও। 

এই যে বাংলাদেশময় হুমায়ূনের এমন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা, তা সত্ত্বেও কিন্তু বারবার ভারতীয় পাঠককে ছুঁতে চেয়েছেন বারবার। আনন্দবাজার পত্রিকায় হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে একটি লেখায় সমরেশ মজুমদার জানিয়েছেন, তাঁর কাছে হুমায়ূন ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন, যাতে দেশ পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপার ব্যবস্থা করে দেন। হুমায়ূন নাকি বলেছিলেন, "যে কাগজে রবীন্দ্রনাথ থেকে আপনারা লিখেছেন, সেখানে না লিখলে নিজেকে ঠিক—  "। এরপর সাগরময় ঘোষের সঙ্গে পরিচয়, আস্তে আস্তে দেশে ধারাবাহিক ভাবে হুমায়ূনের লেখা প্রকাশ হওয়া, সে সবই ইতিহাস। কিন্তু এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, এই বাংলার পাঠক হুমায়ূনকে নিজের করে পেয়েছে অনেক পরে। বাংলাদেশ যে খনির সন্ধান বহুদিন আগেই পেয়েছিল, ভারতীয় পাঠকের সেই রত্নের খোঁজ পেতে সময় লেগে গিয়েছে কিঞ্চিত বেশি। হুমায়ূনের মৃত্যুর পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বহু সাহিত্যিকই অভিযোগ করেছিলেন, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে হুমায়ূনের মৃত্যু যেন সেইভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি। কিন্তু পেরেছে হুমায়ূনের সাহিত্য, দেরিতে হলেও সে খুঁজে নিয়েছে নিজস্ব পাঠক। সাহিত্যিক হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ভারী পছন্দ করতেন হুমায়ূন। অনেকবার অনেককে জানিয়েছেন, সুনীলের লেখার নাকি আশ্চর্য ম্যাজিক, লেখকের আশ্চর্য ক্ষমতা এই যে তিনি পাঠককে জোর করে শেষ পর্যন্ত পড়িয়ে নেন। হুমায়ূনের মধ্যেও আসলে ছিল সেই আশ্চর্য ক্ষমতা। যাঁর নাটকের চরিত্রের পর্দার ফাঁসির বিরোধিতায় রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল বেরোয়, তাঁর জনপ্রিয়তার আন্দাজ পাওয়া বোধহয় মস্ত রকেট সায়েন্স নয়। 


আরও পড়ুন: নজরুলকে এখনও ভালো করে বুঝতে পারিনি আমরা: মারিয়া এলেনা বাররেরা-আগারওয়াল 

কর্কট রোগ সময়ের আগেই শব্দ-পাঠক-সাহিত্য থেকে দূরে নিয়ে চলে গিয়েছে হুমায়ূনকে। তিনি বেঁচে থাকলে কী হত বলা কঠিন, কিন্তু হুমায়ূনহীন ভুবনেও আজও তিনি বড্ড স্পষ্ট, বড্ড প্রকট যেন। নিজের লেখায় তিনি লিখেছিলেন, 

“পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই।”

অথচ ব্যক্তিগত জীবনে সম্পর্কের জটিলতা তাঁর মাথায় পরিয়ে দিয়েছিল কাঁটার মুকুট। বিষন্ন যীশুর মতোই সেই কাঁটার মুকুট মাথায় নিয়েই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন হুমায়ূন। রয়ে গিয়েছে তাঁর আশ্চর্য সাহিত্যের মায়াজগৎ। যা শত বিরোধিতা, শত কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যে দাঁড়িয়েও বেঁধে দিয়েছে এক অদৃশ্য চর, এক অমোঘ সেতু। যে সেতুতে যাতায়াত কোনওদিন শেষ হওয়ার নয় পাঠকের। সেখানে দেশ-কাল-কাঁটাতার সমস্ত সীমারেখা পেরিয়ে আর কিছু নয়, ধ্রব শুধু হুমায়ূন। বাংলা সাহিত্যের এক আশ্চর্য মায়া-জাদুকর। 

More Articles