কেন ইনকিলাব ধ্বনি দিচ্ছেন ইরানের মেয়েরা! কীভাবে পাড়ি দিল ভগতের স্লোগান

Iran Inquilab Zindabad: ইরানের মানুষের মুখে শোনা যাচ্ছে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, পিছু হটছে পুলিশের গাড়ি, পিছু হটছে গাস্ত-ই এরশাদের অত্যাচারী ‘পৌরুষ’।

“পুরনো সমস্ত বিশ্বাসের সমালোচনা চাই। অবিশ্বাসে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। প্রতি পদে ঘাড় বেঁকিয়ে তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে। তার প্রতিটি গলিঘুঁজি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা চাই যুক্তির আলোয়। যুক্তি দিয়ে যথেষ্ট চাবকানোর পর কেউ যদি কোনও তত্ত্বে বা দর্শনে বিশ্বাস করতে চান, সেই বিশ্বাসে অসুবিধা নেই। যুক্তিতে ভুল থাকতে পারে, ভুল বোঝানো হতে পারে, যুক্তি প্রয়োগেও ভুল হতে পারে, এমনকি কখনও কখনও সে ভুলের কারণে হয়তো বিরাট ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু যুক্তিকে শিক্ষক মানলে ভুল সে একদিন না একদিন শুধরে নিতে বাধ্য। তবে যুক্তিহীন বিশ্বাস, বিচারহীন বিশ্বাস অত্যন্ত ক্ষতিকর; বিচারবুদ্ধির গোড়ায় ঘা দিয়ে তা ব্যক্তিকে চরম প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে।”

—কেন আমি নাস্তিক, ভগৎ সিং

আজ পৃথিবী স্তব্ধ। ভুল হল, আজ বিশ্বের প্রতিটি শাসক স্বর কেঁপে উঠছে। রাষ্ট্রের হয়ে যে ভিড় আখলাককে চোখ রাঙায়, সেই ভিড়ের পাঁজরে দোলা লেগেছে। অন্ধকার বাড়ির ভিতর অথবা খোলামেলা দিনের আলোয় যে পুরুষ নির্বিচারে নারীর গায়ে হাত তোলে, সেই হাত আজ একটু হলেও কেঁপে যাচ্ছে। যে সরকার নারীর শাড়ি, শাঁখার বিধান দেয়, নারী বোরখা পরবে কী পরবে না ঠিক করে দিতে চায়, সেও আজ দু’টি হাত বুকের কাছে গুটিয়ে রেখেছে। ঠিক এই কারণেই শহিদ হয়েছেন বছর বাইশের মাশা আমিনি। ইরানের ঘাতক পুলিশ গাস্ত-ই এরশাদ তুলে নিয়ে গিয়ে অকথ্য অত্যাচার চালায় তাঁর ওপর। অভিযোগ, হিজাবের তলা দিয়ে তাঁর কিছু চুল দেখা যাচ্ছিল। সেই অনৈতিকতাকে সমুচিত শিক্ষা দিতে তাজা ফুটফুটে একটি প্রাণ কেড়ে নেওয়া যেতেই পারে। তিনদিন যমে মানুষে টানটানির পর নিথর হয়ে গিয়েছে সেই যুবতীর দেহ। অনৈতিকতার প্রতীক। সময় লাগেনি। সেই মৃত্যুতে আগুন ছড়িয়েছে ইরানের রাস্তায়। হিজাব, বোরখা খুলে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছেন নারীরা। নিশান করে উড়িয়েছেন কেটে ফেলা অনৈতিক চুল। উন্মুক্ত বুকে বড় বড় অক্ষরে লেখা মাশা আমিনি। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের গুলি চলছে, অত্যাচার চলছে। একচুল নড়ছেন না কেউ। আজ পৃথিবীর প্রতিটি শাসক স্বর কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর এই স্তব্ধতাকে চাপিয়ে দেওয়া বোরখার মতোই ছিঁড়েখুঁড়ে উঠে আসছে অত্যাচারিতের চিৎকার। ইরানের মানুষের মুখে শোনা যাচ্ছে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, পিছু হটছে পুলিশের গাড়ি, পিছু হটছে গাস্ত-ই এরশাদের অত্যাচারী ‘পৌরুষ’।

ভারতের মানুষের বুকে দীর্ঘদিনের চেষ্টায় এ স্লোগানে জ্বালা ধরানো গেছে। অথচ একদিকে ‘বন্দেমাতরম’, অন্যদিকে ‘আল্লাহু আকবর’-এর মাঝে কেন এই স্লোগান বেছে নিয়েছিলেন ভগৎ সিং? কী এর উৎস? কী এর ইতিহাস? কেন এই স্লোগান মুছে ফেলার এত চেষ্টা অহরহ? কেনই বা এই ‘অপবিত্র’, ‘ম্লেচ্ছ’ স্লোগান আজ ইরানের প্রতিবাদীদের মুখে মুখে? জানলে অবাক হবেন, এই স্লোগানের জন্ম দিয়েছিল ভারত, এই স্লোগানের জন্ম দিয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। এক উর্দু শায়রের মুখে প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল এই স্লোগান।

আরও পড়ুন- কর্নাটক থেকে ইরান, হিজাব বিতর্কই মেলালো দুই দেশের মুসলিম নারীদের?

বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ জাতীয়তাবাদের একেবারে গোড়ার পর্যায় বলা যায়। বা বলা ভালো, স্বাদেশিকতার সঙ্গে ‘বাহুবল’ জুড়ে দেওয়ার একেবারে প্রাথমিক ধাপ। প্রথম সংস্করণ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী। কিন্তু ব্রিটিশ প্রভুরা তাতে খুব একটা খুশি হননি বলাই বাহুল্য। এক এক করে সংস্করণ বেরোল, একটু একটু করে ব্রিটিশ বিরোধিতাও ঝরে গেল। বর্তমানের কর্তাব্যক্তিদের চাপে ইতিহাসের দিকে ঝুঁকলেন বঙ্কিম। দশ বছরে পাঁচটি সংস্করণ। এখন যা পাওয়া যায়, তা ওই পঞ্চম সংস্করণই। দেখা গেল ব্রিটিশ বিরোধিতা তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, বরং প্রকট মুসলিমবিদ্বেষ। এইবার প্রভুরা খুব খুশি হলেন। উপন্যাসেও আর কোনও পরিবর্তন হল না। “মুসলমান রাজ্য ধ্বংস হইয়াছে, কিন্তু হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হয় নাই— এখনও কলিকাতায় ইংরেজ প্রবল।” অথচ সত্যানন্দের আর কিছুই করণীয় নেই। এইখানেই ভারতের জাতীয়াতাবাদের সুরটি ‘বন্দেমাতরম’ পৌত্তলিকতায় বেঁধে দিল। যে পৌত্তলিকতা মুসলমান সমাজের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,

“বর্তমান সময়ে কতকগুলি বিশেষ কারণে হিন্দু আপনার হিন্দুত্ব লইয়া ভয়ঙ্কর রুখিয়া উঠিয়াছে। সেটা সম্বন্ধে তাহার মনের ভাব বেশ সহজ অবস্থায় নাই। বিশ্বরচনায় এই হিন্দুত্বই বিধাতার চরম কীর্তি এবং এই সৃষ্টিতেই তিনি তাঁহার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করিয়া আর কিছুতেই অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না, এইটে আমাদের বুলি”।

জাতীয়তাবাদের স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ যথাযথ ধরেছিলেন। কিন্তু ততদিনে ‘বন্দেমাতরম’ কংগ্রেসের মূল স্লোগান হয়ে গিয়েছে।

এদিকে বঙ্গভঙ্গের প্রাথমিক প্রচেষ্টার আগুনেই মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হিন্দু মহাসভার জন্ম হয়েছে। জাতীয়তাবাদের নখদাঁত দেখতে পাচ্ছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। এরই মাঝে সাভারকরকে রাজদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করা হল। ১৯২১ সালে দ্বীপান্তর। যেখান থেকে মুচলেকা দিয়ে ফিরে তিনি ‘বীর’ হয়ে উঠবেন। কিন্তু তার তখনও দেরি আছে। সেই একই বছর আহমেদাবাদের কংগ্রেস অধিবেশনে প্রখ্যাত উর্দু কবি মওলানা হসরত মোহানী প্রথম উচ্চারণ করবেন ফার্সি শব্দজোড় ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। ফরাসি বিপ্লব, প্যারি কমিউন পেরিয়ে ততদিনে ইতিহাসে যোগ হয়েছে একটি নতুন অধ্যায়। নভেম্বর বিপ্লব। তথা ১৯১৭-র রুশ বিপ্লব। লেনিনের নেতৃত্বে জারের শাসন ছুঁড়ে ফেলে রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিয়েছে সাধারণ মানুষ। এসেছে সমাজতন্ত্র, বোনা হয়েছে সাম্যবাদের বীজ। এদেশে কংগ্রেসের সেই ক্ষমতাই ছিল না। পুঁজির সে ক্ষমতা গড়েই উঠতে দেয়নি ব্রিটিশ। টিকিয়ে রেখেছে জমিদারতন্ত্র। ফলে প্রথম পথ (ব্রিটেনের পুঁজিবাদ) ও দ্বিতীয় পথে (জার্মানি ও ইতালির সামরিকতন্ত্র তথা ফ্যাসিবাদ) না হেঁটে এক তৃতীয় পথে (সিজারিজ়ম) সদ্যোজাত বৃহৎ পুঁজি, খুচরো পুঁজি এবং জমিদার-জোতদারেরা সম্মিলিতভাবে এক আপোসমুখী লড়াইয়ের দিকে এগোলেন। সামনে শিখণ্ডী দাঁড় করালেন গান্ধীকে। গণের কাছে যাঁর মূর্তিকে ব্যাক্তির থেকেও অনেক বড় করে, পুজোর ঝোঁক তুলে, পরে যাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে কংগ্রেস। কাজেই অহিংসায় তাদের প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল সত্যাগ্রহের। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ সেই শান্তির দিঘিতে বেশরম পাটকেলের মতো তরঙ্গ তুলল। একে স্বীকার করা কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব প্রভাবিত করেছিল অনেককেই। অস্পষ্টতা ছিল। কিন্তু গভীর আলোড়ন উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যেই। স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন ঠাকুরের নাতি সৌম্যেন ঠাকুর, স্বরোজিনী নাইডুর দাদা বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন সেই দলে। ছিলেন মুজাফফর আহমেদ ও এস ডাঙ্গেরা। হসরত মোহানী সেই দলেরই লোক। ঠিক তার আগের বছর তাসখন্দে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির জন্ম হয়েছে। সেই দল লেনিনের স্বীকৃতি পায়। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বাঘাযতীনের অন্যতম সহযোগী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। বারুইপুরের এই নরেন আরেক ইতিহাস গড়বেন। যদিও তখন তিনি এম এন রায় বা মানবেন্দ্রনাথ রায় নামে পরিচিত। বিদেশে বসে তিনিই ঠিক করেন, আহমেদাবাদ অধিবেশনে এবার পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব তোলা হবে। এম এন রায়ের পরিকল্পনামাফিক অবনী মুখার্জির সই করা লিফলেট ভারতের জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশের হস্তক্ষেপে লিফলেট মুজফফর আহমেদ বা ডাঙ্গের ঠিকানায় পৌঁছয় না। কিন্তু ঘটনাচক্রে আজমীরের একটি সাম্যবাদী গোষ্ঠীর হাতে এসে পড়ে সেই লিফলেটের বাণ্ডিল। তাঁরাই সেই লিফলেট নিয়ে আহমেদাবাদ যান এবং সেই প্রস্তাবই অধিবেশনে তোলেন মোহানী। বলাবাহুল্য শঙ্কিত কংগ্রেসের কোনও নেতাই তা অনুমোদন করেননি। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ উচ্চারিত হয় সেই প্রথম।

একদিকে রাশিয়ার বিপ্লব, অন্যদিকে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের খবর প্রভাবিত করছিল ভারতের সাধারণ মানুষকেও। ব্রিটিশদের প্রচণ্ড অত্যাচারের লাল চোখে স্পর্ধার চোখ রাখতে চাইছিল তারা। ইতিমধ্যে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড হয়ে গিয়েছে। ১৯২২-এ সাধারণের মধ্যে তারই একটা ঝলক দেখা গেল চৌরিচৌরার ঘটনায়। পুলিশের অত্যাচারে ক্ষেপে গিয়ে থানা জ্বালিয়ে দিল সাধারণ মানুষ। গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন তুলে নিলেন। মনে রাখা দরকার, এ ভয় কেবল গান্ধীর নয়, এ ভয় সমস্ত কংগ্রেসের। বিপ্লব অস্পৃশ্য। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ গোড়ায় ছেঁটে ফেলতে হবে। এমনই এক টালমাটাল সময়ে উত্তর প্রদেশের এক তরুণ কবি রামপ্রসাদ বিসমিল কংগ্রেস ছাড়লেন। ১৯২৪-এ একরকম তাঁরই নেতৃত্বে গঠিত হল হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (এইচআরএ)। সঙ্গে রইলেন আসফাকউল্লা খান, শচীন্দ্রনাথ বক্সি, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জী প্রমুখেরা। ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে এই দলটির ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশদের পাল্লা দিতে গেলে প্রয়োজন অর্থের। কে দেবে অর্থ? ছিনিয়ে নিতে হবে। ছিনিয়ে নিতে হয়। ১৯২৫-এ শুরু হল কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা। সেই ট্রেন লুঠের ঘটনাকে সামনে রেখে বিপ্লবীদের ওপর তুমুল সন্ত্রাস চালাল ব্রিটিশ। চন্দ্রশেখর আজাদ ফেরার রইলেন। তাঁকে ধরার ক্ষমতা হল না ইংরেজ সরকারের। একে একে বাকি সমস্ত নেতা ধরা পড়লেন। রামপ্রসাদ বিসমিল এবং আসফাকউল্লা খানের ফাঁসি হয়ে গেল ১৯২৭ নাগাদ। কিন্তু বিপ্লবকে কে কবে থামাতে পেরেছে? অধিকারের লড়াই কে কবে রুখে দিতে পেরেছে?

বিসমিল লিখে গেলেন, “সরফরোশি কি তমন্না অব হামারে দিল মে হ্যায় / দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজু-এ-কাতিল মে হ্যায়"। এইচআরএ-র সামনের সারিতে উঠে এল কিছু নতুন মুখ। তারই মধ্যে ভগৎ সিং, তারই মধ্যে রাজগুরু, সুখদেও। ভগৎ সিংয়ের প্রভাবেই এইচ আর এ হল ‘হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টি’, অর্থাৎ এইচএসআরএ। মার্ক্স এবং লেনিনের লেখা নিজের মেধার রসে জারিয়ে নিয়েছিলেন ভগৎ। এই 'এইচএসআরএ'-ই ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’-কে প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করল। এই ১৯২৮ সালেই বোমা পড়ল অ্যাসেম্বলিতে। কেঁপে উঠল ব্রিটিশ শাসন। সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি জুড়ে তখন ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্তের দৃপ্ত কণ্ঠের স্লোগান, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। শাসক কানে খাটো হলে, গলাটাকেই তুলতে হয়— লেখা ছিল তাঁদের লিফলেটে। এরপর বিচারের নামে প্রহসন। ১৯৩১ এর ২৩ মার্চ ফাঁসি হল ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেওয়ের।

আরও পড়ুন- হিজাবের আগুনে পুড়ছে ইরান! কেমন ছিল ইরানের মহিলাদের অতীত

ভারতে বামপন্থীরা দীর্ঘদিন এই স্লোগান ব্যবহার করেছে। স্লোগানের আড়ালে বহু অন্যায্য কাজ যথার্থ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে— এ যেমন সত্য, আবার পাশাপাশি লড়ইয়ের ধারাটিও অব্যহত ছিল। তেভাগা থেকে নকশাল, বারবার কেঁপে উঠেছে রাষ্ট্র। আন্দোলনের পর আন্দোলন। একদিকে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলন, অপরদিকে সংগঠিত এবং অসংগঠিত কৃষক আন্দোলন। ব্যাবেলের টাওয়ারের কী অবস্থা হয়েছিল? সাধারণে যখন হক চায়, তখন সবার আগে তার সমবেত কণ্ঠস্বরটি কেড়ে নেওয়া প্রয়োজন। যে কারণে বামুনের সামনে শুদ্দুরের কথা বলা পাপ, সাদা চামড়ার ভিড়ে চুপ করে ভালো নাগরিক হওয়াই কাম্য কালো চামড়ার, হিন্দুদের দেশে মুসলমানের আওয়াজ যত নরম, চেহারা যত মোলায়েম, তত সে আদর্শ নাগরিকের কাছাকাছি যেতে পারছে— এমন একটা আলগা প্রচার চলে, মুসলিম প্রধান দেশেও তেমনই সংখ্যালঘুদের উপর নেমে আসে অত্যাচার, বাড়ির পুরুষটির কড়া চোখের সামনে চোখ নামিয়ে নিতে হয় নারীকে, আদিবাসী অধ্যাপিকাকে তাঁর জায়গা স্মরণ করিয়ে দেয় এক সাবর্ণ ছাত্রী, সমাজের চোখে লাগে না তেমন পোশাক পরতে হয় রূপান্তরকামী বা তৃতীয় লিঙ্গ বা কুইয়ার সম্প্রদায়কে।

ঠিক এই বিন্দুতেই অধিকার লাভের আশায় ইরানের নারীরা চিৎকার করে প্রতিবাদ করে ওঠেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। সেই স্বর স্পর্ধারই। ধর্মীয় পৌরুষের অত্যাচারের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে চাইছে ইরানের প্রতিবাদী নারীকণ্ঠ। ফের অধিকার আদায়ের সমবেত কণ্ঠ এক হয়ে উঠেছে শাসকের তোয়াক্কা না করেই। শাসকের ‘পুরুষালি’ হাত গুঁড়িয়ে দিয়ে। পৃথিবীর সমস্ত শাসক আজ স্তব্ধ। খানিক “ইসলামের কী অত্যাচার”, “ওখানকার নারীরা কত প্রগতিশীল, আর এখানকার নারীরা হিজাব পরার অধিকার চায়, কী প্রতিক্রিয়াশীল"— ইত্যাদি ন্যারেটিভ নামিয়ে ঝোল টানার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এও খেয়াল রাখা দরকাল, দু’টির প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা, শাসক ঠিক করে দিতে পারে না নাগরিকের পরিধেয় কী হবে! সে যেমন বোরখা চাপিয়েও দিতে পারে না সামরিক বল প্রয়োগে, খুলে নেওয়ার অধিকারও তার নেই। সর্বত্র প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীলতার ডাইকোটমি হুবহু প্রয়োগ করাটা মূর্খামি। ১৮৭৮ সালে মার্ক্স বলেছিলেন, “কোনও সার্বভৌম ঐতিহাসিক-দার্শনিক তত্ত্বকে সবখোল চাবি হিসেবে ব্যবহার করলে কাজের কাজ কিছুই হয় না, সে তত্ত্ব যতই চমৎকার হোক তা অতি-ঐতিহাসিক, দেশকালের প্রেক্ষাপট ছাড়া তাকে বাগ মানানো অসম্ভব।” সমস্যা ভূরাজনৈতিক, রাজনীতিও ভূগোল বিশেষে পালটে যাবেই। থাকবে শুধু অত্যাচারিতের স্পর্ধার স্বর। থাকবে প্রশ্ন করার অভ্যেস। তা ক্রমশ এক স্বরে মেশার চেষ্টা করবে, যে স্বর তাদের কাউকেই ছাড়িয়ে যাবে না। যে স্বরে প্রতিটি কণ্ঠে আলাদা করে চেনা যাবে, অথচ সমবেত সেই স্বরের অনুরণনে কেঁপে কেঁপে উঠবে শাসনের শোষণের ভিত।

শেষে যাঁরা বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন অথবা ভাবছেন না, অথবা যাঁদের কাছে মাশা আমিনির মৃত্যু ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ মনে হচ্ছে, তাঁদের উদ্দেশ্যে দু’টি কথা। শুরু যখন বঙ্কিমের প্রসঙ্গ দিয়ে হয়েছিল, শেষটাও তাঁর প্রসঙ্গ দিয়েই হোক। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “পুনর্ বিষয়ে পুনর্বিবেচনা” প্রবন্ধের শেষে লিখছেন,

“বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সীতারাম’ উপন্যাসটির উপান্তে আছে রামচাঁদ ও শ্যামচাঁদ নামে দুই বন্ধুর কথোপকথন— জাহাজের খবরে কৌতূহলী হলেও সমাজের পঙক্তি-বিচারে তারা নিতান্তই আদার ব্যাপারী। একখানা আটাচালায় বসে তামাক সেজে ঢেলে খেতে-খেতে তারা বিরাট-বিরাট সব রাজনৈতিক কাণ্ডকারখানা নিয়ে আলাপে রত: গড়টড় সব মুসলমানে দখল করে লুটপাট করে নিয়েছে কিনা, রাজা-রাণীকে মুরশিদাবাদে চালান দিয়ে শূলে চড়ানো হয়েছে কিনা, নাকি এক দেবতা এসে তাঁদের বের করে নিয়ে গেছেন, এই সব। গালগল্প ভালোই চলছিল, হঠাৎ রামচাঁদ বলে বসে: ‘তুমিও যেমন! ওসব হিন্দুদের রচা কথা, উপন্যাস মাত্র’। এই এক উক্তির জোরেই এক ঝটকায় উলটো দিকে ঘোরে উচ্চবর্গীয় বয়ানের মুখ, নড়ে ওঠে তার ‘শৈলদৃঢ় আশ্রয়’। এরপরেও যদি আমাদের… ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ ‘পুনর’ পূর্বপদের ঘোর না কাটে, আজও যদি রামচাঁদ-শ্যামচাঁদের সঙ্গে আমরা গলা না মেলাই, তাহলে কি ভবিষ্যতের কাছে জবাবদিহির কিছু থাকবে আমাদের?”

More Articles